অভিযানে বদলায়নি অভ্যাস
পাল্টেছে কৌশল
আসক্তের সংখ্যা ৭০ লাখের ওপরে
মূল কারবারীরা আবারো সক্রিয়
সীমান্তে তৎপর পাচারকারীরা
তিন মাসে গ্রেফতার ৫০ হাজার
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চলমান মাদকবিরোধী অভিযানের পরও থেমে নেই ইয়াবা পাচার। অভিযানের মধ্যেই নানা কৌশলে ইয়াবা পাচার করছেন মাদক ব্যবসায়ীরা। এ চক্রের হাত ঘুরে সীমান্ত দিয়ে রাজধানীসহ দেশের সর্বত্র ঢুকছে ইয়াবা। কখনও কুরিয়ার সার্ভিস, বালুর ট্রাক, আবার কখনও কাঁচামালের আড়ালে আনা হচ্ছে ইয়াবার চালান। আবার কখনও বাসে বিশেষভাবে তৈরি চ্যাম্বারে, কখনও ডাবে, কখনও ফলের গাড়িতে, কখনও বা ইলেকট্রনিক্স সামগ্রীর আড়ালে বাহক কিংবা কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে ঢাকায় ইয়াবা আসার খবর দিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। সর্বশেষ ফেসওয়াশ-ক্রিমের আড়ালে সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় আনা হয়েছে ইয়াবার বড় চালান। মাদকবিরোধী বিশেষ অভিযান শুরুর পর বন্দুকযুদ্ধের ভয়ে মাদক সিন্ডিকেটের বড় বড় সদস্যরা ধরা পড়ছে না, অভিযানের জালে আটকা পড়ছে চুনোপুটি শ্রেণীর মাদক কারবারি।
মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর ও গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, দেশের শতাধিক মাদক সিন্ডিকেট দলের সদস্য মাদক মাফিয়া ডন আত্মগোপনে থেকে সীমান্ডে মাদক চোরাচালান সিন্ডিকেট সক্রিয় রেখেছে। বন্দুকযুদ্ধের ভয়ে কারাগারে আটক মাদক কারবারিরা জামিনে বের না হলেও সক্রিয় রয়েছে তাদের সেকেন্ড কমান্ড। ওই সূত্রে আরো জানা গেছে, দেশে ইয়াবাসেবীর সংখ্যা ৭০ লাখের উপরে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণা সাময়িকীতে সম্প্রতি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, মাদকাসক্তদের ৫৮ শতাংশ ইয়াবাসেবী। ২৮ শতাংশ আসক্ত ফেনসিডিল এবং হেরোইনে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাদক ব্যবসায়ীদের কৌশল বদলের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেও কৌশলী হতে হবে। তাদের মাদকবিরোধী অভিযান সফল করতে হলে জনসম্পৃক্ততা জরুরি।
মাদক বিরোধী অভিযান চলাকালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল দেশের চলমান মাদক বিরোধী অভিযান সম্পর্কে বলেছিলেন, অভিযানে কাউকে হত্যা করা সরকারের উদ্দেশ্য নয়। কাউকে হত্যা করাও হচ্ছে না। যাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট মাদক ব্যবসার অভিযোগ রয়েছে, তাদেরকে গ্রেফতার করে বিচারের মুখোমুখি করা হচ্ছে। এভাবে যতদিন মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণে না আসবে ততদিন অভিযান চলবে।
পুলিশ সদর দফতরের একজন কর্মকর্তা বলেন, মাদক ব্যবসায়ী যত প্রভাশালী হোক না কেন, তাদের কাউকে ছাড় দেয়া হবে না। আইনের আওতায় সবাইকে আসতেই হবে। সরকারের ছয়টি সংস্থার সমন্বয়ে মাদক ব্যবসায়ীদের তালিকা তৈরি করা হয়েছে যাতে প্রায় ১৪ হাজার জনের নাম রয়েছে। এই তালিকায় জনপ্রতিনিধি, রাজনীতিক, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য রয়েছে যারা এখনও ধরা ছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে। এর মধ্যে মাদকের গডফাদার, প্রভাবশালী আশ্রয়দাতা, বিনিয়োগকারীদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জালে আটকানো হবে। দেশ থেকে মাদকের মূলোৎপাটনের স্বার্থেই সরকারি সংস্থার তদন্তে যেসব গডফাদার বা পৃষ্ঠপোষকের নাম এসেছে তাদের আইনের আওতায় আনার কৌশল নেয়া হচ্ছে। বিদ্যমান পরিস্থিতি অব্যাহত রেখে অভিযান শতভাগ কার্যকর করার জন্য কৌশল পরিবর্তনের কথা চিন্তাভাবনা করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ। এ পর্যন্ত দেড় শতাধিক মাদক ব্যবসায়ী আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের সময় বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
পুলিশ সদরদফতরের এআইজি (মিডিয়া) মোঃ সোহেল রানা দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, মাদক বিরোধী বিশেষ অভিযান শুরুর পর গত ১৬ মে থেকে ১২ আগস্ট পর্যন্ত সারাদেশে অভিযান চালিয়ে পুলিশ ৪২ হাজার ৮শ’জন মাদক ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করেছে। একই সময়ে র্যাব সারাদেশে অভিযান চালিয়ে গ্রেফতার করেছে ৮হাজার ৮শ’ মাদক ব্যবসায়ীকে। এ সময় পুলিশ সারাদেশে অভিযান চালিয়ে প্রায় ৭২ লাখ ইয়াবা উদ্ধার করেছে। অন্য দিকে র্যাব উদ্ধার করেছে এক লাখ ১২হাজার পিচ ইয়াবা। গত ১৬ মে থেকে ১২ আগস্ট পর্যন্ত সারাদেশে মাদব বিরোধী অভিযানে পুলিশ মামলা করেছে ৩৩হাজার ১৭০টি। অন্যদিকে র্যাব মামলা করেছে ২ হাজার ২০২টি।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ইয়াবা নিয়ন্ত্রণ করা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষে একা সম্ভব নয়। এ জন্য সমাজের সকলকেই এগিয়ে আসতে হবে। সীমান্ত দিয়ে দেশে যাতে মাদক প্রবেশ করতে না পারে সে জন্য সকল সংস্থা সমন্বয় করে কাজ করার পাশাপাশি সাধারন মানুষকেও আন্তরিক হতে হবে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
জানা গেছে, বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের প্রায় ৪৩টি পয়েন্ট দিয়ে বিভিন্ন কৌশলে ইয়াবা পাচার করা হচ্ছে। এর মধ্যে টেকনাফ ও শাহপরীর দ্বীপের মধ্যবর্তী প্রায় ১৪ কিলোমিটার নাফ নদীর চ্যানেল এলাকা ইয়াবা পাচারের প্রধান রুট হিসেবে ব্যবহার করে চোরাচালানিরা। ইয়াবা চোরাচালানে ছোট নৌকা, ট্রলার, মালবাহী ছোট জাহাজ ব্যবহার করা হচ্ছে। ইয়াবার ৯০ শতাংশই নাফ নদী ও সাগর পথে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। আমদানি করা গাছের মধ্যে খোড়ল কেটে ও মাছের প্যাকেটের মধ্যে ইয়াবা আনা হয়।
র্যাব সূত্রে জানা গেছে, গত সোমবার বিকেলে রাজধানীর মতিঝিল দিলকুশা এলাকার সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিস থেকে ভাটিকা ও প্যারাসুটের আড়ালে ৪০ হাজার পিস ইয়াবা নেয়ার সময় র্যাব-১০ এর হাতে আটক হন ইয়াবার চার ডিলার আরিফ, ফোরকান, রুবেল ও আবু নাইম।
র্যাব-১০ এর অধিনায়ক (কমান্ডিং অফিসার) এডিশনাল ডিআইজি কাইয়ুমুজ্জামান বলেন, চট্টগ্রাম থেকে ভাটিকা ও প্যারাসুট কসমেটিক্সের কৌটার মধ্যে বিশেষ কৌশল খাটিয়ে ইয়াবাগুলো কুরিয়ার করা হয়। প্রত্যেক কৌটায় ১ হাজার পিস করে ইয়াবা ছিল। যা বাইরে থেকে সহজে কেউ বুঝতে পারবে না যে কৌটাগুলোতে ইয়াবা আছে। গোপন তথ্যের ভিত্তিতে র্যাব সদস্যরা আগে থেকেই অবস্থান নেয়। পরে চার যুবক পার্সেল চারটি রিসিভ করতেই র্যাব সদস্যরা আটক করে তাদের। আটক হওয়া চারজনই ইয়াবা ডিলার। তারা ঢাকায় এসে কেউ মিরপুরে, কেউ বাড্ডায় আবার কেউ উত্তরায় ইয়াবার ব্যবসা করে। এর আগে থেকে তারা চট্টগ্রাম থেকে বিভিন্ন মাধ্যমে ইয়াবা নিয়ে এসে ঢাকায় বিক্রি করেছে। এর আগে গত ১৫ আগস্ট রাজধানীর এ্যালিফ্যান্ট রোড এলাকায় অভিযান চালিয়ে টেকনাফ এলাকার অন্যতম মাদক ব্যবসায়ী জহির আহমেদ ওরফে মৌলভী জহিরসহ ছয়জনকে আটক করে র্যাব-২। এ সময় তাদের কাছ থেকে ২ লাখ ৭ হাজার ১০০ পিস ইয়াবা এবং মাদক বিক্রির ৭ কোটি ২৪ লাখ ৮৫ হাজার টাকা উদ্ধার করে। আটকরা টেকনাফ ও কক্সবাজার থেকে ইলেকট্রনিক্স সামগ্রীর আড়ালে বাহক কিংবা কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে ঢাকায় ইয়াবার চালান আনতেন। গত ২৬ জুলাই মোহাম্মদপুর থানাধীন জেনেভা ক্যাম্প এলাকা হতে সাড়ে ৪শ পিস ইয়াবা ও মোটরসাইকেলসহ জন আল আমিন ওরফে জ্যাকি (৩০) নামে এক মাদকের বাহককে আটক করা র্যাব। জ্যাকি মোটরসাইকেলে বিশেষ চ্যাম্বার তৈরির পর ওই ইয়াবা বহন করছিল। ১৬ জুলাই রাজধানীর বনানী হতে অভিনব কায়দায় পেটের ভেতরে ১৮শ পিস ইয়াবা পাচারকালে আসাদ (২৪), শুকুর আলী (২১) ও শফিকুল ইসলাম ওরফে শফিক (২১) নামে তিনজন মাদক ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করে র্যাব। এছাড়া কাভার্ডভ্যানে, বিলাশবহুল বাসে, কুরিয়ার সার্ভিসে ইয়াবা পাচারকালে ১৫টি ঘটনায় ২০ জনকে হাতেনাতে আটক করে র্যাব। এছাড়া গত ২৫ জুলাই রাজধানীর পূর্বাচলে লবণবোঝাই একটি ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান থেকে দুই লাখ ছয় হাজার পিস ইয়াবা উদ্ধার করেছে র্যাব-১। এ সময় যান দুটির চালক ও তাদের দুই সহযোগীকে গ্রেফতার করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে আটক চারজন জানান, তারা পরিবহন চালানোর পাশাপাশি ছদ্মবেশে মাদক ব্যবসা করেন। ২৮ জুলাই টেকনাফ থেকে লবণ বোঝাই করে ঢাকার পথে রওনা দেয়। পথে চটোরিয়ায় একটি ওয়ার্কশপে নিয়ে কাভার্ডভ্যানের সামনের আলাদা একটি বাক্স তৈরি করে। সেখানেই তারা ইয়াবা বহন করে নিয়ে আসছিল।এই চক্রে ১৫/২০ জনের মতো সদস্য আছে। যারা গাড়ি চালানোর পাশাপাশি মাদক কারবার করেন। অভিনব এ পদ্ধতির মধ্যে এর আগে আরো আটটি চালান তারা দেশের বিভিন্ন স্থানে পৌঁছে দিয়েছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন