রোববার, ১৯ মে ২০২৪, ০৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১০ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

ভয়াবহ নদীভাঙনে দিশেহারা মানুষ

অলিউর রহমান ফিরোজ | প্রকাশের সময় : ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৮, ১২:০৩ এএম

বর্তমানে ভয়াবহ নদী ভাঙনের কবলে পড়ে দেশের কয়েকটি জেলার মানুষ এখন দিশেহারা। নদী গর্ভে একের পর এক বিলীন হয়ে যাচ্ছে তাদের বসতঘর, অট্টালিকা, হাট-বাজার, মসজিদ-মাদ্রাসা, হাসপাতাল, সড়ক, ব্রিজ, মফসলী জমি, গাছ-পালাসহ সব কিছু। পদ্মা, মেঘনা ও যমুনাসহ অনেক নদীই এখন বেপরোয়া গতিতে ভেঙ্গে চলছে জনপদের পর জনপদ। নদীর ভয়াবহ ক্ষুধা যেন কিছুতেই মিটছে না। বিশেষ করে পদ্মার ভাঙন এখন ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করেছে। তাতে করে শরিয়তপুর জেলার নড়িয়ার মানুষ এখন সর্বস্ব হারিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে। অনেকেই খোলা আকাশের নীচে রাত কাটাচ্ছে। যাদের বাড়ী-ঘর এখনো ভাঙেনি তারা তাদের বসতঘর ভেঙে অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। যাদের এক সময় ছিল প্রচুর অর্থবিত্ত এবং বৈভব,তারা এখন মাথা গোঁজার জায়গা জোটাতে পারছে না। পদ্মা নদীর গতি পথ পরিবর্তনের কারণেই স্বরণকালের ভয়াবহ ভাঙন শুরু হয়েছে নড়িয়ায়। মূহূর্তের মধ্যে বড় বড় অট্টালিকা,স্কুল-কলেজের ভবন বিলীন হয়ে যাচ্ছে। অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নদী গর্ভে বিলীন হওয়ায় শিক্ষার্থীরা পড়ছে এখন মহা বিপাকে। প্রকৃতির পরিশোধে নিরন্ন মানুষগুলো এখন বিপন্ন হতে বসেছে। নদী একূল ভাঙে ও কূল গড়ে। এতোদিন পদ্মার ভাঙনে পদ্মার উত্তর পাড়ের জেলা মুন্সীগঞ্জের মানচিত্র ছোট হয়ে এসেছে। মুন্সীগঞ্জ থেকে অনেক আগেই বিদায় হয়েছে অনেক ঐতিহাসিক স্থাপনা। বর্তমানে পদ্মার উত্তর অংশ মুন্সীগঞ্জের পাড়ে বিশাল চর জেগে উঠেছে। তাতে করে ভাঙন কিছুটা কমে এসেছে। তবে দোহার-নবাবগঞ্জ অংশ এখনও ভাঙছে। একদিকে নদীতে চর জেগেছে অপরদিকে পদ্মা ব্রিজের নদী শাসন ব্যবস্থার কারণে পদ্মা সেতুর প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরবর্তী পূর্ব অংশের দিকে নদীর গতি পথ পরিবর্তন সাধিত হয়ে ভাঙন তান্ডবলীলা চালাচ্ছে। ভাঙনের প্রধান কারণ হলো নদীতে প্রবল স্রোত। এ এলাকার জন্য সরকার নদী ভাঙন প্রতিরোধে ১১ হাজার কোটি টাকার একটি প্রকল্প গ্রহণ করেছে বলে জানা গেছে। পদ্মার নদী দিয়ে কয়েকটি আঞ্চলিক নদীর পানি মেঘনা হয়ে সমুদ্রে গিয় পড়ে। তান্ডবলীলা শুরু হয়েছে তাতে শোঁ-শোঁ শব্দ করে ভাঙনের তীব্রতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। নদী শাসনের জন্য মাঝ নদীতে ড্রেজিং প্রকল্পের জন্য হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করা হচ্ছে । কিন্তু পদ্মার নদীর মাটি কেটে তা আবার নদীতেই ফেলা হচ্ছে। সরকারের বিরাট প্রকল্প দূর্নীতিবাজদের কারণে কোনো সফল দিচ্ছে না। বিগত কয়েক বছরে জিও ব্যাগ ফেলে নদী ভাঙন রোধ করা হয়েছিল। কিন্তু ঠিকাদার কত বস্তা ব্যাগ ফেলেছে তা গণণা করার মতো কেউ নেই। তাই নদী শাসন রোধ প্রকল্পে সবচেয়ে বেশি হরিলুট চলে। এখানে কোন সাক্ষী প্রমান থাকে না। একবার কিছু ব্যাগ ফেলতে পারলেই ঠিকাদার বিল উঠিয়ে নিতে পারেন। আর পানির নিচে কত ব্যাগ গেলো তা খোঁজ করার যৌক্তিক কোন সুযোগ নেই। অপরদিকে মাদারী পুরের আড়িয়াল খার ভাঙনও শুরু হয়েছে। পদ্মার শাখা নদী হলো- আড়িয়াল খা। পদ্মার স্রোত গিয়ে পড়ে আড়িয়াল খা নদীতে। সেখানে মাদারী পুর জেলার কালকিনি এখন ভাঙনের শিকার হয়ে অনেক মানুষ পথে বসে গেছে। অপরদিকে ভাঙন শুরু হয়েছে রাজবাড়ী জেলায়ও। সেখানে ৫টি ইউনিয়নে ভাঙন চলছে। তবে সবচেয়ে হতাশাজনক খবর হলো, শিলাইদাহ কুঠিবাড়ী বাধ ধসে পড়েছে। কোটি কোটি টাকা খরচ করা হলেও ঠিকাদার নিয়মনীতি মেনে কাজ না করায় এবং কাজে বড় ধরনের দুর্নীতি থাকায় বাধ ধসে পড়েছে। দেশের অন্যান্য ছোট বড় নদীও এখন ভাঙনপ্রবণ। বিশেষ করে চীন দেশে ভয়াবহ বন্যার পানি ছেড়ে দেয়ায় তা ভারত হয়ে এখন আমাদের দেশের নদীতে এসে পড়ছে। তিস্তা এবং পদ্মা নদীর পানি এখন বৃদ্ধি পেয়েছে। ভাঙন কবলিত এলাকাগুলোতে নতুন করে পানি বৃদ্ধি পাওয়ার আরো ক্ষতির মুখে পড়তে হবে নদীর পাড়ের মানুষগুলোকে। পানির স্রোতে ভাঙন আরও ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাবে। সরকার যায় সরকার, আসে কিন্তু তাতে করে তাদের জীবনের কোন পরিবর্তন সাধিত হয় না। প্রাকৃতির নিষ্ঠুর খেয়ালের কারণে তাদের জীবন হয়ে উঠে বিপন্ন। দক্ষিণাঞ্চল নদী দ্বারা বেষ্টিত। সেখানে ভাঙনের শিকার অনেক মানুষ আশ্রয়হীন হয়ে শহরের বোঝা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন। দীর্ঘ কয়েক দশকে পদ্মার নড়িয়া ও তার আশপাশ ভাঙতে ভাঙতে নদীর গতিপথ পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। নাসার প্রতিবেদনে পদ্মার নড়িয়ার নদী ভাঙনের পুরো চিত্র ফুটে উঠেছে। গত ৫১ বছরে ৬শত কিলোমিটার নদীগর্ভে হারিয়ে গেছে। দীর্ঘ কয়েক দশকেও কাঙ্খিত এবং কার্যকর কোন ব্যবস্থা না নেয়ায় বর্তমানের পরিস্থিতি আরো ভয়ানক হয়ে পড়েছে। ১৯৬৭ সাল থেকে পদ্মা নদী ভাঙন শুরু হলেও ১৯৯৮ সালে হঠাৎ করে তা বেড়ে যায়। বিশেষ করে পদ্মার উজানের ফারাক্কার পানি ছেড়ে দেয়ায় বন্যার পাশাপাশি নদী ভাঙন শুরু হয়। ১৯৮৮ সাল থেকে পদ্মার আকৃতি এবং নদী পাড়ের পরিবর্তন ধরা পড়ে নাসার ক্যামেরায়। স্যাটেলাইটের ছবি বিশ্লেষনে দেখা যায়,গত ৭ বছরেই নড়িয়া উপজেলার ১৩ বর্গকিলোমিটিারের চেয়ে বেশি নদী ভাঙনের শিকার হয়েছে। তার পর থেকে ধারাবাহিকভাবে নদী ভাঙছে। তবে ২০১১ থেকে ২০১৫সাল পর্যন্ত প্রতি বছর ভাঙনের শিকার হেেছ আধা বর্গকিলোমিটার। কিন্তু ২০১৫-২০১৬ সাল থেকে আবার তা বাড়ছে। এখন ভাঙছে ২বর্গকিলোমিটার পর্যন্ত। তাদের গবেষনায় বলা হয়েছে, ভাঙনের কবলে ক্ষয়-ক্ষতির পরিমান দাঁড়িয়েছে ১৪ হাজার ১শত ৪৮ কোটি টাকার সম্পদ।
নদী শাসনের জন্য নিতে হবে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা। বিশেষজ্ঞদের নিয়ে আগে তৈরী করতে হবে বড় ধরণের রোড ম্যাপ। তারপর সেনাবাহিনী দিয়ে কাজ শুরু করা না গেলে সরকারের হাজার হাজার কোটি টাকার প্রকল্প কোন উপকারের আসবে না নদী পাড়ের মানুষদের। এদিকে উত্তরাঞ্চলের যমুনা নদী এবং তিস্তায়ও চলছে ভয়াবহ ভাঙন। সেখানকার মানুষ ব্যক্তিগতভাবে বালুর বস্তা ফেলে প্রাথমিকভাবে ভাঙন রোধ করা চেষ্টা চালাচ্ছে। তাতে করে ভয়াবহ ভাঙন ঠেকানো যাচ্ছে না। সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। কিন্তু এখনো সেখানে কাজ শুরু হয়নি বলে নদী গর্ভে বিলীন হচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকার বসতভিটা থেকে শুরু করে ফসলী জমি। যমুনার নদীর প্রকল্পটি যদি সঠিক সময়ে নেয়া যেতো তাহলে হয়তো ভাঙন থেকে কিছু মানুষকে রক্ষা সম্ভব হতো। দেশের নদী ভাঙনের ক্ষতিগ্রস্ত মানুষগুলোর জন্য সরকারীভাবে সাহায্যের হাত বাড়াতে হবে। তাদের মাথা গোজার জন্য নিতে হবে বড় প্রকল্প। জীবন ধারণের জন্য কর্মসংস্থান তাদের বড় একটি দাবী। সরকার দীর্ঘদিন ধরে নদীগুলোকে ড্রেজিংরের আওতায় আনছে না। পানি প্রবাহের জন্য গভীর নদীর প্রয়োজন। তাতে নদীর পাড় সুরক্ষিত থাকতো। কিন্তু দায়সারা গোছের কিছ‚ নদী খনন করা হলেও দেশের অনেক নদীই এখন ভরাট হয়ে পড়েছে। তাই সরকার যদি কোটি কোটি টাকা খরচ করে বাঁধ নির্মাণ করে তাহলেও তাতে কোন ধরনের কার্যকর এবং ফলদায়ক হবে না। আমাদের নদীর পানি প্রবাহের স্বাভাবিকতা তৈরীর জন্য নদীগুলোর গভীরতা তৈরী করতে হবে। তার জন্য দরকার দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা এবং উদ্যোগ।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিষ্ট

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন