সূর্য এক ঘণ্টায় পৃথিবীতে যে পরিমাণ শক্তি দেয়, তা থেকে সারা বিশ্বের সব মানুষের সারা বছরের বিদ্যুৎ চাহিদা মেটানো সম্ভব। বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে জানিয়েছেন এ তথ্য। এরই মধ্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সূর্যের আলো থেকে ব্যাপক হারে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে। আমাদের সরকারও সৌরবিদ্যুতের ব্যবহার বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে। এ জন্য উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণী, বিশেষ করে বাড়ি ও শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিকদের সৌরবিদ্যুৎ প্যানেল স্থাপনে উৎসাহিত করা হচ্ছে। প্রয়োজনে আইন করে সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা যায় কি না, তাও ভাবা হচ্ছে।
বাংলাদেশে যথেষ্ট পরিমাণ বিদ্যুৎ ঘাটতি রয়েছে। দেশের শহরাঞ্চলের বহুতল ভবনগুলোতে সৌরবিদ্যুৎ প্যানেল বসানো গেলে বিদ্যুৎ ঘাটতি কিছুটা হলেও কমে আসবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
জামালপুরের সরিষাবাড়ীর সিমলা বাজার এলাকায় আট একর জায়গাজুড়ে সারি সারি সোলার প্যানেল বসানো হয়েছে। এটি দেশের প্রথম সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র। সরিষাবাড়ীর কেন্দ্রটি স্থাপনে ব্যয় হয়েছে প্রায় ৫৪ কোটি ২২ লাখ টাকা। বিনিয়োগকারীদের ঋণ দিয়েছে জার্মানির একেএ ব্যাংক। ৩ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করছে ‘এনগ্রিন সরিষাবাড়ী সোলার প্ল্যান্ট লিমিটেড’ নামের এই কেন্দ্রটি। সরিষাবাড়ীর এই ব্যতিক্রমী সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্রটি স্থাপনে সরকারি এবং দেশি-বিদেশি বেসরকারি খাতের মধ্যে এক অনন্য সহযোগিতার মেলবন্ধন গড়ে উঠেছে। কেন্দ্রটির জন্য জায়গা দিয়েছে সরকারি খাতের বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। আর বিনিয়োগ করেছে বেসরকারি খাত। বিনিয়োগকারীদের মধ্যে রয়েছে জার্মানির আইএফই এরিকসেন এজি এবং দেশের কোম্পানি কনকর্ড প্রগতি কনসোর্টিয়াম লিমিটেড ও জুপিটার এনার্জি লিমিটেড। এই তিন প্রতিষ্ঠান মিলে গঠন করেছে যৌথ বিনিয়োগের কোম্পানি ‘আইএফই-সিপিসি-জেইএল কনসোর্টিয়াম’।
সরিষাবাড়ীতে পিডিবির ৩৩/১১ হাজার ভোল্টের যে বিতরণ উপকেন্দ্রটি রয়েছে, সেটিকে ঘিরে পিডিবির মালিকানাধীন আট একর জায়গা পড়ে ছিল। সৌরবিদ্যুতের প্যানেল বসাতে কাজে লাগানো হয়েছে সেই অব্যবহৃত জমি। কাছাকাছি দিয়ে গেছে ৩৩ হাজার ভোল্টের লাইন। এই কেন্দ্রের ৩ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ওই সরবরাহ লাইন দিয়ে জাতীয় গ্রিডে প্রবেশ করছে। কেন্দ্রটি থেকে সরকার তথা পিডিবি প্রতি ইউনিট (১ কিলোওয়াট ঘণ্টা) বিদ্যুৎ কিনছে প্রায় ১৪ টাকা ৭৫ পয়সা দরে। সরকার তথা পিডিবি আগামী ২০ বছর কেন্দ্রটি থেকে এই দামে বিদ্যুৎ কিনবে।
বর্তমানে জ্বালানির দাম কম হওয়ায় ফার্নেস তেল, এলএনজি, কয়লা, ইউরেনিয়াম প্রভৃতি জ্বালানি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে ইউনিটপ্রতি ১০ টাকার বেশি খরচ হয় না। সেই হিসাবে সৌরবিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয় ও দাম এখনো অনেক বেশি। তবে পরিবেশ সুরক্ষা ও দীর্ঘমেয়াদে দাম কমে আসবে বলে সারা পৃথিবীর মতো বাংলাদেশেও এ ক্ষেত্রে জোর দেওয়া হচ্ছে। তা ছাড়া প্রযুক্তিগত উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যয় ক্রমেই কমে আসছে। সরকার তথা পিডিবি সর্বশেষ যে কেন্দ্রটি থেকে বিদ্যুৎ কেনার চুক্তি করেছে, সেটিতে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম পড়ছে ১২ টাকা ৮০ পয়সা। দেশীয় বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ইন্ট্রাকো সোলার পাওয়ার লিমিটেড রংপুরের গঙ্গাচড়ায় কেন্দ্রটি স্থাপন করছে। সরকারি প্রতিষ্ঠান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি লিমিটেড (ইডকল) এবং দেশের কয়েকটি বাণিজ্যিক ব্যাংক ৩০ মেগাওয়াট ক্ষমতার এই কেন্দ্র স্থাপনে অর্থায়ন করছে। সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী, ২০২০ সালের মধ্যে দেশের মোট উৎপাদিত বিদ্যুতের ১০ শতাংশ করা হবে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে। ২০২০ সালে দেশে মোট ২৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্য সরকারের। সেই হিসাবে ওই সময়ে ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে হবে নবায়নযোগ্য শক্তি থেকে।
সৌরবিদ্যুৎই আমাদের ভবিষ্যৎ। জ্বালানি খাতকে এদিকেই যেতে হবে। তবে বাংলাদেশে জমির স্বল্পতা থাকায় চেষ্টা করতে হবে সৌর প্যানেল যে জমিতে বসানো হচ্ছে, সেই জমি পতিত ফেলে না রেখে বিকল্প ব্যবহারের উপায় উদ্ভাবন করা। সারা বিশ্বে সৌরবিদ্যুতের প্রযুক্তি দ্রুত উন্নত হচ্ছে। প্যানেলগুলোর দক্ষতা (এফিশিয়েন্সি) বাড়ছে। ফলে অল্প জায়গা ব্যবহার করে বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা বাড়তেই থাকবে। সৌরবিদ্যুতের বড় সুবিধা হচ্ছে, এর প্রযুক্তি দ্রুত এগোচ্ছে। তা ছাড়া এই বিদ্যুৎ উৎপাদনের কাজ শুরু করে তা গ্রিডে নিতে এক বছরের বেশি লাগে না। ফলে বিশ্বব্যাপী সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনে অনেক দেশই এগিয়ে আসছে। বিশ্বব্যাপী কম জমি ব্যবহার করে বেশি সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য গবেষণা চলছে। বিদ্যুতের সীমাহীন দুর্ভোগ থেকে আমরা এক ধরনের শিক্ষা নিয়েছি। তাই নবায়নযোগ্য একটি টেকসই জ্বালানি সংস্কৃতি গড়ে তোলার কোনো বিকল্প নেই। সারা পৃথিবী এখন নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে যাচ্ছে। বাংলাদেশে সৌরশক্তিকে বিকল্প জ্বালানি হিসেবে অগ্রাধিকার দেওয়ার সিদ্ধান্ত দিয়েছে সরকার। শহরাঞ্চলে বাড়ি ও শিল্প মালিকদের ছাদে সৌর প্যানেল বসাতে বাধ্য করতে প্রয়োজনে আইন করতে হবে। শহরে সৌর প্যানেল বসানোর বিষয়টি বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোডে (বিএনবিসি) বাধ্যতামূলক করার কথা ভাবছে সরকার।
‘বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধানে সরকার তৎপর। এ ক্ষেত্রে সৌরবিদ্যুৎকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে প্রধানমন্ত্রী একাধিকবার শহরে বাড়ির মালিক ও শিল্পপতিদের নিজেদের ছাদে সৌরবিদ্যুৎ প্যানেল বসানোর আহ্বান জানিয়েছেন। সরকার যে বিকল্প বিদ্যুৎ হিসেবে সৌরবিদ্যুৎকে উৎসাহ দিতে চায় তার জ্বলন্ত উদাহরণ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে সৌর প্যানেল বসানো। বাংলাদেশ সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য সবচেয়ে বেশি সম্ভাবনার একটি দেশ। বিশ্বের বহু শীতপ্রধান দেশেও এরই মধ্যে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের বিপ্লব ঘটেছে। অথচ সে সব দেশে দিনে প্রতি বর্গমিটারে তিন কিলোওয়াট-ঘণ্টার বেশি সূর্যরশ্মি পড়ে না। সেখানে বাংলাদেশে এ মাত্রা দিনে গড়ে প্রতি বর্গমটারে ৪ দশমিক ২১ কিলোওয়াট-ঘণ্টা।
ব্যয়বহুল বলে অনেকেই সৌরবিদ্যুৎ ব্যবস্থা স্থাপন করতে চাইবে না। কিন্তু সরকারকে বোঝাতে হবে, দিনের বেলা সরাসরি সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহারে তেমন একটা খরচ পড়বে না। এ ব্যবস্থায় বেশি ব্যয় হয় রাতের জন্য বিদ্যুৎ সংরক্ষণ করতে গেলে। উৎপাদিত বিদ্যুতের প্রায় ৮০ ভাগ শহরের সচ্ছল মানুষ ব্যবহার করেন। এদিক থেকে তারাই বিদ্যুতে দেওয়া ভর্তুকির বড় সুবিধাভোগী। তাই শিল্প ও বাড়ির মালিকদের সৌরশক্তি ব্যবহারে এগিয়ে আসা উচিত।
প্রথম প্রথম সৌরবিদ্যুৎ অত্যন্ত ব্যয়বহুল ছিল। এক ওয়াট উৎপাদনেই ব্যয় হতো ৫০০ টাকা। সৌরবিদ্যুতের যন্ত্রপাতি নির্মাণে দেশে নিজস্ব উদ্যোগ যত বাড়বে, দাম তত কমে আসবে। তবে শুরুতে ভর্তুকি দিয়ে হলেও সৌরশক্তি ব্যবহার প্রচলন করা উচিত। কারণ, তেল-গ্যাস-কয়লার মতো প্রচলিত জ্বালানি দ্রæত ফুরিয়ে যাচ্ছে।
শহর এলাকায় গৃহস্থালির আলোর জন্য সৌরবিদ্যুতের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা গেলে পিক আওয়ারে বিদ্যুতের চাহিদার একটা অংশ কমে যাবে।
সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন নিয়ে গবেষণা করছে ইউকে সোলার প্যানেল সিস্টেম, ডেজার্ডটেক ও সোলার ফাউন্ডেশন। তাদের গবেষণা মতে, সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনকে উৎসাহ দেওয়াই বিদ্যুৎ সংকট থেকে উত্তরণের প্রধান উপায়। সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহারের জন্য বাংলাদেশকে অপার সম্ভাবনার দেশ বলেও তারা মন্তব্য করেছে।
এরই মধ্যে খোদ রাজধানীতেই বাড়ি ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের মালিকদের মধ্যে সৌরবিদ্যুৎ প্যানেল বসানোর আগ্রহ বাড়ছে। স¤প্রতি রাজধানীর তেজগাঁও এলাকায় ‘সাউদার্ন সিএনজি’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানের করপোরেট অফিসে এক কিলোওয়াট ক্ষমতার সৌরবিদ্যুৎ প্যানেল বসিয়েছে। ব্যক্তিগত উদ্যোগে রাজধানীর কোনো বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহারের এটি প্রথম উদ্যোগ।
এরই মধ্যে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনে ২০০৩ সাল থেকে কাজ করছে ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কম্পানি লিমিটেড (ইডকল) নামের একটি প্রতিষ্ঠান। সরকারি মালিকানার এই প্রতিষ্ঠান এ পর্যন্ত সারা দেশে লাখ লাখ সোলার হোম সিস্টেম স্থাপন করেছে। তাদের সঙ্গে আছে ১৫টি অঙ্গপ্রতিষ্ঠান। ইডকল এ প্রতিষ্ঠানগুলোকে আর্থিক সাহায্য এবং সহজ শর্তে বা কম সুদে সৌর প্যানেল বসানোর জন্য ঋণ পাওয়ার ব্যবস্থা করে দেয়।
ইডকল যেসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ করে তার মধ্যে সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ শক্তি। ইডকলের যে লাখ লাখ সোলার হোম সিস্টেম এ পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন স্থানে স্থাপিত হয়েছে, তার মধ্যে গ্রামীণ শক্তি উল্লেখযোগ্য।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পুনঃঅর্থায়ন স্কিমের আওতায় ২০০ কোটি টাকার একটি তহবিল আছে, যা থেকে ২০টি ব্যাংক সৌরবিদ্যুৎ ও বায়োগ্যাসের মতো প্রকল্পে সহজ শর্তে ঋণ দেয়। এ ঋণসুবিধার জন্য খুব বেশি আগ্রহ নেই মানুষের। তাই প্রথমে ব্যাংকগুলোকে নিজেদেরই সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহার করে দৃষ্টান্ত স্থাপনের পরামর্শ দিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর। বাংলাদেশ ব্যাংক ভবনেও সৌরবিদ্যুৎ প্যানেল বসানো হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ডেজার্টটেক ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুসারে, পৃথিবীর সব মরুভূমিতে সারা বছর যে পরিমাণ সৌরশক্তি থাকে, তার এক শতাংশও যদি সৌরবিদ্যুৎ প্যানেল বসানো যায়, তাহলে পুরো পৃথিবীর বিদ্যুতের চাহিদা মেটানো সম্ভব। তাই গ্যাস, তেল ও কয়লানির্ভর বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপনের পাশাপাশি বিশ্বে দিন দিন জনপ্রিয়তা পাচ্ছে সৌরবিদ্যুৎ। দেখা গেছে, উন্নত দেশগুলো প্রযুক্তিতে অনেক এগিয়ে থাকলেও সৌরবিদ্যুতের জনপ্রিয়তা বেশি বেড়েছে এশিয়ার উন্নয়নশীল দেশগুলোতে, বিশেষ করে চীন, ভারত ও বাংলাদেশে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন