রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সাহিত্য

দিনে দিনে বহু বাড়িয়েছে দেনা

গল্প

মু হা ম্ম দ কা মা ল হো সে ন | প্রকাশের সময় : ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৮, ১২:০৪ এএম

চিনু কবিরাজের উঠোনের দেউড়িতে দাঁড়িয়ে একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে সুুুন্দরী নীলিমা। ওর সবি আছে, আবার কিছুই যেন নেই। বিয়ের প্রায় পাঁচ বছর পার হতে চলল, অথচ আজও একটা ফুটফুটে বাচ্চাকাচ্চা বিয়োতে পারেনি। এরচে দুঃখ-কষ্ট আর কী-বা হতে পারে? পাড়াপড়শি ও আত্মীয়-স্বজনের মুখের দিকে লজ্জায় চোখ তুলে তাকানো যায় না। আড়ালে আবডালে নানা জনে নানান কথা বলে বেড়ায়। অপয়া, বাঁঁজা ও রাক্ষুসী-আরও কত কী শব্দ! কেউ কেউ সুযোগ পেলে মুখের ওপর পাঁচকথা শুনিয়ে দিতেও দ্বিধাবোধ করে না। নীলিমা সকলের অপমান, অবজ্ঞা নীরবে মুখ বুজে সহ্য করে যায়। মেয়েরা হলো বাচ্চা বিয়োনোর যন্তর। মাতৃত্বের আনন্দই তাদেরকে পরিপূর্ণতা দেয়। নারীত্বের ষোলোকলা স্বাদ পূূরণ করে। তা নইলে বাচ্চা বিয়োবে কে? পুরুষ? ওরা আর সব পারলেও, এটি কখনো পারে না। পুরুষ হলো শুক্রাণুর ফেরিওয়ালা। নারীর উর্বর সিঞ্চিত জমিনে খায়েশ পূরণে ক্ষান্ত, ব্যস। নারীর হরিণীর ন্যায় নরম ও পেলব মাংস পিন্ডিত দেহ ওদের কর্তৃক মুুুুহুর্মুহু দলিত মথিত হয়। পুরুষের লালসার ছোবলে তারা হয় ক্ষতবিক্ষত ও রক্তাক্ত। নীলিমা চিনু কবিরাজের বাড়িতে এসেছে অনেক আশা ভরসা নিয়ে। লোকমুখে শ্রুত আছে চিনু’র চিকিৎসা পেয়ে আজকাল অনেকে নাকি বাচ্চাকাচ্চারও মুখ দেখেছে। কিন্তু কবিরাজের বাড়িতে এসেই সে রীতিমতো ভড়কে যায়। ভেতরে কারো যেন গলার শোর শোনা যাচ্ছে। কে কেন এবং কী কারণে কিছুই বুঝা যাচ্ছে না। নীলিমা কিছুুক্ষণ অপেক্ষা শেষে ফিরে যেতে উদ্যত হয়, অমনি ঘরের ভেতর থেকে ডাক পড়ে। নীলিমা আশায় বুক বেঁধে আস্তে আস্তে ঘরে প্রবেশ করে। কিন্তু হঠাৎ চারদিকটা কেমন জানি সুনসান হয়ে পড়ে। কাউকে দেখাও যাচ্ছে না। কারো সাড়াশব্দও নেই। নীলিমা ঈষৎ ভয়ে কেঁপে ওঠে। চতুুর চিনু রুমে প্রবেশ করে। লোভাতুুর প্রেতদৃৃষ্টিতে নীলিমার যৌবনবতী দেহের দিকে ফণা তুলে। চোখের পলকে ঝাঁপিয়ে পড়ে। বিড়বিড় করে বলে, ‘অ্যাই ছেমড়ি, চুপচাপ থাক, একদম নড়চড় করিস না, আমি তোর পেটে বাচ্চা দিব। নীলিমা আহত বাঘিনীর ন্যায় ফোঁস করে ওঠে। সজোরে চিনুকে মারে লাথি। লাথির চোটে চিতপটাং হয়ে যায় চিনু। লজ্জায়, ঘৃৃণায়, ক্ষোভ ও অপমানে দ্রুত বেরিয়ে পড়ে নীলিমা।

চিনু এমনি-বদস্বভাবের। ঝগড়াটগড়াও মূলত কিছু নয়। চিনুর বউ দু’দিন হলো বাপের বাড়ি গেছে। চিনু একাই বকবক করে যাচ্ছিল। এটা চিনু›র নিত্যকার রুটিন ওয়ার্ক। ভারিক্কি মেজাজ ও বদ স্বভাবের মঞ্চায়ণ। কবিরাজির নামে যত্তোসব ভাওতাবাজি। ঝাড়ফুঁক, তাবিজ, কুফরিকালাম ও অজ্ঞাত গাছগাছড়ার রসকষ খাইয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত ও সমূলে সর্বশ্রান্ত করাই তার কাজ। ফলশ্রুতিতে তার দিনদিন রোগীর সংখ্যাও কমে যাচ্ছে। ফলে চিনুর মাথামুন্ডু কিছুই ঠিক নেই। কবিরাজি পেশা লাটে উঠার জোগার। এদিকে টানা দু›দিন ধরে মাইকে কোনো মৃত মানুষের শোক সংবাদ না শুনে চিনু›র যথেষ্ট মন খারাপ। সারাক্ষণ মেজাজ বিগড়ে রয়েছে। ক্ষণে ক্ষণে বউ বাচ্চাদের সঙ্গে ঝগড়া বেঁধে যাচ্ছে। ভাবখানা এমন যেন চতুর্দিকে মানুষ না মরার জন্য বউ বাচ্চাই দায়ী। নিজের মেলা টাকা। অথচ পকেটে নাকি একটা ফুটো পয়সাও নেই। হাট-বাজারে যেতে পারছে না। ইনকাম বন্ধ। চিনু›র মত কথিত ছদ্মবেশী ভণ্ডদের উৎপাতে দেশ সয়লাভ। প্রকৃত আলেম-ওলামার ভিড়ে সমাজে এদের আধিপত্য চোখে পড়ার মত। কিছু বুঝুক আর না বুঝুক, যখন তখন মনগড়া ফতোয়া দিয়ে দে। প্রকৃত ইসলাম ধর্মীদের মধ্যে নানান ছল ছুতোয় বিভেদ ও অনৈক্য তৈরী করে। মানুষ মারা গেলে চতুর্দিক থেকে ওরাও পঙ্গপালের মত হাজির হয়। সম্বল বলতে শুধু একখান টুুুপি আর পাঞ্জাবী। ব্যস কুরআন-হাদীসের কোনো জ্ঞান নেই। নামাজ রোজা কলেমা ও ইবাদত বন্দেগীও নেই। মউতা বাড়ির কবর পাড়ে চার-পাঁচশ›র নিচে ওদের দেয়া যায় না। ফেবিকল আঠার মতো গৃহস্থের পেছনে লেগে থাকে। চিনু এইতো সেদিন বেশ সাগ্রহে বলে উঠে, ‘বুঝলা বউ, কবর পাড়ের টেহার আলাদা একটা বরকত আছে। আল্লাহ পাকের রহমতের দরিয়া নিজ হস্তে খুলে দেয়। আজ সারাদিনে পাঁচখানা মানুষ মারা গেছে। এই দ্যাহ, কত টেহা! পাঁচ পাঁচশতগুণে পঁচিশশত! ম্যালা টেহা!!›
চিনু›র বউ সব শুনে। চুপ করে থাকে। কিছু বলে না। বিড় বিড় করে বলে,
‘বুড়ো হাঁড় বদমাশ!’
চিনু ঘাড় ঘুরিয়ে বলে,
‘ও বউ, কিছু বললা বুঝি?’
‘জ্বি না। কিছু বলি নাই। আচ্ছা তোমার কোনো খোঁজ-খবর আছে, পোলার যে ফরম ফিলাপের টেহা লাগব?’
‘ফরম ফিলাপ! বউ এইডা আবার কী!?’
‘এইডা তোমার মুন্ডু! ফরম ফিলাপ চিনো না? পোলার পরীক্ষার ফরম ফিলাপ।’
‘অহ বুঝেছি। বউ, এইডা কী দরকার! অযথা এত্তোগুলা টেহা! দুনিয়াবি পড়ালেহার কোন মানে আছে। বিদআত! বিলকুল বিদআত!! তাছাড়া এতোগুলো টেহা কী গাছে ধরে?’
আতর জান বিবি আর কথা বাড়ায় না। বুড়ো বদমাশকে হাঁড়ে হাঁড়ে চিনে। জানে কিচ্ছু হবে না। ইনিয়ে বিনিয়ে টাকা না ছাড়ার ফন্দি। মেঘে মেঘে বেলা কমতো আর হয়নি। তার জীবনটাকে তছনছ করে ছাড়লো মানুষটা। ছেলেটার ফরম ফিলাপের টাকা দেয়া হয়নি। কয়দিন থেকে ছেলেটার শরীরটরীরও খুব একটা ভাল নেই। সবসময় মনমরা অবস্থায় থাকে। নাওয়া খাওয়াও নেই। এদিকে সংসারে ঠিকমত বাজার সওদাও করা হয় না। নিজের বউ বাচ্চা কী খাইলো, না খাইলো এ নিয়েও চিনু›র মাথা ব্যথা নেই। সারাক্ষণ ব্যস্ত ভণ্ড কবিরাজি ও মউতার বাড়ি›র মাইয়্যত আর নিজের খয়রাতি খানাদানা নিয়ে। ডাকাতের মত মানুষের বাড়িতে যখন তখন বিনা দাওয়াতে হানা দেয়। কারো কোন বিয়ে-জেয়াফত, কুলখানি হলেই, ব্যস আর রক্ষে নেই। চিনু›র অটোমেটিক দাওয়াত। মানুষও চক্ষুলজ্জায় কিছু বলার সাহস পায় না। গরুর গোশতের ঘ্রাণ পেলে হুঁশ থাকে না। ঝোলের দাগ লাগাতে লাগাতে গায়ের সবগুলো পায়জামা-পাঞ্জাবীর দফারফা। একেকটার সাদারঙ পাল্টে গিয়ে হলুদ বর্ণ ধারণ করেছে।
সকাল থেকে চিনু’র আজ মাথা ঠিক নেই। কতক্ষণ পর পর মোবাইলে চোখ রাখছে, এ বুঝি ফোনটা বেজে ওঠল। সঙ্গী সাথীরও অভাব নেই। মনগড়া প্রোপাগান্ডা ও ধোঁকা চালিয়ে চিনু›র বাড়িতে রোগী পাঠায়। এছাড়া কোথাও কেউ মরতে দেরী, সেকেন্ডের গতিতে চিনু’র মোবাইল বাজতে দেরী নেই। খবর চাউর হতে সময় লাগে না। প্রায় প্রতিদিনই চিনু বাহিরে থেকে খেয়ে আসে। এভাবে মাসের পর মাস, বছরের পর বছর। চিনু’র বউ আতর জান বিবি হিসেব কষে দেখেছে, বছরে প্রায় ৬ মণ গোশত একাই চিনু খায়। বাড়ি এসে বলে,
‘বুুঝলা বউ, সবি আল্লাহপাকে খাওয়ায়। এই চিনু’র দিল বড্ড সাদা। কোন খেদ নেই।’
আতর জান বিবি রাগে গজ গজ করে। সব বুঝে। কিছু বলে না। নিজের বউ বাচ্চার জন্য যে মানুষটার হাতে এক কেজি গোশত ওঠে না, ঠিকমত বাজারহাট ও সওদাপাতিও করে না-তার আবার দিল। তার’তো পুরো শরীরটাই আস্ত জিহ্বা। চিনু’র সাথে রাগ করে কয়দিন পরপর বাপের বাড়ি চলে যায়। আবার সংসারের মায়ায় ফিরে আসে। চিনু’র একমাত্র ছেলেটার অসুস্থতার প্রকোপ এরিমধ্যে বেড়েছে। কাশের সাথে প্রচন্ড শ্বাসকষ্ট ও রক্তবমি বের হচ্ছে। অবস্থা বেগতিক। খাওয়া দাওয়াও নেই বেশ কয়েকদিন। আতর জান বিবি ছেলের শিওরে বসে মুহুর্মুহু কান্নাকাটি করছে। এখনি একজন ভালো ডাক্তার বদ্যি দেখাতে পারলে ভাল হতো। কিন্তু চিনু’র সেদিকে কোন ভ্রুক্ষেপ আছে বলে মনে হয় না। সে প্রতিদিন সকালে বের হয় আর রাত্রে ফিরে আসে। ছেলের অসুখ বিসুখ নিয়ে কোন মাথা ব্যথা নেই। বরং উল্টো বলে,
‘বউগো ও বউ, আয়াতে শেফা ও সুরা পড়ে বেশী বেশী ফুঁ দাও। সব উপরওয়ালার হুকুম। অসুখ-বিসুখে গুনাহ মাফ হয়। ডাক্তার বদ্যি ভাল জিনিস না। একেকজন একেক ওষুধ লিখে দেয়। ডাক্তারের হাতে কোনো ক্ষমতা নেই। তিনি (উপরওয়ালা) চরম অসুন্তুষ্ঠ হন।’
আতর জান বিবি চেঁচিয়ে ওঠে,
‘কও কী এসব! আমার ল্যাদা পোলার কীসের গুনাহ মাফ হয়?’
‘লা হাওলা ওয়ালা কুয়াতা...’ বউ খোদা রুষ্ট হবেন। এভাবে উচ্চবাক্য করতে নেই। আল্লাহ গোস্সা হন’
চতুর চিনু এই বলে সাইকেল নিয়ে দ্রুত হন হন করে বেরিয়ে পড়ে। একটিবারও পিছনে ফিরে তাকায় না। মানুষটার ওপর আতর জান বিবি›র মারাত্মক ঘেন্না ধরে গেছে। ভণ্ডর সাথে আজকাল মন খুুুলে দু’চার কথাও বলতে মন সায় দেয় না।
কবি জীবনানন্দের কবিতার ভাষায়, ‘যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ, মরিবার হল সাধ তার।’ নীলিমারও মরিবার সাধ জাগলো। বীতশ্রদ্ধ জীবনের প্রতি তার ঘৃণা ধরে গেছে। বাড়ির পেছনে পুুরনো আমলকী গাছে গলায় ফাঁস লাগায় সে। অন্ধকারে ছেয়ে যায় পুরো পৃৃথিবী। এদিকে ঘুমের ঘোরে চিনু চিৎকার করে লাফিয়ে ওঠে। ভয়াবহ রকমের দুঃস্বপ্ন দেখেছে, ‘অনেকগুলো লম্বা জিহ্বাওয়ালা মানুষ তার দিকে ক্রমশ এগিয়ে আসছে। জিহ্বাগুলো লোভে লক লক করছে।’ চিনু এক দৌঁড়ে ছুটে চলে যায় অসুস্থ ছেলের কামরায়। ছেলের কপালে হাত দিয়ে দেখে বরফ শীতল গা। সটান হয়ে পড়ে আছে। কোন সাড়া শব্দ নেই। রাতেই মারা গেছে। চিনু’র জোয়ানমর্দ ছেলেটাও অকালে চলে গেল। ওরা দু’দুটো হয়ত সেইসব মানুষ যারা পঞ্চমীর চাঁদ ডুবলে মরতে সাধ জাগে। পুত্রশোকে চিনু বুক ফাঁটা কান্নায় ভেঙে পড়ে। স্ত্রী আতর জান বিবিও মুহূর্তে জ্ঞান হারায়। এক কান দু’কান করে মুহূর্তে খবর চতুর্দিকে চাউর হয়ে যায়। দুঃসংবাদ বাতাসের বেগে ছড়ায়। এখানেও অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে বেজে ওঠে চিনু’র ফোন। পরদিন সকাল বেলা চিনু’র বাড়িতে দলে দলে হাজির হয় হাজারো হাজারো আলেম ওলামার ভিড়ে স্বপ্নে দেখা অনেক জিহ্বাওয়ালা মানুষ। লোভে ওদের জিহ্বাগুলো লক লক করছে। ঠিক ভোর রাতের স্বপ্নের মতন। চিনু’র হুশ নেই। আপাতত কবর পাড়ে ওদের হাত থেকে বাঁচার সওয়াল জবাব নিয়েই চিনুকে বেশী ভীত-সন্ত্রস্ত্র দেখা যায়। আল্লাহপাক নিজ হস্তে রহমতের দরিয়া খুলে দিয়েছেন। আজ যে চিনু’র শোধ দেয়ার পালা। সারাজীবন শুধু মানুষের কাছ থেকে দু’হাতে নিয়ে লোভের কলসি ভরাট করেছে। চিনুর কপালে চিন্তার ভাঁজ খুব স্পষ্ট। দিনে দিনে বহু বাড়িয়াছে দেনা, (আজ) শুধিতে হইবে ঋণ।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন