জনজীবনে পরিবহন সেক্টর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গাড়িতে না চড়ে আমরা কেউই জীবনকে সচল রাখতে সক্ষম নই। সুতরাং আমরা সবাই নিরাপদ পরিবহন ব্যবস্থা চাই। নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছাতে চাই। সেজন্য প্রয়োজন এই সেক্টরের নৈরাজ্য দূর করা। প্রয়োজন যাত্রী নিরাপত্তা, পথচলার নিরাপত্তা, সড়কের নিরাপত্তা, গাড়ির নিরাপত্তা। পরিবহন সেক্টরকে প্রকৃত অর্থেই সেবাখাত হিসেবে গণ্য করতে হবে। পরিবহনখাতকে মালিকের জন্য একে সম্মানজনক ব্যবসা এবং শ্রমিকদের জন্য সম্মানজনক ও দায়িত্বশীল পেশা হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। দিতে হবে সকলের নিরাপত্তা। তবেই দূর হবে এই সেক্টরের নৈরাজ্য।
গত ১৯ সেপ্টেম্বর ‘সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮’ জাতীয় সংসদে পাস হয়। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন, পরিবহন মালিক সমিতি, যাত্রী কল্যাণ সমিতি, নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনসহ সবাই দীর্ঘদিন ধরে যুগোপযোগী আধুনিক ও উন্নত সড়ক পরিবহন আইন প্রণয়নের দাবি করে আসছিল। সেই দাবি বিবেচনায় নিয়েই সরকার আইন পাস করেছে। তবে এর বেশকিছু ধারা শ্রমিক স্বার্থের বিরুদ্ধে মর্মে অভিযোগ করেছে পরিবহন শ্রমিকরা। তারা ইতোমধ্যে ৮ দফা দাবিতে ৪৮ ঘণ্টার এ ধর্মঘটকে অযৌক্তিক ও জবরদস্তিমূলক বলে অভিহিত করেছে সবাই। এ ধর্মঘটে তিনজন শিশু মারা গেছে, ৭ জাহার কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে এবং যাত্রীরা বিপুল সংখ্যায় নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হয়েছে।
অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউট (এআরআই) বুয়েটের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতি বছর ১২,০০০ মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারায় এবং ৩৫,০০০ আহত অবস্থায় জীবন কাটায়। ২০১৭ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় সাত হাজার ৩৯৭ জন নিহত ও ১৬ হাজার ১৯৩ জন আহত হয়েছে বলে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির এক পরিসংখ্যানে উঠে এসেছে। সংগঠনটির তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সালে এসব হতাহতের ঘটনা ঘটে চার হাজার ৯৭৯টি দুর্ঘটনায়। দেশের মোট সড়ক দুর্ঘটনার ৪৮ শতাংশ খবর গণমাধ্যমে এলেও তার ৪০ শতাংশ প্রকাশ পায়। দেশের জাতীয়, আঞ্চলিক ও অনলাইন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত সড়ক দুর্ঘটনার সংবাদের আলোকে তৈরি করা সমিতির প্রতিবেদনে বলা হয়, গেল বছর ছোট-বড় চার হাজার ৯৭৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় ২৩ হাজার ৫৯০ জন যাত্রী, চালক ও পরিবহন শ্রমিক হতাহত হয়েছে। এর মধ্যে বাস দুর্ঘটনা এক হাজার ২৪৯টি, ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান দুর্ঘটনা এক হাজার ৬৩৫টি, হিউম্যান হলার ২৭৬টি, কার-জিপ-মাইক্রোবাস ২৬২টি, অটোরিকশা এক হাজার ৭৪টি, মোটর সাইকেল এক হাজার ৪৭৫টি, ব্যাটারিচালিত রিকশা ৩২২টি ও নছিমন-করিমনে দুর্ঘটনা ঘটেছে ৮২৪টি।
এক বছরে দেশে সড়ক দুর্ঘটনার ঘটনা ঘটেছে ৩৩৪৯টি। ২০১৭ সালের এসব দুর্ঘটনায় সারাদেশে নিহত হয়েছে ৫৬৪৫ জন এবং আহত হয়েছে ৭৯০৮ জন। গড়ে প্রতিদিন ১৫ জন নিহত হয়েছে। সম্প্রতি জাতীয় প্রেস ক্লাবে আয়োজিত প্রশিক্ষিত চালকদের মাঝে সনদ বিতরণ অনুষ্ঠানে এসব তথ্য তুলে ধরেন নিরাপদ সড়ক চাই’র প্রতিষ্ঠাতা চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন। ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, দেশে ফিটনেসবিহীন গাড়ি চলছে ৬০ লাখ। এসব গাড়ির চালকের মাধ্যমেই যত্রতত্র পরিবহন দুর্ঘটনা ঘটছে। ২০১৫ সালে সড়ক দুর্ঘটনার পরিমাণ ছিল তুলনামূলক কম। এ বছর সারাদেশে ২৬২৬টি দুর্ঘটনায় ৫০০৩ জন নিহত ও ৬১৯৭ জন আহত হয়। ২০১৬ সালে আরও কমে ২৩১৬টি দুর্ঘটনায় ৪১৪৪ জন নিহত ও ৫২২৫ জন আহত হয়। তিনি বলেন, সড়ক দুর্ঘটনা নিরসন করতে হলে প্রথমে সড়কের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। দুর্ঘটনার জন্য জেল-জরিমানাতে সমাধান নয়, সমাধান এর কারণ উদঘাটন করে তা লাঘব করা। এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ, ত্রুটি সংশোধন ও চালককে দক্ষ করে গড়ে তুলতে ইনস্টিটিউশনের বিকল্প নেই। এমন কিছু অপরাধ আছে যা সংশোধনের মাধ্যমে সমাধান করা যায়। এমনিতেই আমাদের দেশে চালকের সংকট রয়েছে, সেক্ষেত্রে শুধু শাস্তি দিলেই সমাধান হবে না। সংশোধনের মাধ্যমে সমাধানের সুযোগ দিতে হবে।
উল্লেখ্য, গত ২৯ জুলাই রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কে বাসচাপায় ঢাকা সেনানিবাসস্থ শহীদ রমিজ উদ্দিন কলেজের দু’জন শিক্ষার্থীর মৃত্যুর ঘটনায় বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদে ফেটে পড়ে। এ দুর্ঘটনার পর সরকারের এক মন্ত্রীর হাসি ও তার কিছু মন্তব্যে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করার দাবি আদায়ের লক্ষ্যে লাগাতার আন্দোলন শুরু করে। এই আন্দোলনে শিশু বয়সের শিক্ষার্থীরা চোখে আঙ্গুল দিয়ে আমাদের যা শিক্ষা দিয়েছে তার বাস্তবায়ন সম্ভব হলে এই সেক্টরের বিরাজমান নৈরাজ্য বন্ধ হতে পারে। ইদানীং গণপরিবহন সেক্টরে নিত্যনৈমিত্তিক এমন সব ঘটনা ঘটে চলেছে, যা শুনলেও গা শিউরে ওঠে। এসব ঘটনা এখন আর সড়ক দুর্ঘটনায় সীমাবদ্ধ নেই; নারী ধর্ষণ থেকে শুরু করে পরিকল্পিত হত্যাকান্ড পর্যন্ত তা গড়িয়েছে।
বিআরটিএ হলো পরিবহন সেক্টরের একটি মাদার অর্গানাইজেশন। চালকের লাইসেন্স প্রদান থেকে শুরু করে গাড়ির রেজিষ্ট্রেশন, ফিটনেস, ট্যাক্স টোকেনসহ যাবতীয় কাগজপত্র দিয়ে থাকে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়াধীন এই সরকারি সংস্থা। কিন্তু এই প্রতিষ্ঠানটি দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত। ঘুষ এবং দালাল ছাড়া এখানে কোনো কাজ হয়না। লাইসেন্স প্রদানের জন্য ওয়ানস্টপ সার্ভিস নেই। ফলে দক্ষ দালালের মাধ্যমে যারা উৎকোচ নিয়ে যেতে পারে সে গাড়ি চালাতে না জানলেও লাইসেন্স পায়। এই তরিকা যার জানা নেই সে যত ভাল ড্রাইভারই হোক সে লাইসেন্স পায়না। ফিটনেসের ক্ষেত্রে দালাল ছাড়া গেলে গাড়ি নিয়ে গিয়ে দিনের পর দিন ঘুরেও ফিটনেস পাওয়া যায় না। এই সমস্যা সেই সমস্যা বলে ঘোরাবে। কিন্তু দালালের মাধ্যমে গেলে বড় অংকের টাকা নিয়ে ফিটনেস দিয়ে দেয় একদিনেই।
রাস্তায় স্পিড ব্রেকার আছে কিন্তু মার্কিং বা সতর্ককারী চিহ্ন বা সাদা দাগ দেয়া নেই অধিকাংশ রাস্তায়। আবার আছে খানা খন্দকে ভরা। এসব দেখার কেউ নেই। রাস্তায় গাড়ি চালনায় যাত্রী ধরার জন্য রয়েছে অসম প্রতিযোগিতা। এই প্রতিযোগিতার ফলে দূর্ঘটনা বেড়েই চলেছে। ট্রাফিক সার্জেন্টরা একটু আন্তরিক হলেই সিরিয়ালে গাড়ি চালাতে চালকদের বাধ্য করতে পারে। কিন্তু রাস্তায় তাদের দেখা যায় নিরাপদ একটি জায়গায় দাঁড়িয়ে গাড়ি থামিয়ে উৎকোচ আদায় অথবা মামলার কোটা পূরণে ব্যস্ত। জনদুর্ভোগ রোধ করতে তাদের তেমন কোনো ভূমিকা দেখা যায় না। নতুন আইন সংসদে পাস হওয়ার পর রাস্তায় পুলিশের অত্যাচার উঠেছে চরমে।কোটা তো আছেই এখন আবার মামলা করলে নাকি সংশ্লিষ্ট সার্জেন্ট ৩০% কমিশন পান। ফলে এখন অবৈধ নগদ আদায়ের পাশাপাশি মামলার সংখ্যা যেমন বেড়েছে তেমনি টাকার অংক বেড়েছে কয়েকগুন। কারণ অংক বড় হলে কমিশন বেশি পাওয়া যাবে।এখন পুলিশ সার্জেন্টদের মামলার ভারে জর্জরিত গাড়ির মালিক শ্রমিকরা। সব কাগজ ঠিক থাকলেও তাদের মতে অপরাধ এবং ধারার কোন শেষ নেই। শ্রমিকদের মতে, বর্তমানে ঢাকা শহরে চলমান অধিকাংশ গাড়ির কোনো কাগজ নেই। সব কাগজ পুলিশের কাছে। আর গাড়িতে আছে শুধু মামলার স্লিপ।
নির্দিষ্ট লাইনে গাড়ি চালনা, ওভার টেক না করা এবং ইমার্জেন্সি লাইন রাখার শিক্ষা দিয়েছিল আমাদের শিশুরা। মুমুর্ষূ রোগী যানজটে আটকা পড়ে মরছে অহরহই। অযান্ত্রিক আর যান্ত্রিক যানবাহন চলছে এক সাথে। যে রাস্তায় বাস আসে সেখানে লেগুনাও চলে। সুন্দর গণপরিবহন ব্যবস্থা হলে ব্যক্তিগত গাড়ি কেনার প্রবনতাও কমে যেত।
মহাসড়কে শৃংখলা মোটেও নেই। মানুষের পারাপারের নিরাপদ জায়গা নেই। মহাসড়কে লেইনের কোনো শৃংখলা নেই। ওভার টেকিং এর বিরুদ্ধে আইন থাকলেও প্রয়োগ নেই।অযান্ত্রিক এবং নিম্নগতির যানবাহন একসাথেই চলছে। আলাদা লেইন আমাদের দেশে রোড সিস্টেমেই নেই। সেই সাথে রাস্তার উপরে রয়েছে হাট বাজার এবং যত্রতত্র যাত্রী উঠা-নামা। এমন মহাসড়ক ব্যবস্থা আমাদের চেয়ে দরিদ্র দেশ নেপাল বা ভুটানেও আমার চোখে পড়েনি।
এসবের জন্য আসলে প্রয়োজন গোটা সিস্টেমেই পরিবর্তন আনা যা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। তবে এর সাথে যারা সরাসরি জড়িত তারা যদি আন্তরিক হয় তবে এক সময় গোটা সিস্টেমেই পরিবর্তন আসবে এবং সড়কে লাশের মিছিল কমবে।তবে একটা কথা স্মরন রাখতে হবে উন্নত দেশগুলোতে এসব সিস্টেম থাকা সত্তেও দুর্ঘটনা ঘটে।সেখানেও মানুষ মারা যায়। পার্থক্য হলো সেখানে কোন কিছু ঘটলে সংশ্লিষ্টরা তার কারণ অনুসন্ধান করতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে সহযোগিতা করে,আইন নিজের হাতে তুলে নেয় না। একটি অপরাধের প্রতিবাদ করতে গিয়ে আরেকটি অপরাধ করেনা, গাড়ি ভাংচুর, অগ্নিসংযোগের মতো ঘটনার অবতারনা করে না। বিচারহীনতা থেকেই হয়তো আমাদের দেশের মানুষ দুর্ঘটনা ঘটলেই এহেন অপরাধে লিপ্ত হয়ে পড়ে। গোটা সিস্টেমে যেমন পরিবর্তন আনা প্রয়োজন তেমন প্রয়োজন আইন নিজের হাতে তুলে না নিয়ে বরং সহযোগিতা করা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন