ক্ষত-বিক্ষত সড়ক রাস্তাঘাট অলিগলি। সরকারি একেক সংস্থা একেক সময় খুঁড়ছে সড়কগুলো। পাহাড়-টিলা কেটে সাবাড় করা হচ্ছে। নগরীর পানি নিষ্কাশনের প্রাণপ্রবাহ খাল ছরা নালা-নর্দমা বেশিরভাগই দখলদারদের পেটে। বৃষ্টি আর জোয়ার হলেই কোমর সমান পানির নিচে তলিয়ে যাচ্ছে বিশাল এলাকা। ফ্লাইওভার আছে অথচ যানবাহন চলাচল প্রায় শূন্য্য। নিচে সড়কে দিনে-রাতে যানজট। উঁচু উঁচু ভবন তৈরি হচ্ছে নগরজুড়ে রাতারাতি। কিন্তু সুনির্দিষ্ট নকসা-প্ল্যান ও ইমারত নির্মাণ আইনের কোনো তোয়াক্কা নেই। আবাসিক এলাকায় গড়ে উঠেছে কল-কারখানা, ব্যবসা-বাণিজ্যকেন্দ্র, স্কুল, কোচিং সেন্টার, হাট-বাজার, আড়ত-গুদাম আর মোটর গ্যারেজ। বাস টার্মিনাল থাকলেও মানুষের দাঁড়ানোর মতো অবস্থা নেই। সড়ক রাস্তাঘাটসহ ফুটপাত বেদখল হয়ে গেছে, সেখানে অবাধে চলছে চাঁদাবাজি। গণপরিবহন অপ্রতুল। কর্মমুখী লাখ লাখ মানুষের প্রতিদিন রাস্তায় সময় অপচয় এবং সীমাহীন দুর্ভোগ।
ওই খন্ডচিত্র দেশের বাণিজ্যিক রাজধানী খ্যাত বন্দরনগরী চট্টগ্রামের। একদা চট্টগ্রামবাসীকে ‘উন্নয়নের’ আশ্বাসবাণী শোনাতে গিয়ে বলা হতো, চট্টগ্রাম সিঙ্গাপুরে পরিণত হবে! গত কয়েক বছর ধরে চট্টগ্রামের সাধারণ মানুষের মুখে মুখে বহুল উচ্চারিত হতাশার সুর হচ্ছে- ‘পানির নিচে মুরাদপুর, কেমনে হবে সিঙ্গাপুর?’ শুধুই মুরাদপুর নয়, বৃষ্টি হোক বা না হোক কর্ণফুলী নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে সমুদ্রের নিয়মিত জোয়ার-ভাটার পানিতে এখন ডুবভাসি করছে মহানগরীর আগ্রবাদ, হালিশহর, কাট্টলী, বাকলিয়া, চান্দগাঁও, চকবাজার, খাতুনগঞ্জসহ আরও বিশাল এলাকা। তাছাড়া বড় বড় গর্তে নগরীর অনেক সড়কে যানবাহন চলাচল দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে। বিক্ষুব্ধ এলাকাবাসী সংশ্লিষ্ট নাগরিক সেবা দানকারী সরকারি-স্বায়ত্তশাসিত বিভাগ, সংস্থাগুলোর শীর্ষ কর্তাব্যক্তিদের কাছে বারবার আবেদন-নিবেদন করেও কোনো সমাধান তারা পাননি।
নগর পরিকল্পনাবিদগণ বলছেন, চট্টগ্রামের ‘উন্নয়ন’ হচ্ছে। তবে তা অপরিকল্পিত ও এলোপাতাড়ি। কোনো নিয়ম-নীতির যেন বালাই নেই। চট্টগ্রামে নাগরিক সেবায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দায়বদ্ধ ২১টি সরকারি আধা-সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা-বিভাগ রয়েছে। কিন্তু সংস্থাগুলোর কাজেকর্মে সমন্বয় এমনকি কোনোটির জবাবদিহিতার বালাই নেই। ভারসাম্যহীন ও বেসামাল ‘উন্নয়নের’ কারণে দিন দিন কষ্টের শহরে পরিণত হয়েছে চট্টগ্রাম। অপরিকল্পিত নগরায়নের কারণেই খেসারত দিতে হচ্ছে ৬০ লাখ চট্টগ্রাম নগরবাসীকে। রাজধানী ঢাকার মতো বন্দরনগরীও ক্রমেই বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠছে।
বন্দরনগরীসহ বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের নিজস্ব বেশ কিছু ভূ-প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে। চট্টগ্রামের প্রাকৃতিক সুরক্ষা ও ভারসাম্যের জন্য অপরিহার্য পাহাড়-টিলা, বন-জঙ্গল, নদ-নদী, হ্রদ, দীঘি, পুকুর, খেলার মাঠ, খোলা জায়গা এবং খাল-ছরা। বঙ্গোপসাগরের কোলে-কিনারে, পাহাড়ি খরস্রোতা কর্ণফুলী নদী, সারি সারি পাহাড়-টিলা আর সবুজ বনানী আর সমতলে প্রাচ্যের রাণী খ্যাত চট্টগ্রাম। অথচ লাগামহীন ‘উন্নয়নে’র নামে এসব বৈশিষ্ট্য ও অপরূপ নিসর্গ হারিয়ে যাচ্ছে। নির্বিচারে পাহাড় টিলা কেটে-খুঁড়ে ও জলাশয় ভরাট করে ভবন এবং সারি সারি বস্তি গড়ে উঠেছে। খাল-ছরা ও নালার উপর ঘরবাড়ি, মার্কেট, দোকান-পাট নির্মিত হয়েছে। মহানগর ও শহরতলীর ব্যাপক অংশেই হারিয়ে গেছে ভূ-প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যগুলো। অতীতের সাথে মিলিয়ে চট্টগ্রামকে চেনা যায়না। চাটগাঁর আদি পরিচিত রূপ-নিসর্গ বিলুপ্তির মুখে। এ অবস্থায় বেড়ে গেছে নানামুখী জনদুর্ভোগ।
বিশিষ্ট নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক এম আলী আশরাফ বলেন, চট্টগ্রামের পরিকল্পিত উন্নয়ন অপরিহার্য। এরজন্য মাস্টার প্ল্যান অনুসরণ এবং সকল সংস্থা ও বিভাগের সমন্বয়ে করে নাগরিক সেবা নিশ্চিত করতে হবে। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) উদ্যোগে ১৯৯৫ সালে আরবান, ট্রান্সপোর্ট ও ড্রেনেজ- এই তিনটি নাগরিক চাহিদার সমন্বয়ে প্রণীত মাস্টার প্ল্যান এবং ২০০৮ সালের ডিটেইল এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ) অনুসরণ করা প্রয়োজন। অথচ চট্টগ্রামের সার্বিক উন্নয়ন কর্মকান্ড এসব পরিকল্পনা অনুযায়ী পরিচালিত হচ্ছে না। তিনি বলেন, জাতীয় অর্থনীতিতে চট্টগ্রাম আরও ব্যাপক অবদান রাখার সুযোগ-সম্ভাবনা রয়েছে এবং সেগুলোর সদ্ব্যবহার করতে হবে।
সিডিএ-ইউএনডিপি’র জরিপ ও সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম চট্টগ্রাম মহানগরীতে প্রায় ১০ শতাংশ হারে লোকসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রতিবছর যুক্ত হচ্ছে অন্তত ৫০ হাজার নাগরিক। তাদের জন্য প্রয়োজন ১২ হাজার ইউনিট অতিরিক্ত ফ্ল্যাট বা বসতঘর। তাছাড়া দোকানপাট, ব্যবসা-বাণিজ্যকেন্দ্র, অফিসসহ কর্মক্ষেত্রের মতো হরেক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা প্রয়োজন। ৯০ থেকে ১২০ হেক্টর ভূমিতে আবাসন ব্যবস্থার চাহিদা তৈরি হচ্ছে। প্রধান সমুদ্র বন্দর ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্প-কারখানাকে চট্টগ্রাম নগরীতে দেশের নানা প্রান্ত থেকে জনস্রোত প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে সেই তুলনায় নেই পরিকল্পিত আবাসন। বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস, সড়ক, পার্ক-বিনোদন, স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় মাদরাসাসহ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, পানি ও পয়ঃবর্জ্য নিষ্কাশন ব্যবস্থা, গণপরিবহনসহ ন্যুনতম অপরিহার্য নাগরিক সুযোগ-সুবিধাগুলো চাহিদার তুলনায় সঙ্কুচিত হয়ে পড়ছে। কর্মসংস্থানের সুযোগ কমে যাচ্ছে। শিল্পায়ন বিনিয়োগের জন্য শহরের বাইরে শহরতলীতে অবকাঠামো সুবিধাসহ শিল্প পল্লী স্থাপন করা প্রয়োজন।
ব্রিটিশ শাসনামলের মাঝামাঝি এদেশের অন্যতম প্রাচীন পৌর শহর হিসেবে ১৮৬৩ সালের ২২ জুন ‘দি চিটাগাং মিউনিসিপ্যালটি’র সূচনা হয়। তখন মাত্র ৬ বর্গমাইল আয়তনের ৫টি ওয়ার্ড নিয়ে শহরটি প্রাতিষ্ঠানিক যাত্রা করে। ১৮৬৯ সালের আদম শুমারিতে চট্টগ্রাম শহরে জনসংখ্যা ছিল ১৫ হাজার ৫৯৮ জন। এখন ৪১টি ওয়ার্ড নিয়ে জনসংখ্যা ৬০ লাখ ছাড়িয়ে গেছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন