মুফতি জাবের কাসেমী
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
কানপুরবাসীর ওপর হযরত মুফতি সাহেব (রহ.)-এর তাকওয়া, পরহেজগারী বিশেষভাবে প্রভাব বিস্তার করেছিলেন। জামেউল উলুম কানপুর হযরত মুফতি সাহেব (রহ.)-এর ফয়েজ ও বরকত লাভে ধন্য হতে চেয়েছিল। কিন্তু ১৩৮৫ হিজরিতে হযরত মুফতি সাহেব (রহ.) দারুল উলুম দেওবন্দে প্রধান মুফতি হিসেবে চলে আসার ফলে কানপুরবাসী সরাসরি হযরত মুফতি সাহেব (রহ.) থেকে বরকত হাসেল করার সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত হন। দারুল উলুম দেওবন্দে হযরত মুফতি সাহেব (রহ.) ফাতোয়া দানের কাজ ছাড়াও দীর্ঘদিন পর্যন্ত বুখারি শরিফের দরস প্রদান করেন। এসব খেদমতের বিনিময়ে তিনি যে বেতন পেতেন, তা কখনো গ্রহণ করেতেন না; বরং এর সাথে আরো কিছু মিলিয়ে তিনি তা মাদরাসায় দান করে দিতেন। ১৩৮৬ হিজরিতে তাকে মাজাহিরুল উলুমের পৃষ্ঠপোষক নির্বাচন করা হয়।
বাইআত ও খেলাফত লাভ : হযরত মুফতি সাহেব (রহ.) হযরত শায়খুল হাদিস মাওলানা মুহাম্মাদ যাকারিয়া কান্ধলভী (রহ.)-এর উল্লেখযোগ্য খলিফাদের একজন ছিলেন। নিজের বাইআতের ঘটনা তিনি নিজেই শুনিয়েছেন। সংক্ষিপ্তভাবে ঘটনাটি হলো, হযরত (রহ.) বলেনÑ আমার বাইআতের ঘটনাটি ছিল ১৩৪৯ হিজরিতে। তখন আমি দেওবন্দে পড়তাম। আর আমি যখনই হযরত রায়পুরী (রহ.) এবং হযরত দেহলভী (রহ.)-এর খেদমতে উপস্থিত হতাম তখন আখেরাতের প্রতি আগ্রহ খুব বেশি হতো। আর দুনিয়ার প্রতি অনাগ্রহ বেড়ে যেত। আর যখন হযরত শায়খ (রহ.)-এর নিকট যেতাম, তখন স্বীয় গুনাহ এবং দোষগুলো সামনে চলে আসত। আমি মনে করতাম আমার সংশোধন তার দ্বারাই হবে। হযরত শায়খ (রহ.)কে প্রাধান্য দেওয়ার দ্বিতীয় কারণ হলো, বয়সের বিবেচনায় হযরত শায়খ তাদের থেকে ছোট ছিলেন, যার দরুন বেশ কিছু সময় হযরতের খেদমতে কাটানোর সুযোগ হয়ে যাবে। অতঃপর আমি শায়খের নিকট বাইআত হওয়ার দরখাস্ত করলাম। তখন তিনি হযরত মাদানী (রহ.)-এর নিকট আমাকে বাইআত হওয়ার পরামর্শ দিয়ে বললেন, ইস্তেখারা করে নাও, অথবা নিযামুদ্দিন রায়পুর ও থানাভবন সফর কর এবং তিনজনের মজলিসে চুপিসারে বসো, অতঃপর সিদ্ধান্ত গ্রহণ কর। হযরত মুফতি সাহেব (রহ.) বলেনÑ আমি কোথাও যাইনি। তখন হযরত শায়খ (রহ.) আমাকে বাইআত করে নিলেন। বাইআতের পূর্বে কছদুস সাবীল দেখে জিকির শুরু করেছিলেন। বাইআত হওয়ার পরে হযরত শায়খ (রহ.) জিকির ছাড়িয়ে দিয়ে তাসবিহাত বাতলে দিলেন। অতঃপর যখন জোরে জিকির শুরু করলাম, তখন তাতে উত্তাপ ছড়িয়ে গেল। বেশ কিছু দিন পর উত্তাপ শেষ হলে জিকির ছেড়ে দিলাম। এভাবে দীর্ঘ দিন রিয়াযত ও মোজাহাদার পর খেলাফত লাভ করেন।
বাংলাদেশ সফর : এই মহান আধ্যাত্মিক পুরুষ তার পূর্বসূরিদের ন্যায় ইলমী খেদমতের পাশাপাশি তাযকিয়া ও ইহসানের ক্ষেত্রেও অসামান্য অবদান রাখেন। তিনি বার্ধক্যজনিত অসুস্থতার পরও বয়সের ভারে ন্যুব্জ শরীর নিয়ে দেশ-দেশান্তরে সফর করে দিশাহারা মানুষকে হেদায়েতের পথ দেখাতেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে তিনি তার অসংখ্য ভক্ত ও শাগরিদদের অনুরোধে ৪ বার বাংলাদেশে আগমন করেন এবং হাজারো দিশাহারা মানুষকে হেদায়েতের পথ দেখান। বিগত ১৯৯৬ সালে পবিত্র মাহে রমজানে বাংলাদেশে তার সর্বশেষ সফর হয়েছিল। তখন তিনি ঢাকার মালিবাগ মাদরাসার জামে মসজিদে এক মাসব্যাপী কয়েক হাজার দেশি ও বিদেশি ভক্ত ও মুরিদদেরকে সাথে নিয়ে জিকির, তালকীন ও এতেকাফ করেন। এতে বাংলাদেশ ছাড়াও আমেরিকা, আফ্রিকা, ইংল্যান্ড, সৌদি আরব, আরব আমিরাত, পাকিস্তান ও ভারতসহ বহু দেশের লোক সমবেত হন। এক মাসব্যাপী জিকির, তালকীন ও এতেকাফের এরকম মনোমুগ্ধকর দৃশ্য এতদঞ্চলে কেবল অভূতপূর্বই ছিল না; বরং ভবিষ্যতের জন্যও এক নজিরবিহীন আবেদনময় কর্ম হিসেবে তা সব দর্শক ও অংশগ্রহণকারীর হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছে। তার পীর হযরত শায়খ যাকারিয়া (রহ.)-এর সান্নিধ্যেও প্রতি রমজান মাসে এরূপ দৃশ্যের অবতারণা হতো। হযরত শায়খ (রহ.)-এর ইন্তেকালের পর ১৪০২ হিজরি থেকে ১৪১৫ হিজরি পর্যন্ত তিনি আফ্রিকা ও ভারতের বিভিন্ন স্থানে এমনিভাবে জিকির, তালকীন ও এতেকাফের মাধ্যমে এক রূহানী পবিবেশে পবিত্র রমজান মাসগুলো অতিবাহিত করেন। ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, ইংল্যান্ড, আমেরিকা ও আফ্রিকার যে অগণিত ও অসংখ্য ভক্ত হেদায়েতের দিশা পাওয়ার জন্য তার নিকট বাইআত হয়েছিলেন, তাদের অনেককে তিনি এজাজত ও খেলাফত দানে ধন্য করে গেছেন।
অবদান : তালিম ও তাযাকিয়ার ক্ষেত্রে তার অসামান্য অবদান ছাড়াও বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান ও দক্ষিণ আফ্রিকাসহ বহু দেশে তার নিসবতে, পরামর্শে ও ইঙ্গিতে বহু দীনি মাদরাসা ও খানকাহ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আমাদের জানা মতে বাংলাদেশের ঢাকার নবাবগঞ্জ থানার টিকরপুরে আল-জামিয়াতুল মাহমুদিয়া টিকরপুর মাদরাসাটির ভিত্তিপ্রস্তর নিজের হাতে স্থাপন করা একমাত্র প্রতিষ্ঠান। তাছাড়া বাংলাদেশের ৬টি দ্বীনি মাদরাসা এবং মালিবাগ জামিয়া ও জামিয়া মাদানিয়া বারিধারার প্রধান দুটি খানকাহও তার নেসবতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
ফতোয়ার খেদমত ও রচনা : উলামায়ে কেরাম এ কথা ভালোভাবেই জানেন যে, শরিয়তের বিধিবিধান সম্পর্কে ফতোয়া লেখা কত জটিল ও কঠিন ব্যাপার। একজন অভিজ্ঞ মুফতি হতে হলে হাদিস, তাফসির, ফেকাহ উসুলে ফিকাহ ইলমে কালাম প্রভৃতি বিষয়ে পরিপূর্ণ জ্ঞান রাখার পাশাপাশি শরিয়তের বিধানাবলীর মৌলিক বিষয়াদির ব্যাপারেও পারদর্শী হতে হয়। তাছাড়া এক্ষেত্রে প্রচুর পরিমাণে মেধা, ইজতেহাদ ও গবেষণা করার মতো ইলমী গভীরতা, সাধারণ মানুষের চালচলন ও অভ্যাস সম্পর্কে অবগতি, লোভ-লালসা, মাখলুকের প্রভাব ও রিয়ামুক্ত অন্তর প্রভৃতির বিশেষ প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। উল্লিখিত গুণসমূহের প্রকৃত ধারক ও বাহক ছিলেন হযরত (রহ.)। মাজাহিরুল উলুম সাহারানপুর, জামেউল উলুম কানপুর ও দারুল উলুম দেওবন্দে মুফতি থাকাকালীন এ দীর্ঘ খেদমতের জীবনে মানুষের ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক অঙ্গনে সংঘটিত হাজার হাজার সমস্যার যে ইসলামী আইনগত সমাধান তিনি লিখিতভাবে দিয়ে গেছেন, সেগুলো বর্তমানে ফতোয়ায়ে মাহমুদিয়া নামে ৩০ খ-ে প্রকাশিত হয়েছে। এ ছাড়াও দিশাহারা মানুষকে আল্লাহর পথে আনার জন্য ওয়াজ, তালকীন ও উপদেশের মাধ্যমে তিনি যে খেদমত আঞ্জাম দিয়ে গেছেন, সেগুলোরও অধিকাংশ সংকলিত ও প্রকাশিত হয়েছে। ইতিমধ্যে তার মাওয়ায়েযের ৯টি সংখ্যা ও মালফুজাতের ৯টি সংখ্যাও প্রকাশিত হয়েছে। কাব্য রচনার ক্ষেত্রেও তার স্বভাবজাত প্রতিভা ছিল। তার উর্দু ও ফারসি ভাষায় রচিত কবিতাবলীর একটি সংকলনও কালামে মাহমুদ নামে প্রকাশিত হয়েছে।
মৃত্যু : ইসলামী জ্ঞান ও আধ্যাত্মিক জগতের এ কিংবদন্তি পুরুষ জীবনের শেষ প্রান্তে এসে দাওয়াত ও হেদায়েতের খেদমত থেকে বিরত হননি। অন্যের সাহায্য ছাড়া চলাফেরা করতে অক্ষম হওয়া সত্ত্বেও তিনি দীনের দাওয়াত নিয়ে এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা ও আমেরিকার বহু দেশে ঘুরে বেড়িয়েছেন। ইন্তেকালের পূর্বেও ভক্ত ও অনুরক্তদের অনুরোধ উপেক্ষা করতে না পেরে তিনি দক্ষিণ আফ্রিকা সফর করেন। সেখানেই তিনি ১৯৯৬ খ্রিস্টাব্দের ২ সেপ্টেম্বর, সোমবার, রাত ১১টা ৩০ মিনিটে ইহলোক ত্যাগ করে আল্লাহর সান্নিধ্যে মিলিত হন। হযরতের জানাজার নামাজের ইমামতি করেন বর্তমান দারুল উলুম দেওবন্দের মুহতামিম মুফতি আবুল কাসেম বানারসী সাহেব দা. বা.।
দাফন : সকাল সাড়ে ৯টায় তার লাশ জানাজা ঘর থেকে বের করা হয়। ইলসবার্গের কবরস্থানে তার লাশ দাফন করা হয়। এত বড় জানাজা দক্ষিণ আফ্রিকাতে খুব কমই দেখা যায়। আল্লাহতায়ালা হযরতের কবরকে নূর দ্বারা ভরপুর করে দেন। আমিন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন