গত এক সপ্তাহেরও বেশিদিন ধরে চট্টগ্রামে গ্রীষ্মকালের মতোই কড়া সূর্যের তেজে ঝলমলে রোদ। হঠাৎ মাঝেমধ্যে হালকা বৃষ্টি হলেও তা সাময়িক। তবুও পানিতে ভাসছে বন্দরনগরীর ‘নাভি’ আগ্রাবাদ এবং সওদাগরী পাড়া খ্যাত খাতুনগঞ্জ-আছদগঞ্জ। বর্ষণ না হলেও প্রতিদিনই সামুদ্রিক জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হচ্ছে বন্দরগরীর আগ্রাবাদ আর খাতুনগঞ্জ। সেই সাথে ভাসছে হালিশহর, গোসাইল ডাঙ্গাসহ আশপাশের বিস্তীর্ণ এলাকা। নিয়মিত জোয়ার-ভাটার রুটিন মেনেই চলাফেরা করতে হচ্ছে সেসব এলাকার লাখো মানুষকে। এতে করে গৃহবন্দী অবস্থায় অগণিত মানুষের কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। জন্ডিসসহ দূষিত পানিবাহিত বিভিন্ন রোগ-ব্যাধির প্রকোপ ও নানামুখী জনদুর্ভোগের সীমা নেই।
গতকালও (বুধবার) আগ্রাবাদ-হালিশহর এবং খাতুনগঞ্জ-আছদগঞ্জের বিভিন্ন এলাকা হাঁটু থেকে কোমর সমান পানিতে থৈ থৈ করে। বিকেলের জোয়ারের সময় আগ্রাবাদের সিডিএ আবাসিক এলাকা ও কয়েকটি স্থানে কোমর সমান পানি ভেঙে অথবা রিকশায় ও ভ্যানে করে লোকজনকে চলাচল করতে দেখা গেছে। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, অনেকেই জোয়ারের সময়জুড়ে বাধ্য হয়ে ঘরে বসে থাকেন। অপেক্ষা করেন কখন জোয়ার শেষ হবে, কখন ভাটার সময় পানি হ্রাস পাবে। পানি নামতে শুরু করলে বিভিন্ন স্থানে কর্মমুখী মানুষের রীতিমতো হুড়োহুড়ি পড়ে যায়।
বন্দরনগরীর প্রধান বাণিজ্যিক এলাকা আগ্রাবাদ এবং ‘সওদাগরী পাড়া’ চাক্তাই খাতুনগঞ্জ, আছদগঞ্জ বঙ্গোপসাগরের উপকূলভাগে লাগোয়া হয়। তা সত্তে¡ও এখন নিয়মিত জোয়ারের কবলে পড়েছে। এ কারণে আমদানি-রফতানি-শিপিং কার্যক্রম, ব্যবসা-বাণিজ্য, ব্যাংক-বীমাসহ আর্থিক প্রতিষ্ঠান, কাস্টমস, করসহ সরকারি-বেসরকারি অফিস পাড়া, মসজিদ, হাসপাতাল-ক্লিনিক, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মার্কেট, শো-রুম, গার্মেন্টস কারখানা, গুদাম, আড়ত, আবাসিক এলাকা, রাস্তাঘাট সড়ক মাঠসহ সবকিছু প্রতিদিনের জোয়ারে দু’বার করে প্লাবিত হচ্ছে। বর্ষণ হোক বা না হোক আগ্রাবাদ, হালিশহর, খাতুনগঞ্জ-আছদগঞ্জসহ বিস্তীর্ণ এলাকার মানুষের জন্য এটি পরিণত হয়েছে ‘দুঃখের বার মাইস্যা’। এই দুঃখের যেন শেষ নেই। বরং বছর বছর বাড়ছে ভোগান্তি।
জোয়ারের দুর্ভোগ দিয়েই শেষ নয়। জোয়ারের সময় আটকে থাকা পানির সাথে নালা-নর্দমা ও ডাস্টবিনের গলিত ময়লা-আবর্জনায় অবর্ণনীয় কষ্টে অতিষ্ঠ এলাকাবাসী। ছড়িয়ে পড়েছে বিভিন্ন রোগ-ব্যাধি। এ বছরে আগ্রাবাদ-হালিশহরে প্রায় ঘরে ঘরে জন্ডিসের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। এর রেশ এখনো চলছে। যার অন্যতম কারণ হিসেবে বৃষ্টি ও জোয়ারের পর আটকে থাকা দূষিত পুঁতিগন্ধময় পানিকেই চিহ্নিত করেন তদন্তকারী বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকগণ। আগ্রাবাদে মা ও শিশু মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিচতলা প্লাবিত হচ্ছে প্রতিদিন দুই দফায় জোয়ারের পানিতে। তাছাড়া ব্যবসা-বাণিজ্যে কোটি কোটি টাকার লোকসান গুণতে হচ্ছে। অনেকে অন্যত্র ব্যবসা ও আবাসস্থল গুটিয়ে চলে গেছেন।
আগ্রাবাদ-হালিশহরে গত ৪-৫ বছর যাবত জোয়ারে পানিবদ্ধতার সমস্যা ক্রমেই বেড়ে গেছে। শত বছরের ঐতিহ্যবাহী দেশের প্রধান পাইকারি ও ইন্ডেন্টিং বাজার খাতুনগঞ্জ-আছদগঞ্জে জোয়ারের পানিতে গুদাম-আড়তগুলোতে ভিজে বিনষ্ট হচ্ছে বিপুল অংকের আমদানিকৃত এবং রফতানিমুখী নিত্য ও ভোগ্যপণ্য। অথচ চট্টগ্রামে মূলত ‘নাগরিক সেবা দানকারী’ সংস্থা চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) এর কোনো সমাধানে পৌঁছাতে পারছে না। বরং অপরিকল্পিত ও ব্যক্তির খেয়ালখুশি মাফিক ‘উন্নয়নে’র খেসারত দিতে বাধ্য হচ্ছে নগরবাসী।
নগর বিশেষজ্ঞগণ বলছেন, এডহক ভিত্তিতে কিংবা জোড়াতালি সমাধানের চেষ্টায় কোনো সুফল আশা করা যাবেনা। সিডিএ, সিটি কর্পোরেশন, ওয়াসা, পানি উন্নয়ন বোর্ডসহ নাগরিক সেবায় দায়বদ্ধ সব সংস্থা, বিভাগ এবং বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে স্থায়ী সমাধানের পথ বের করতে হবে। এই লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞমহল এবং চট্টগ্রামবাসীর দীর্ঘদিনের দাবি পূরণের মাধ্যমে চট্টগ্রাম শহর রক্ষা বাঁধ নির্মাণের কোনো বিকল্প নেই।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন