শুক্রবার, ১৭ মে ২০২৪, ০৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ০৮ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

আগ্রাসন থেকে দেশীয় সংস্কৃতিকে বাঁচাতে হবে

কামরুল হাসান দর্পণ | প্রকাশের সময় : ৯ নভেম্বর, ২০১৮, ১২:০৫ এএম

বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন চলছে বলে বলা হলেও তা ঠেকানোর তেমন কোনো কার্যকর উদ্যোগ সরকার এবং সংস্কৃতি অঙ্গণের সাথে সংশ্লিষ্টদের মধ্যে দেখা যাচ্ছে না। এতে ভিনদেশি সংস্কৃতি বিশেষ করে ভারতীয় সিরিয়াল, কার্টুনসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আগ্রাসন বেড়েই চলেছে। দর্শক দেশীয় অনুষ্ঠান থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। তারা ভারতীয় বিভিন্ন অনুষ্ঠানের দিকেই বেশি ঝুঁকে পড়েছে। শহর ও গ্রামে যাদের টেলিভিশন আছে, সন্ধ্যার পর থেকে দেখা যায় তাদের বেশির ভাগই ভারতীয় চ্যানেল দেখছে। ভারতের এসব অনুষ্ঠানের নির্মাতারাও বাংলাদেশের দর্শকদের কথা বিবেচনা করে সুচতুরভাবে তাদের বিভিন্ন সংস্কৃতি তুলে ধরছে। বলা যায়, আমাদের সংস্কৃতির ওপর কৌশলে তারা প্রভাব বিস্তার ও আগ্রাসন চালিয়ে যাচ্ছে। আমাদের সংস্কৃতি থেকে দর্শকের মনোযোগ সরিয়ে দিচ্ছে। বলা হয়, কোনো জাতিকে ধ্বংস করতে হলে, আগে তার সংস্কৃতি ধ্বংস করে দিতে হয়। এতে উদীয়মান ভবিষ্যত তরুণ সমাজ বিভ্রান্ত হবে, তারা নিজ সংস্কৃতির পরিবর্তে অন্য সংস্কৃতির দিকে ধাবিত হবে। আমাদের সংস্কৃতির প্রধান তিনটি মাধ্যম চলচ্চিত্র, নাটক ও সঙ্গীতের দিকে নজর দিলে দেখা যাবে, এ মাধ্যমগুলো অনেকটা ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। মানুষের কাছে এ তিনটির আবেদন ও গ্রহণযোগ্যতা অনেকটাই হারিয়ে গেছে। তারা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। আশঙ্কাজনক হারে দর্শক-শ্রোতা কমে গেছে। ফলে এসব মাধ্যমের সাথে সংশ্লিষ্ট নির্মাতা, লগ্নিকারক ও শিল্পীদের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরেই হতাশা বিরাজ করছে। তারা যা কিছুই উপস্থাপন করছেন, তার বেশিরভাগই গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে না। বলা যায়, তাদের এই প্রয়াস দর্শক-শ্রোতাদের আকৃষ্ট করতে পারছে না।
দুই.
চলচ্চিত্রকে বলা হয় বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণমাধ্যম এবং সংস্কৃতি ও আনন্দ-বিনোদনের প্রধান ক্ষেত্র। এটিকে ‘কম্বিনেশন অব অল আর্টস’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। একটি চলচ্চিত্রে মানুষের জীবনধারাসহ সংস্কৃতির সবকটি শাখার সমন্বয় ঘটানো হয়। মানুষের সূাতিসূ অনুভূতি তুলে ধরা থেকে শুরু করে আনন্দ-বেদনা, সুখ-দুঃখ, নৃত্য-গীত এমনভাবে তুলে ধরা হয়, যাতে দর্শক আন্দোলিত হয়। আমোদিত-বিনোদিত হওয়ার পাশাপাশি জীবনবোধ সম্পর্কে একটি বার্তা পায়। মূল মেসেজটি থাকে ভালর জয়, মন্দের পরাজয়। আমাদের দেশের চলচ্চিত্রে এক সময় এ ধারাটি বেশ ভালভাবেই ছিল। পারিবারিক এবং সামাজিক নীতি-নৈতিকতা ও মূল্যবোধ এবং দেশাত্মবোধকে প্রাধান্য দিয়ে চলচ্চিত্রগুলো নির্মিত হতো, যা আমাদের বোধকে দৃঢ় হতে সহায়তা করত। বিগত দুই দশকের চলচ্চিত্রের দিকে নজর দিলে দেখা যাবে, আমাদের সমৃদ্ধ চলচ্চিত্র ক্রমেই তার চিরায়ত চরিত্র হারিয়ে ফেলেছে। তাতে আমাদের সমাজ, পরিবার ও সংস্কৃতির যথাযথ উপস্থাপন নেই। বলাবাহুল্য, সময়ের সাথে সবকিছু বদলায়, মানুষের মানসিকতা ও জীবনধারায় পরিবর্তন আসে। প্রযুক্তি উৎকর্ষের এ যুগে সারা বিশ্ব মানুষের হাতের মুঠোয়। কোথায় কি হচ্ছে, ঘটছে মুহূর্তে সবকিছু জানতে পারছে। বিভিন্ন দেশের সংস্কৃতি সম্পর্কে জানছে। সেখান থেকে তথ্য গ্রহণ করছে, প্রভাবিতও হচ্ছে। প্রযুক্তির এই উৎকর্ষ অস্বীকার করা যাবে না। তার মানে এই নয়, নিজস্ব সংস্কৃতি ভুলে গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দিতে হবে। চিরায়ত নিজস্ব সংস্কৃতি থেকে দূরে সরে যেতে হবে। দুঃখের বিষয়, মানুষের মধ্যে এ প্রবণতাটা এখন বেশি দেখা যাচ্ছে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় মাধ্যম হিসেবে যে চলচ্চিত্রের অগ্রণী ভূমিকা পালন করার কথা, তা করতে পারছে না। উল্টো চলচ্চিত্রের মূল ধারার অধিকাংশ নির্মাতা অনেকটা অপসংস্কৃতির প্রবাহের সাথে যুক্ত হচ্ছেন। সাংস্কৃতিক যে আগ্রাসন চলছে, তারাও তার সমার্থক হয়ে উঠছেন। বিদেশি চলচ্চিত্র বিশেষ করে ভারতের চলচ্চিত্রের অনুকরণ করতে গিয়ে দেশের সংস্কৃতির কথা ভুলে যাচ্ছেন। নিজস্ব বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা ও চিন্তার প্রতিফলন ঘটাতে পারছেন না। প্রায় প্রত্যেকেই ভারতীয় চলচ্চিত্রের অন্ধ অনুকরণ করে চলছেন। তারা ভারতীয় চলচ্চিত্রের রেডিমেইড চিন্তার প্রতিফলন ঘটাচ্ছেন। দেশীয় সংস্কৃতির মধ্যে থেকে মৌলিক চিন্তার বিকাশ ঘটাতে ব্যর্থ হচ্ছেন। এর ফলে যা হচ্ছে, তা হলো, দর্শক এসব সিনেমা প্রত্যাখ্যান করছে। তারা সিনেমা হল বিমুখ হয়ে পড়েছে। দর্শক ভালো করেই জানে, নির্মাতারা যে সিনেমা উপহার দিচ্ছেন, তা ভারতীয় সিনেমা নকল করে করা হয়েছে এবং ইতোমধ্যে তারা তা দেখে ফেলেছে। সঙ্গতকারণেই দুর্বলভাবে ভারতীয় সিনেমার বাংলা ভার্সনে নির্মিত সিনেমা তারা কেন দেখবে? স্বাভাবিকভাবেই দর্শক হল বিমুখ হবে। অথচ এক সময় আমাদের ছোট্ট এই দেশে প্রায় চৌদ্দশ’র বেশি সিনেমা হল ছিল। এখন তা কমে আড়াই তিনশ’তে নেমেছে। যে দেশে চৌদ্দশ’র মতো সিনেমা হল থাকে, সে দেশের মানুষ কতটা সংস্কৃতিমনা তা বুঝিয়ে বলার অবকাশ থাকে না। এ বিষয়টি যদি আমাদের চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টরা চিন্তা করে দেখতেন, তাহলে চলচ্চিত্র এই দুর্দশার মধ্যে পড়ত না। আর দর্শক কী ধরনের সিনেমা দেখতে চায়, নির্মাতারা যদি এ বিষয়টি গভীর পর্যবেক্ষণ এবং জরিপ করে চলচ্চিত্র নির্মাণ করতেন, তাহলে চলচ্চিত্র ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছত না। তাদের এ দুর্বলতার কারণে ভারতের নির্মাতারা বিশেষ করে কলকাতার নির্মাতারা তাদের সিনেমা আমাদের দেশে চালানোর জন্য জোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এর সাথে আমাদের কিছু সংখ্যক নির্মাতা ও হল মালিক যুক্ত হয়েছেন। তারা কলকাতার সিনেমা আমদানি করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছেন। তাদের যুক্তি, কলকাতার সিনেমা চালালে সিনেমা হলে দর্শক হুমড়ি খেয়ে পড়বে এবং এতে এক ধরনের প্রতিযোগিতা সৃষ্টি হবে। দেশীয় সিনেমার নির্মাতারা কলকাতার সিনেমার সাথে প্রতিযোগিতা করবে এবং এতে ভাল সিনেমা নির্মিত হবে। অবশ্য ওইসব হল মালিক ও প্রযোজকের এ ধরনের খোঁড়া যুক্তি খুব একটা কাজে আসেনি। তারা কলকাতার পুরনো চলচ্চিত্র আমদানি করে প্রদর্শন করেও দর্শকদের সাড়া পাননি। এ থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না, বাংলাদেশের দর্শক আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতির সিনেমা দেখতে চায়। তারা চায়, উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে মৌলিক গল্পের দেশীয় সিনেমা। এর উদাহরণও রয়েছে। শিল্পপতি, নায়ক-প্রযোজক অনন্ত জলিল নিজ উদ্যোগে উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে যে কয়টি সিনেমা নির্মাণ করেছেন দেখা গেছে, তার সিনেমাগুলো ব্যাপক সাফল্য লাভ করেছে। সিনেমাপ্রেমী তরুণ প্রজন্ম থেকে শুরু করে সবশ্রেণীর দর্শকই সিনেমাগুলো দেখেছেন। এ থেকে প্রতীয়মান হয়, আমাদের দেশীয় সংস্কৃতির সাথে প্রযুক্তির সমন্বয় ঘটিয়ে যদি সিনেমা নির্মাণ করা যায়, তবে তা দর্শক-গ্রহণযোগ্যতা পায়। অনন্তের এই দৃষ্টান্ত স্থাপন থেকে আমাদের অন্যান্য নির্মাতাদেরও উপলব্ধির বিষয় রয়েছে। তবে কেউ কেউ তা না করে যৌথ প্রযোজনার নামে এ দেশে ভারতীয় সিনেমার বাজার সৃষ্টির জন্য তৎপর হয়ে উঠেছেন। যৌথ প্রযোজনার ক্ষেত্রে একটি চলচ্চিত্রের কলাকুশলী থেকে শুরু করে অন্যান্য ক্ষেত্রে ফিফটি-ফিফটি সুযোগের বিধান থাকলেও, তা তারা মানছেন না। তারা এক-দুজন দেশের নায়ক বা নায়িকা নিয়ে বেশিরভাগ ভারতীয় শিল্পী ও কলাকুশলী দিয়ে সিনেমা নির্মাণ করেন। এসব সিনেমায় ভারতীয় সংস্কৃতিকেই প্রাধান্য দেয়া হয়। আমাদের দেশের চিরায়ত সংস্কৃতির উপস্থিতি থাকে না বললেই চলে। তাদের এ প্রবণতাকে ইতোমধ্যে চলচ্চিত্র বোদ্ধারা দেশীয় চলচ্চিত্র ধ্বংসের সুগভীর চক্রান্ত হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। অবশ্য সরকার যৌথ প্রযোজনার নীতিমালা করায় এ প্রবণতা এখন অনেকটাই কমেছে। এখন আমাদের দেশের নির্মাতাদের উচিত উদ্যোগী হয়ে দেশীয় সংস্কৃতিনির্ভর সিনেমা উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে চলচ্চিত্র নির্মাণে আগ্রহী হয়ে উঠা। চলচ্চিত্রকে গতিশীল করতে একের পর এক চলচ্চিত্র নির্মাণ করা। পাশাপাশি হল মালিকদের উচিত সিনেমা হল সংস্কার করে আধুনিক করা এবং এক্ষেত্রে সরকারেরও এগিয়ে আসা।
তিন.
আশির দশকের দিকে আমাদের টেলিভিশন নাটক ভারতের দর্শকরা এন্টেনা লাগিয়ে দেখতো। বাংলাদেশের নাটক দেখে মুগ্ধ হয়ে যেত। এখন স্যাটেলাইট চ্যানেলের এ যুগে উল্টোচিত্র দেখা যাচ্ছে। আমাদের কোটি কোটি দর্শক ভারতীয় বাংলা চ্যানেলের নাটক দেখার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। দুপুর থেকে রাত অবধি যদি ঘরে ঘরে জরিপ চালানো হয়, তবে দেখা যাবে দর্শক ভারতীয় বাংলা ও হিন্দি সিরিয়ালগুলো দেখার জন্য টেলিভিশনের সামনে বসে রয়েছে। এমনকি এসব সিরিয়ালের গল্প এবং আগামী পর্বে কী ঘটতে যাচ্ছে, তা নিয়ে তাদের তর্ক-বিতর্ক করতেও দেখা যায়। ইতোমধ্যে সিরিয়ালগুলোতে নায়িকারা কী ধরনের পোশাক পরেছে, সেসব পোশাকের অনুকরণের পোশাক পরার সংস্কৃতিও চালু হয়ে গেছে। ঈদে সিরিয়ালের নায়িকা চরিত্রের নামে তৈরি এসব পোশাক ভারত থেকে আমদানি করে দেদারছে বিক্রিও করা হচ্ছে। ভারতীয় সিরিয়ালের প্রতি আমাদের দর্শকের এই আকর্ষণের কারণে দেশীয় বড় বড় কোম্পানি সেসব চ্যানেলে বিজ্ঞাপনও দিচ্ছে। অর্থাৎ ভারতীয় সিরিয়ালগুলো একদিকে যেমন আমাদের দর্শক আকৃষ্ট করছে, অন্যদিকে ব্যবসাও করে নিচ্ছে। আর আমাদের চ্যানেল ও নির্মাতারা কি করছে? কেন আমাদের সিরিয়ালগুলো দর্শক টানতে পারছে না? বিস্ময়ের বিষয় হচ্ছে, আমাদের চ্যানেলগুলোতে প্রতিদিন প্রায় একশ’ সিরিয়াল প্রচার হলেও ব্যাপক সংখ্যক দর্শক এসব সিরিয়ালের নামও জানে না। ভারতীয় সিরিয়ালের মতো আমাদের কোনো সিরিয়াল নিয়ে গল্প করতে দেখা যায় না। বাংলাদেশের নাটকের এ অবস্থা হলো কেন? ব্যাপক সংখ্যক দর্শক কেন এসব সিরিয়াল দেখছে না? আমাদের দেশের নাটক কি মেধাশূন্যতার কবলে পড়েছে? এসব প্রশ্নের উত্তরে অনেক কথা বলা যায়। তবে নির্মাতারা যে কারণটিকে সবচেয়ে বড় করে দেখাচ্ছেন, তা হলো নাটকের বাজেটস্বল্পতা। আমাদের চ্যানেলগুলো প্রতি পর্বের জন্য গড়ে যে পঞ্চাশ-ষাট হাজার টাকা বাজেট বরাদ্দ করে, তা দিয়ে ভাল মানের নাটক নির্মাণ কোনোভাবেই সম্ভব নয়। বলা হয়, ভারতীয় সিরিয়ালের এক পর্বের জন্য যে খরচ হয়, তা দিয়ে আমাদের দেশের একটি সিরিয়ালের দশ থেকে পনের পর্ব পর্যন্ত নির্মাণ করা যায়। এ যদি হয় পরিস্থিতি, তাহলে ভাল মানের সিরিয়াল নির্মিত হবে কিভাবে? তবে নির্মাতাদের এ কথাটিও স্মরণ রাখা প্রয়োজন, আমাদের দেশে মমতাজ উদ্দিন আহমদ, বেগম মমতাজ, আবদুল্লাহ আল মামুন, মামুনুর রশিদ, হূমায়ুন আহমেদ, ইমদাদুল হক মিলনের মতো প্রথিতযশা নাট্যকার-নির্মাতাদের নাটকও অনেক কম বাজেটে নির্মিত হয়ে দর্শকপ্রিয়তার তুঙ্গে উঠেছিল। এর মূল কারণই হচ্ছে, তাদের গল্প। গল্পই ছিল তাদের প্রধান নায়ক। তারা আমাদের চিরায়ত পারিবারিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে অতিপরিচিত ঘটনাকে নাটকীয়ভাবে তুলে ধরতেন। দর্শকও তার মন ও মননের সাথে মিল পেত। এ থেকে বিনোদনের পাশাপাশি করণীয়-বর্জনীয় বিষয়গুলোও শিখতে পারত। এক হূমায়ুন আহমেদের কথাই যদি বলা হয়, তাহলে দেখা যাবে, তার এইসব দিন রাত্রি, অয়োময়, দূরে কোথাও, আজ রবিবারের মতো ধারাবাহিকগুলো কী অসামান্য জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। এসব উদাহরণতো আমাদের সামনে রয়েছে। এগুলো কি এ সময়ের নির্মাতাদের কাছে প্রেরণা হতে পারে না? এ সময়ে যারা নাটক নির্মাণ করছেন, তারা আমাদের চিরায়ত পারিবারিক ও সামাজিক ব্যবস্থাকে সঠিকভাবে যেমন তুলে ধরতে পারছেন না, তেমনি মেধাও খাটাচ্ছেন না। আধুনিকতার নামে অত্যন্ত হাল্কা-পল্কা বিচ্ছিন্ন ঘটনাকে জোড়াতালি দিয়ে উপস্থাপন করছেন। তাতে না আছে সুষম পারিবারিক বন্ধনের কথা, না আছে সামাজিক দায়িত্ববোধের কথা। ভারতীয় সিরিয়ালগুলোতে তারা তাদের পারিবারিক, সামাজিক এমনকি ধর্মীয় বিষয়গুলো সুদৃঢ় গল্প বিন্যাসের মাধ্যমে অত্যন্ত সূচারুভাবে তুলে ধরছে। আমাদের দেশের বেশিরভাগ সিরিয়ালের গল্পই খুঁজে পাওয়া যায় না। সিরিয়ালের অর্ধেক শেষ হয়ে গেলেও গল্পের রেখাচিত্র দর্শক দেখতে পায় না। এ অবস্থা হলে দর্শক কেন দেখবে? এ বিষয়গুলো নিয়ে নির্মাতাদের ভাবতে হবে। আমাদের দেশে যে মেধাবী নাট্যকার ও সাহিত্যিক নেই এমন নয়। তবে যারা নাটক নির্মাণ করেন এবং যেসব চ্যানেল তা প্রচার করে তাদেরকে ঐসব গুণী নাট্যকার ও সাহিত্যিকদের কাছে যেতে দেখা যায় না। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, নাটকের ক্ষেত্রেও ভারতীয় সিরিয়ালের অনুকরণ ও নকল করার অভিযোগ উঠেছে। আমাদের নির্মাতারা আমাদের দেশীয় সংস্কৃতিকে উপেক্ষা করে চলেছেন। তারা এদিকে নজরই দিচ্ছেন না এবং এ নিয়ে চিন্তাও করছেন না।
সঙ্গীতের কথা যদি ধরা হয়, তাহলে দেখা যাবে, এখানেও দৈন্যদশা চলছে। অনেক গান হচ্ছে, তবে সেগুলো শ্রোতাদের আকর্ষণ করতে পারছে না। কিছু গান আকর্ষণ করলেও তা ওয়ানটাইম হয়ে যাচ্ছে। শ্রোতাদের মনে সুগভীর প্রভাব ফেলতে পারছে না। এখানেও গানের বাণীর ক্ষেত্রে চিন্তা-ভাবনার অভাব এবং একই ধারার সুর ও সুরের নকল করার প্রবণতা রয়েছে। বাণীপ্রধান গানের পরিবর্তে চটুল কথার গানকে প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে বেশি। সঙ্গীতের ক্ষেত্রে এটা যেমন একটি সমস্যা তেমনি ভারতীয় শিল্পীদের আমাদের দেশে এনে বিরাট আয়োজন করে কনসার্ট করার বিষয়টিও সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। আমরা বেশ কয়েক বছর ধরে দেখছি, এক শ্রেণীর আয়োজক ভারতীয় শিল্পীদের এনে লাইভ কনসার্টের আয়োজন করছেন। সেখানে বাংলাদেশের শিল্পীদের নামকাওয়াস্তে রাখা হয়। টেলিভিশন চ্যানেলেও তাদের লাইভ সঙ্গীতানুষ্ঠান প্রচার করা হচ্ছে, যা ভারতের কোনো চ্যানেলে কল্পনাও করা যায় না। এ নিয়ে আমাদের শিল্পীদের মধ্যে আক্ষেপ ও আপসোস থাকলেও তাতে আয়োজকদের মধ্যে কোনো প্রভাবই ফেলে না। আমাদের সঙ্গীতের সমৃদ্ধতা নিয়ে প্রশ্নের অবকাশ নেই। এ এক অসামান্য ভান্ডার। এই ভান্ডার ফেলে আমাদের একটি শ্রেণী বিদেশি সঙ্গীতশিল্পী বিশেষ করে ভারতীয় শিল্পীদের প্রতি অতি আগ্রহ দেখাচ্ছে। সেটা কনসার্ট হোক কিংবা সিনেমার প্লেব্যাকে হোক-সমান তালে তাদের পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে যাচ্ছে। এ ধরনের অতিমাত্রিক প্রবণতা বিশ্বে আর কোথাও দেখা যায় না।
চার.
সাংস্কৃতিক আগ্রাসন নিয়ে অনেক আলোচনা ও তর্ক-বিতর্কের সুযোগ রয়েছে। আমরা চাই, এই আলোচনা ও তর্ক-বিতর্ক শুরু হোক। দেশীয় সংস্কৃতিকে বিদেশি সংস্কৃতির আগ্রাসন থেকে বাঁচাতে এর প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। আমাদের কথা হচ্ছে, সাংস্কৃতিক আগ্রাসন ঠেকাতে আমাদের চলচ্চিত্র, নাটক, সঙ্গীতের দুর্দশা কাটাতে এ সংশ্লিষ্ট সবাইকে ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা চালাতে হবে। এ ক্ষেত্রগুলোতে যেসব সমস্যা বিদ্যমান সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে বিশেষ করে সরকারকে সিরিয়াসলি দৃষ্টি দিতে হবে। এ সংশ্লিষ্ট যেসব সংগঠন রয়েছে, তাদের সাথে আলাপ-আলোচনা করে সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নিতে হবে। সমস্যা চিহ্নিত হয়ে আছে। এসব সমস্যা আমলে নিয়ে সমাধানে আন্তরিক না হলে কোনোভাবেই দেশীয় সংস্কৃতিকে আগ্রাসনের হাত থেকে রক্ষা করা যাবে না। আগামী প্রজন্মের স্বার্থেই সরকারকে এ ব্যাপারে দৃষ্টি দিতে হবে। চলচ্চিত্র উন্নয়নে প্রযুক্তি সুবিধার বিষয়টি নিশ্চিতের পাশাপাশি সিনেমা হলগুলো আধুনিকায়ণের ব্যবস্থা করে দিতে হবে। পাইরেসি প্রতিরোধে আধুনিক যে ব্যবস্থা রয়েছে, তা অবলম্বনে করতে হবে। নির্মাতাদেরও দেশীয় সংস্কৃতি এবং আত্মপরিচয়ের মধ্যে থেকেই যুগোপোযোগী সিনেমা নির্মাণ করতে হবে। দেশের নাটকের প্রতি দর্শক আকর্ষণ বৃদ্ধি করতে সর্বাগ্রে চ্যানেলগুলোকে সচেতন হতে হবে। এজন্য বাজেট বৃদ্ধি থেকে শুরু করে প্রয়োজনীয় সহায়তা করতে হবে। সরকারের উচিত হবে যেসব চ্যানেলে ভারতীয় বাংলা ও হিন্দি চ্যানেলে সিরিয়াল প্রচার করা হয় দেশীয় নাটকের স্বার্থে সেসব চ্যানেলে তার প্রচার বন্ধ করে দেয়া। ভারতীয় সঙ্গীতশিল্পীদের নিয়ে কনসার্ট আয়োজনের ক্ষেত্রে নীতিমালার আলোকে কড়াকড়ি শর্ত আরোপ করা জরুরি। আয়োজন করলেও বাংলাদেশের শিল্পীদের সমান সুযোগের বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। উদ্যোক্তাদের উচিত হবে বিদেশী গান ও শিল্পীদের প্রতি আগ্রহী না হয়ে দেশীয় গান ও শিল্পীদের প্রতি আগ্রহী হওয়া। দেশের স্বার্থে ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসন ঠেকাতে তাদের এ কাজটি করতে হবে। দেশীয় সংস্কৃতিকে ধরে রাখতে মাল্টিন্যাশনাল যেসব প্রতিষ্ঠান রয়েছে, তাদের আরও বেশি পৃষ্ঠপোষকতা দেয়ার জন্য এগিয়ে আসতে হবে।
darpan.journalist@gmail.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন