মুফতী পিয়ার মাহমুদ
বর্তমান মুসলমান সমাজে জন্ম দিবস বা বার্থ ডে পালন করা একটি ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ ফ্যাশন তাবৎ দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে মহামারী আকারে। এ উপলক্ষে আয়োজন করা হয় চোখ ধাঁধানো জমকালো অনুষ্ঠানের। মোমবাতি জ্বেলে করতালি দিয়ে “হ্যাপি বার্থ ডে”-এর ধোনি তোলে কেক কাটা এ অনুষ্ঠানের প্রধান বিষয়। এতে আমন্ত্রণ করা হয় বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন ও বিভিন্ন পেশা এবং শ্রেণীর মানুষকে। ছড়াছড়ি হয় উপহার উপঢৌকনের। নারী-পুরুষের মেলামেশা হয় অবাধে। ছবি ও ভিডিও করা হয় দেদারসে। আয়োজন করা হয় গানবাজনার। গবেষণা অনুসন্ধান বলে এটি একটি বিজাতীয় কালচার। আর বিজাতীয় সংস্কৃতি ও কালচার অনুসরণের ব্যাপারে দয়ার নবীর জবানে উৎকীর্ণ হয়েছে ভয়ংকর হুঁশিয়ারি। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তি বিজাতীয় সাদৃশ্য গ্রহণ করবে কিয়ামত দিবসে সে তাদেরই একজন পরিগণিত হবে। (আবু দাউদ : ২/৫৫৯; মুসনাদে আহমাদ: ২/৫০)। কত ভয়ংকর ও কঠোর উচ্চারণ। যে মুমিনের সারা জীবনের আরাধনা সুখের জান্নাত, প্রবৃত্তির তাড়নায় পরানুকরণের কারণে নিমিষেই সে সুখের জান্নাত থেকে চিরবঞ্চিত।
অবাধ্য নাফরমান কাফের মুশরিকের সাথে নিন্দিত নরকে নিক্ষিপ্ত। এ যেন নিতান্তই বাতুলতা। নতুবা লক্ষহীন ক্ষতিকারক এই পরানুকরণের অর্থ কি? অপর বর্ণনায় এসেছে মহানবী (সা.) বলেন, তোমরা পথ পন্থা, রীতিনীতি, চালচলন ও লেবাস পোশাকে পৌত্তলিকদের প্রতিকূলে চলো, অনুকূলে নয়। (বুখারী: হাদীস: ৫৮৯)। এ ছাড়াও এতে রয়েছে অকারণে অপ্রয়োজনে ছবি তোলার মত মহাপাপ। এ সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন যারা ছবি বা প্রতিমূর্তি তৈয়ার করে কিয়ামতের দিন তাদেরকে শাস্তি দেয়া হবে এবং বলা হবে তোমরা যা কিছু সৃষ্টি করেছিলে সেগুলোকে জীবন দান কর। (বুখারী: ৪৯৫১, মুসলিম: ২০১৮; তারগীব: ৪৬০৭)। আম্মাজান আয়শা (রা.) বলেন, একবার রাসূলুল্লাহ (সা.) কোন এক সফর থেকে ফিরে এলেন। আমি ঘরের আঙ্গিনায় একটি পর্দার কাপড় ঝুলিয়ে রেখেছিলাম। এতে কিছু ছবি ছিল। যখন এর উপর মহানবীর (স.) দৃষ্টি পড়ল তাঁর চেহারার রং বিবর্ণ হয়ে গেল। এ অবস্থায় তিনি বললেন, হে আয়শা শোন! কিয়ামত দিবসে সবচে কঠিন শাস্তি হবে সেসব লোকের যারা মহান আল্লাহর সৃষ্টির অনুকরণ করে সৃষ্টি করে। (বুখারী: ৫৯৫৪, ৫৯৫৭, ৫৯৬১; মুসলিম: ২১০৫, তারগীব: ৪৬০৭)। হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা.) কে বলতে শুনেছি, সকল (প্রাণীর) চিত্রকর বা ছবি অংকনকারী জাহান্নামে যাবে। সে যতগুলো ছবি অংকন করেছে প্রতিটি দ্বারা একটি করে প্রাণী তৈরী করা হবে, যে প্রাণীগুলোর মাধ্যমে তাকে জাহান্নামে শাস্তি দেয়া হবে। (বুখারী: ২২২৫; ৫৯৬৯; মুসলিম: ২১১০; তারগীব: ৪৬০৯)। অন্য বর্ণনায় এসেছে, সাঈদ ইবনুল হাসান বলেন, “আমি ইবনে আব্বাস (রা.)-এর নিকট উপস্থিত ছিলাম। এ সময় এক ব্যাক্তি এসে বলল, হে ইবনে আব্বাস! হস্তশিল্পই আমার জীবিকা উপার্জনের একমাত্র উপায়, আমি এ ধরনের ছবি তৈরী করি। এ কথা শুনে ইবনে আব্বাস (রা.) বললেন, এ ব্যাপারে আমি তোমাকে তাই শোনাব যা আমি নবীজীর যবান মুবারক থেকে শুনেছি। আমি তাকে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি ছবি আঁকবে কিংবা প্রতিকৃতি বানাবে আল্লাহ তাকে ততক্ষণ শাস্তি দিতেই থাকবেন যতক্ষণ না সে তাতে রুহ বা আত্মা দান করে অথচ সে তাতে কখনই রুহ দান করতে পারবে না। এ কথা শুনে লোকটির চেহারা ফ্যাকাসে ও বিবর্ণ হয়ে গেল। তখন ইবনে আব্বাস (রা.) বললেন, তুমি যদি ছবি বা প্রতিকৃতি বানাতেই চাও তাহলে গাছ ইত্যাদি প্রাণহীন জিনিসের ছবি বানাও”। (বুখারী: ২২২৫)। অন্য এক বর্ণনায় দয়াল নবী বলেন, “যে ঘরে ছবি থাকে সে ঘরে কোন রহমতের ফেরেস্ততা প্রবেশ করে না”। এসব অনুষ্ঠানে পর্দার বিধানও লঙ্গিত হয় চরমভাবে। অথচ এ ব্যাপারে কুরআন হাদীসের নির্দেশ বড় কঠোর। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে- “আপনি মুমিনদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টি নত রাখে এবং স্বীয় যৌনাঙ্গের হেফাজত করে। এ ব্যবস্থা তাদের পবিত্রতার জন্য অধিকতর কার্যকর। আপনি মুমিন নারীদেরকে বলুন, তারা যেন নত রাখে তাদের সৃষ্টি এবং হেফাজত করে যৌনাঙ্গকে। আর তারা যেন যা সাধারণত প্রকাশ হয়েই যায় তাছাড়া তাদের অন্য কোন সৌন্দর্য প্রদর্শন না করে এবং তাদের বক্ষদেশে ফেলে রাখে মাথার ওড়না।”
(সূরা নূর: ৩০-৩১) অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে- “তোমরা নবীর স্ত্রীগণের নিকট কিছু চাইলে পর্দার আড়াল থেকে চাইবে। এটা তোমাদের ও তাদের আত্মার পবিত্রতার অধিক কার্যকর।” (সূরা আহযাব: ৫৩) এখানে প্রণিধানযোগ্য বিষয় এই যে, উক্ত আয়াতে মহানবীর (সা.) পুণ্যাত্মা ও নিষ্কলুষ স্ত্রীগণকে পর্দার নির্দেশ দেয়া হয়েছে, যাদের অন্তরকে পাক-পবিত্র রাখার দায়িত্ব স্বয়ং আল্লাহ গ্রহণ করেছেন। অপর পক্ষে যে সকল পুরুষদের এই নির্দেশ দেয়া হয়েছে, তাঁরা হলেন রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর মহান সাহাবী যাদের মাঝে অনেকের মর্যাদা ফেরেশতাদের থেকেও ঊর্ধ্বে। এতদসত্ত্বেও তাদের আত্মিক পবিত্রতা ও মানসিক কুমন্ত্রণা থেকে বাঁচার জন্য তাদের মধ্যে পর্দার ব্যবস্থা জরুরী মনে করা হয়েছে। আজ এমন ব্যক্তি কে আছে যে তার মনকে মহান সাহাবাগণের মন অপেক্ষা আর তার স্ত্রীর মনকে পুণ্যাত্মা নবীপত্মীগণের মন অপেক্ষা অধিক পবিত্র ও নিষ্কলুষ দাবী করতে পারে? আর মনে করতে পারে যে, পর নারী ও পুরুষের সাথে একান্তে অবস্থান ও মেলামেশা কোন অনিষ্টের কারণ হবে না।”
(মাআরিফুল কুরআন: ৭/১৯৪-১৯৫) সাহাবী আবু সাঈদ (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন- “কোন পুরুষ যেন অন্য পুরুষের গুপ্তাংশের দিকে না তাকায়, এভাবে কোন নারীও যেন অন্য নারীর গুপ্তাংশের দিকে না তাকা। (মুসলিম, মিশকাত: ২/২৬৯)। অপর বর্ণনায় এসেছে সাহাবী উকবা বিন আমের থেকে বর্ণিত, মহানবী (সা.) বলেন- “তোমরা পরনারীদের কাছে যেও না।” (বুখারী: ২/৭৮৭, মুসলিম: ২/২১৬) অন্য এক হাদীসে আছে মহানবী (সা.) বলেন- “কোন পুরুষ কোন বেগানা নারীর সাথে একান্তে অবস্থান করলে তাদের তৃতীয়জন হয় শয়তান।” (তিরমিযী: ১/২২১) সাহাবী জাবের (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন- “তোমরা বেগানা নারীর নিকট প্রবেশ করো না। কেননা শয়তান তোমাদের শীরা-উপশীরায় চলাচল করে।”
(মুসলিম: ২/২১৬; তিরমিযী:১/২২২) মহনবী (সা.) বলেন, আল্লাহ অভিশাপ করেছেন স্বেচ্ছায় পরনারী দর্শনকারী পুরুষ ও স্বেচ্ছায় প্রদর্শনকারীণী নারীকে। (শুআবুল ঈমান, বায়হাকী: ৭৩৯২)। গানবাজনাও এ অনুষ্ঠানের একটি গুরুত্বপূর্ণ আয়োজন। এ ব্যাপারেও কুরআন হাদীসের বাণী বড় কঠিন। মহাগ্রন্থ আল কুরআনে ইরশাদ হয়েছে- “এক শ্রেণীর লোক এমন রয়েছে যারা মানুষকে আল্লাহর পথ থেকে গোমরাহ করার উদ্দেশে ‘লাহওয়াল হাদীস’ তথা অবান্তর কথাবার্তা ক্রয় করে অন্ধভাবে এবং তা নিয়ে করে ঠাট্টা-বিদ্রƒপ। এদের জন্য রয়েছে অবমাননাকর শাস্তি।” (সূরা লুকমান:৬)। আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ, ইবনে আব্বাস, জাবের (রা.) ইমাম বুখারী, বায়হাকী, ইবনে জারীর প্রমুখ আয়াতে উল্লেখিত ‘লাহওয়াল হাদীস’ এর তাফসীর করেছেন গানবাজনা করা। (চলবে)
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন