শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ও আমাদের করণীয়

ড. আব্দুল হাই তালুকদার | প্রকাশের সময় : ২০ আগস্ট, ২০১৮, ১২:০২ এএম

রমিজ উদ্দীন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুইশিক্ষার্থী রাজীব ও দিয়ার মৃত্যুতে তার সহপাঠীদের সাথে গোটা দেশবাসী ব্যথিত ও মর্মাহত। দুজনের মৃত্যু দেখে ২৯ জুলাই কিশোর শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে আসে। তাদের সাথে গোটা দেশবাসী একাত্বতা প্রকাশ করে। ঢাকার বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে ট্রাফিক পুলিশের দায়িত্ব পালন করতে থাকে। তারা গাড়ির লাইসেন্স, ড্রাইভিং লাইসেন্স, গাড়ির ফিটনেস সার্টিফিকেট চেক করতে শুরু করে। দেখা যায় কোমলমতি ছেলেমেয়েরা মন্ত্রী-এমপি, সেক্রেটারি বড় বড় নেতা, পাতিনেতা কাউকেই ছাড় দিচ্ছে না। তারা এমনভাবে শুরু করে যে, পুলিশের বড় কর্তারাও রেহাই পায় না। গাড়ি চেক করে কাগজ পত্রের ঘাটতি পেলে সাথে সাথেই মামলা রুজু করা হয়। তাদের একাজ নজিরবিহীন। যে কাজ সরকার বা পরিবহন মন্ত্রণালয়ের ও পুলিশ সার্জেন্টদের ছিল, সে কাজ ছেলেরা নিজ দায়িত্বে সম্পাদন করে। কাউকে কোন রকম খাতির বা পরোয়া না করে শিক্ষার্থীরা জাতির বিবেক ধরে টান দেয়। সকলে সুরসুর করে শিক্ষার্থীদের হুকুম মানতে বাধ্য হয়। রাস্তায় ফিটনেসবিহীন, লাইসেন্সবিহীন, ড্রাইভিং লাইসেন্সবিহীন লক্ষ লক্ষ গাড়ি চলাচল করছে। প্রতিদিন ডজন ডজন মানুষ নিহত হলেও লক্কড় ঝক্কড় মার্কা গাড়িগুলো সারাদেশ কাঁপিয়ে বেড়াচ্ছে। মানুষ খুন হলেও কোন রকম দায়বদ্ধতা বা জবাবদিহিতা নেই। দেখার যেন কেউ নেই, শোনার যেন কেউ নেই। প্রতিদিন রাস্তায় মৃত্যুর মিছিল।
ছেলেরা আন্দোলন করে ২৯ জুলাই থেকে ৬ আগস্ট পর্যন্ত। তাদের আন্দোলনের সময় ঢাকার রাজপথে যানবাহনের সংকট দেখা যায়। লাইসেন্সবিহীন, ফিটনেসবিহীন যানবাহনগুলো লুকিয়ে ফেলা হয়। মানুষ যানবাহনের অভাবে রিক্সা, ভ্যান, সিএনজিতে ৩ গুণ, ৪ গুণ ভাড়া দিয়ে চলাচল করে। কিন্তু মানুষের মধ্যে কোন অসন্তোষ বা ক্ষোভ দেখা যায়নি। সকলে মনে করেছিল এই ক্ষুদে শিক্ষার্থীরা রাস্তায় শৃংখলা ফিরিয়ে আনবে। তারা যে পথ তৈরি করতে চাচ্ছে সে পথে ও পদ্ধতিতে পরিবহন মালিক, শ্রমিক ও কর্তৃপক্ষ চলতে বাধ্য হবে। তাদের দেখানো ও শেখানো পথে পরিবহন ব্যবস্থা চালু রাখা গেলে দেশে দুর্ঘটনা অনেকাংশে হ্রাস পাবে। ট্রাফিক সপ্তাহ শুরু হয় ৫ আগস্ট। মানুষ আশা করেছিল, ট্রাফিক সপ্তাহ চলার সময় যানবাহন চলাচলে শৃংখলা বজায় থাকবে, দুর্ঘটনা অনেকাংশে হ্রাস পাবে, নিয়ম-শৃংখলা বজায় রেখে চালকরা সাবধানে গাড়ি চালাবে। কিন্তু ড্রাইভারদের ওভার টেকিং প্রবণতা মোটেই হ্রাস পায়নি, লক্কড় ঝক্কড় মার্কা গাড়িগুলো রাস্তায় চলছে। অবশ্য লক্ষাধিক লাইসেন্সবিহীন, ফিটনেসবিহীন গাড়ি ও ড্রাইভারদের শনাক্ত করে মামলা দায়ের করা হয়েছে। কোমলমতি শিক্ষার্থীরা কয়েকদিন রাস্তায় নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আমাদেরকে দেখিয়ে দিয়েছে কীভাবে নিয়ম শৃংখলা প্রতিষ্ঠা করতে হয় বা করা যায়। তাদের শেখানো পথে আমরা চলতে বাধ্য হয়েছিলাম। নিয়ম শৃংখলা প্রতিষ্ঠার প্রবণতা আমাদের তৈরি হয়েছিল। তারা আমাদের পথ প্রদর্শক। এক্ষেত্রে ট্রাফিক পুলিশের যেমন দায়িত্ব তেমনি যানবাহন মালিক, শ্রমিক, ড্রাইভার, হেলপার ও পথচারীদের দায়িত্ব কম নয়। নিরাপদ সড়ক গঠনে দেশবাসীর সচেতনতা ও সদিচ্ছা আবশ্যক। মালিকদের সদিচ্ছা ও আন্তরিকতা ছাড়া নিরাপদ সড়ক প্রতিষ্ঠা করা অসম্ভব। ঢাকায় লক্ষ লক্ষ গাড়ি চলাচল করে। এসব গাড়ি ভাড়ায় চালানো হয়। একটি নির্দিষ্ট অংশের টাকা মালিককে দেওয়ার পর বাকী আয় ড্রাইভার, কন্ট্রাকটর ও হেলপার ভাগ করে নেয়। ফলে তাদের মজুরী বাড়ানোর জন্য ড্রাইভার হেলপার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। যত আগে যাওয়া যাবে তত পেসেঞ্জার পাওয়া যাবে। পেসেঞ্জার ধরার প্রতিযোগিতার ফলে দুর্ঘটনা ঘটে। যদি শ্রমিকদের বেতন নির্ধারণ করে দেওয়া যায়, সেক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা অনেকাংশে হ্রাস পাবে। দুর্ঘটনাও কমে আসবে। শোনা গেল মালিকরা শ্রমিকদের মজুরী বেঁধে দিয়ে রাস্তায় গাড়ি নামাবেন। কিন্তু পরদিনই দেখা গেল ভাড়ায় রাস্তায় গাড়ি চলছে। অর্থ্যাৎ প্রতিযোগিতার কারণ বজায় রেখে রাস্তায় গাড়ি নামনো হচ্ছে। পরিবহন সেক্টরে নিয়ম-শৃংখলা প্রতিষ্ঠায় সরকারকে কার্যকর ও ফলপ্রসূ উদ্যোগ নিতে হবে।
শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ছিল সুশৃংখল ও তাদের আচরণ ছিল নিরপেক্ষ। নিরাপদ সড়ক প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে তারা যেমন মন্ত্রী, এম.পি, নেতা, আমলা পুলিশসহ সকল শ্রেণি পেশার মানুষকে নিয়ম মানতে বাধ্য করেছিল, তেমনি ট্রাফিক পুলিশের দায়িত্ব হলো পদ-পদবী, ক্ষমতাবান, ক্ষমতাহীন বিবেচনা না করে সকলকে আইন মানতে বাধ্য করা। তাদের আন্দোলনের সময় দেখা গেছে, ক্ষমতাবানদের কাগজপত্রে ঘাটতি বেশি। এ ধারা অব্যাহত রাখতে হবে। আইনের চোখে সবাই সমান এই বোধ জাগাতে ও মানতে বাধ্য করতে হবে। ক্ষমতাবানরা উল্টোপথে গাড়ি চালান যা দুর্ঘটনার একটি কারণ বটে। এটি চিরতরে বন্ধ করতে হবে। জরুরি যানবাহন যেমন অ্যাম্বুলেন্স, ফায়ার ব্রিগেডের গাড়ি চলাচলে বিশেষ সুযোগ দিতে হবে।
বিআরটিএ সম্পর্কে মানুষের ধারণা ভালো না। এ প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে অসংখ্য অভিযোগ শোনা যায়। টাকার বিনিময়ে লাইসেন্স দেওয়ার অভিযোগগুলো অনেক পুরোনো। অশিক্ষিত ড্রাইভারদের লাইসেন্স দেওয়া মানে তাদেরকে মানুষ মারার লাইসেন্স দেওয়া। বাস, লরী বা ট্রাক ড্রাইভারদের শিক্ষাগত যোগ্যতার সাথে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ জরুরি। প্রশিক্ষণবিহীন ড্রাইভার অথবা ড্রাইভারের বদলে হেলপার-কন্ট্রাকটর দিয়ে গাড়ি চালানো বিপদজনক। মানুষের জীবন একটি। এ জীবন যেমন সকলের কাছে প্রিয় তেমনি এ জীবন রক্ষা করতে সকলে সচেষ্ট। রাস্তায় দুর্ঘটনা প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় ও আবশ্যকীয় যেকোন পদক্ষেপ কর্তৃপক্ষ গ্রহণ করলে দেশবাসী অকুণ্ঠ চিত্তে সমর্থন দেবে। বিআরটিএ কর্তৃপক্ষকে অত্যন্ত সাবধানী পদক্ষেপ নিতে হবে। তাদের প্রতি যে দোষারোপের সংস্কৃতি চালু রয়ে গেছে তাকে মিথ্যা প্রমাণ করার দায়িত্ব কর্তৃপক্ষের ওপরই বর্তায়। শোনা যায়, টাকার বিনিময়ে লক্কড় ঝক্কড় মার্কা গাড়িকে ফিটনেস সার্টিফিকেট দেওয়া হয় যার প্রমাণ রাস্তায় ওরকম অনেক গাড়ি চলাচল করছে।
পরিবহন সেক্টরে দীর্ঘদিন ধরে নানা সমস্যা ও সংকট রয়েছে যার মধ্যে অদক্ষতা, অব্যবস্থাপনা, দোষীদের শাস্তি না পাওয়া, সীমাহীন দুর্নীতি, ব্যাপক চাঁদাবাজি, মনিটরিং-এর প্রচন্ড অভাব, আইন সকলের উপর সমভাবে প্রয়োগ না হওয়া প্রভৃতি কারণে দুর্ঘটনা কমছে না, বরং বেড়েই চলেছে। গরু ছাগল চেনা ড্রাইভারদের ট্রাফিক আইন সম্পর্কে অজ্ঞতা, উপযুক্ত প্রশিক্ষণের অভাব, যানবাহন ত্রæটিযুক্ত হওয়া, গাড়ি চালাতে গিয়ে গল্প-গুজব ও মোবাইল ফোন ব্যবহার, অতিরিক্ত যাত্রী ও মাল পরিহন করা, চালকদের নেশাগ্রস্থ অবস্থা প্রভৃতি প্রতিদিন বহু মানুষের মৃত্যুর জন্য দায়ী। গবেষণা সংস্থা সি.আই.পি.আর.বি এর তথ্যমতে গড় দুই বছরে মৃত্যু ২৩,০০০ (তেইশ হাজার) এর বেশি। আহত ৩৪,৯,৩০০ জন, ৮০,০০০ হাজার চিরতরে পঙ্গু। সেতুমন্ত্রী ১০ জুলাই সংসদে বলেন, ৩০ জুন পর্যন্ত রেজিস্ট্রেশন প্রাপ্ত গাড়ির সংখ্যা ৩৪,৯৮,০০০ ত¤œধ্যে ২২,০০০০০ মোটর সাইকেল। ড্রাইভিং লইসেন্স প্রাপ্ত ড্রাইভার ১৮ লাখ। প্রচুর সংখ্যক ড্রাইভার, হেলপার ও কন্ট্রাকটর রয়েছেন যাদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ ও ড্রাইভিং লাইসেন্স নাই। অনেক হেলপার ও শিশু ড্রাইভার গাড়ি চালায়। এদের অদক্ষতা ও প্রশিক্ষণের অভাবে পরিবহন সেক্টরে বহুদিন ধরে অব্যবস্থাপনা, অনিয়ম, বিশৃংখলা চলছে। এসব মেরামত করার দায়িত্ব নিয়েছিল আমাদের কোমলমতি ছাত্র ছাত্রীরা। তাদের দাবি দাওয়ার যৌক্তিকতা, আবশ্যকতা ও উদ্দেশ্য বিবেচনায় নিয়ে সকলকে এগিয়ে আসতে হবে।
কোমলমতি ছাত্র-ছাত্রীরা ক্লাশে ফিরে গেলেও আন্দোলনের ফলাফল আশানুরূপ মনে হচ্ছে না। আন্দোলনকারীদের অনেককে ধরা হয়েছে, অনেককে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ানো হচ্ছে, অথচ হেলমেটধারীদের কাউকে আইনের আওতায় আনার কথা শোনা যাচ্ছে না। তারা ছাত্রদের ও সাংবাদিকদের পিটিয়ে যখম করেছে। এ হামলার প্রতিবাদে জাতিসংঘ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বিবৃতি দিয়ে বলেছে শিশুদের আন্দোলনকে বর্বরোচিতভাবে দমন করা হয়েছে। নাগরিক সমাজ ৬ আগস্ট প্রেসক্লাবে সমাবেশ করেছে। গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন ঐ সমাবেশে বলেন, দেশে অসুস্থ শাসন ব্যবস্থা চলছে। শিক্ষার্থীদের আন্দোলন দমনে গুন্ডা লেলিয়ে দেওয়া হয়েছে। দেশে গণতন্ত্র নাই, আছে গুন্ডাতন্ত্র। ছেলেমেয়েদের সকল দাবি মেনে নেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হলেও বাস্তবে তার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে খুবই কম। দেশে আইন আছে। নতুন সড়ক আইনের খসড়া মন্ত্রীসভায় অনুমোদিত হয়েছে। শাস্তির মেয়াদ ৫ বছর করা হয়েছে যা অনেকের মতে যথাযথ হয়নি। মৃত্যুর বিধান রাখা হলেও তা প্রমাণ করা খুব কঠিন। আমরা সড়ক আইন যথাযথ পর্যালোচনাপূর্বক পরিশুদ্ধ করে সংসদে পাশ করার অনুরোধ করছি। শুধু আইন করলেই হবে না আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা আন্দোলন করে যে পথ ও পদ্ধতি প্রদর্শন করেছে তা যেন কোন স্বার্থান্বেষী মহল নস্যাত না করতে পারে। পরিবহন সেক্টরে আরও সজাগ ও সতর্ক হয়ে যথাযথ তদারকীর ব্যবস্থা করতে হবে। রাস্তায় চলাচলকারী দানবগুলো যেন নির্বিচারে মানুষ হত্যা না করতে পারে, তার জন্য একটি সুন্দর ও গ্রহণযোগ্য সিস্টেম গড়ে তুলতে হবে। শিশু-কিশোরদের আন্দোলনের মর্মকথা ইচ্ছাকৃতভাবে রাস্তায় মানুষ খুন করা চলবে না। বেপরোয়া গাড়ি চালকরা যেন কারও উপর গাড়ি তুলে না দেয়, গাড়ি তুলে দিয়ে মানুষ হত্যা করে যেন নদীতে ফেলে না দেয়, এরকম অপকর্মগুলো চিরতরে বন্ধ হোক এরকম ব্যবস্থা গড়ে তোলা কাম্য।
লেখক: প্রফেসর, দর্শন বিভাগ ও সাবেক ডিন, কলা অনুষদ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন