আরবি হিজরী সনের তৃতীয় মাস রবিউল আওয়াল। রবিউল আওয়াল মাস মুসলিম মিল্লাতের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও ফজিলতের মাস। কারণ এ মাসেই বিশ্বনবী মোহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা.) এ ধরাতে শুভাগমন করেন এবং ওফাত লাভ করেন। বিশ্বনবী মোহাম্মদ (সা.) এমন একসময় দুনিয়াতে শুভাগমন করেন, যখন দুনিয়াব্যাপী ছিল গোমরাহি, পথভ্রষ্টতায় নিমজ্জিত।
৫৭০ খ্রিষ্টাব্দ ক্বাবা শরিফ ধ্বংস করার জন্য আসহাবে ফিল (হস্তিবাহিনী) আক্রমণ করে। ওই বছর রবিউল আওয়াল মাসে ১২ তারিখ সোমবার দুনিয়ার ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ও উল্লেখযোগ্য দিন। কারণ ওই দিনই হুজুর (সা.) জন্মগ্রহণ করন।
হুজুর (সা.) জন্মের পূর্ব থেকেই এমন কিছু অলৌকিক ঘটনা ঘটতে থাকে, যা ছিল মূলত হুজুর (সা.) আগমনের পূর্বাভাস। মোহাম্মদ (সা.) জন্মের পূর্বে পারস্য দেশে কিসরার রাজপ্রাসাদে এক কম্পন অনুভ‚ত হয়। যার ফলে প্রাসাদের ১৪টি গম্বুজ ধ্বংস হয়ে যায়। পারস্যের যে অগ্নিকান্ড এক হাজার বছরে কখনো নির্বাপিত হয়নি তা নিজে নিজেই নিভে যায়। হুজুর (সা.) মাতৃগর্ভ থাকাকালীনই মা আমিনা স্বপ্নে দেখেন যে, একজন ফেরেশতা এসে তাকে বলছেন, তোমার গর্ভে থাকা সন্তান ভ‚মিষ্ঠ হওয়ার পর তার নাম যেন আহমদ রাখা হয়। এ জন্য মা সদ্য ভ‚মিষ্ঠ শিশুর নাম রাখলেন আহমদ। দাদা আব্দুল মুত্তালিব তার প্রিয় পৌত্রের নাম রাখলেন মোহাম্মদ। জন্মের পর প্রথম সাতদিন আবুলাহাবের আযাদকৃত দাসী সুওয়াইবা হুজুর (সা.)-কে দুধ পান করান। জন্মের অষ্টমদিন আরবের অভিজাত বংশের প্রথা অনুযায়ী তাকে ধাত্রী হালিমা সাদিয়ার হাতে অর্পণ করা হয়, যেন তিনি তাকে স্তন্যপান করান এবং লালন পালন করেন। শিশু মোহাম্মদ (সা.) আরবের অন্যান্য শিশুদের থেকে সম্পূর্ণ সতন্ত্র ছিল। খেলাধুলা বা অহেতুক সকল কর্মকান্ড থেকে নিজেকে বিরত রাখতেন। শুধু বিরতই রাখতেন না বরং এ সকল কর্মকান্ড থেকে এড়িয়ে থাকতেন। প্রিয় নবী মোহাম্মদ (সা.) সমগ্র বিশ্বের মানবজাতির পথ প্রদর্শকের জন্য প্রেরিত হয়েছেন। তিনি সর্বকালের সকল মানুষের জন্য একমাত্র আদর্শরূপে আগমন করেছেন। মানবজাতির সার্বিক কল্যাণের ফর্মুলা তিনি বিশ্ববাসীর সামনে উপস্থাপন করেছেন। তিনি ঘরের কাজ নিজেই করতেন, বাজার থেকে প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি নিয়ে আসতেন, জুতা ছিড়ে গেলে নিজেই তা সেলাই করতেন, নবী হিসেবে প্রধান সংস্কারক, প্রধান বিচারক, প্রধান সমরনায়ক, আদর্শ স্বামী, আদর্শ পিতা, আদর্শ ব্যবসায়ী, আদর্শ রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে রাসূল (সা.)-এর মধ্যে যাবতীয় মানবীয় গুণাবলির বিপুল সমাবেশ হয়েছিল।
সীমাহীন গুণাবলির অধিকারী হয়ে ও তিনি সাদামাটা জীবনযাপন করেছেন। সামান্যতম অহঙ্কার কিংবা বড়ত্ব তার মাঝে ছিল না। একবার এক ব্যক্তি রাসূল (সা.)-এর দরবারে উপস্থিত হলেন, রাসূল (সা.) কে দেখামাত্র লোকটি কাপতে লাগল। রাসূল (সা.) তাকে অভয় দিয়ে বললেন, ভীতসন্ত্রস্ত হয়ো না। আমি কুরাইশ বংশের এক মহিলার পুত্র মাত্র। যিনি শুকনো গোশত পাক করে আহার করতেন।
রাসূল (সা.) মানবজাতিকে নির্দেশ দিয়েছেন, তোমরা এক আল্লাহর এবাদত করবে, তার সাথে কাউকে শরিক করবে না, তিনি আরো নির্দেশ দিয়েছেন পরোপকারের, সার্থপরতা পরিহার করার। তিনি তার আদর্শের দ্বারা এমন এক সোনালি সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যার মূল বৈশিষ্ট্য ছিল সুবিচার, পরস্পরে সহানুভ‚তি এবং মমত্ববোধ। যার কারণে তার জীবদ্দশায় বিশৃঙ্খলতায় জর্জড়িত আরব হয়ে উঠে সম্প্রীতি ও শান্তির প্রতিক। মোহাম্মদ (সা.)-এর দৃষ্টিতে জুলুম, অত্যাচার বড় পাপকার্য। অত্যাচারিত মজলুম, অসহায় মানুষদের সাহায্য করা হুজুর (সা.)-এর নিকট এক মহান ইবাদত। তৎকালীন আরব জাতি তার আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে তার জন্য জীবন পর্যন্ত বিলিয়ে দিতে সদাসর্বদা প্রস্তুত থাকত। তাকে ভালোবাসতো পাগলের মতো। মোহাম্মদ (সা.)-এর ১০ বছরের খাদেম হজরত আনাস (রা.) বলেন, আমি দেখেছি, রাসূল (সা.)-এর চুল মোবারক যখন কাটা হতো, সাহাবায়ে কেরাম তখন তার চারপাশে দাঁড়িয়ে থাকতেন। একটি চুল মাটিতে পড়া মাত্র তারা দ্রুতবেগে তা তুলে নিতেন এবং বরকতের জন্য তা তাদের নিজেদের কাছে রেখে দিতেন। অধিনস্থদের প্রতি হুজুর (সা.) ব্যবহার ছিল অতি উত্তম। হজরত আনাস (রা.) বলেন, আমি প্রায় ১০ বছর হুজুরের খেদমত করেছি। আল্লাহর শপথ, আমি বাড়িতে অথবা সফরকালে রাসূল (সা.)-এর যে পরিমাণ খেদমত করেছি, তার চেয়ে অধিক খেদমত হুজুর (সা.) আমার করেছেন। ১০ বছর যাবত খেদমতে হুজুর (সা.) অসন্তুষ্ট হয়ে উহ শব্দটি পর্যন্ত করেননি। কোনো সময় যদি কাজ করতে ভুলে যেতাম, তা হলে তিনি বলেননি যে একাজটি কেন করোনি। মোহাম্মদ (সা.) এই পৃথিবীতে কিভাবে জীবন যাপন করেছেন, তার জীবন পরিচালনার পদ্ধতি কিরূপ ছিল, পারিবারিক জীবনে তিনি কেমন ছিলেন, স্ত্রীদের সাথে তার ব্যবহার কেমন ছিল, সবকিছুই আল্লাহ তায়ালা কিয়ামত পর্যন্ত আগত উম্মতের আমলের সুবিধার্থে সংরক্ষণ করে রেখেছেন সাহাবায়ে কেরামদের মাধ্যমে। হুজুর (সা.) এমন অদ্বিতীয় ব্যক্তি যার বংশ তালিকা ও আমাদের মাঝে সংরক্ষিত। তার বংশের তালিকা হলো- মোহাম্মদ ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে আব্দুল মুত্তালিব ইবনে হাশেম ইবনে আব্দে মানাফ ইবনে কুসাই ইবনে কিলাব ইবনে মুররাহ ইবনে কা’ব ইবনে লুআই ইবনে গালেব ইবনে ফিহর ইবনে মালিক ইবনে নযর ইবনে কিনানা ইবনে খুযাইমা ইবনে মুদরিকাহ ইবনে ইলিয়াস ইবনে মুযার ইবনে নাযযার ইবনে মা’বাদ ইবনে আদনান। এ পর্যন্ত সমস্ত ইতিহাসবিদ একমত তাই এরপর মতবিরোধ থাকায় সতর্কতা অবলম্বনে আর না লেখাই উত্তম। শুধু হুজুর (সা.)-এর বংশ তালিকাই নয়, বরং হুজুর (সা.)-এর ছাগলগুলোর নাম এবং উটগুলোর নাম ও ইতিহাসের পাতায় সংরক্ষিত রয়েছে। হুজুর (সা.)-এর ৯টি ছাগল ছিল যা থেকে দুধ সংগ্রহ করা হতো। ওই ছাগলগুলোর নাম হলো- আজওয়াহ, সাকিয়্যাহ, যমযম, বারাকাহ, ওয়ারাছাহ, ইতলাল, আতরাফ, গিফাহ, ও উমরাহ। এই ৯টি বকরি ছিল। আর একটি পুরুষ ছাগল ছিল। যার নাম ইউমন। হুজুর (সা.) উটগুলোর নাম হলো আদবা, শাহবা, জাদআ ও কাসওয়া। হুজুর (সা.)-এর দুটি খচ্চর ছিল, যার নাম দুলদুল ও আফির। তার বাহন যে গাধাটি ছিল তার নাম ইয়াফুর। যে সকল ঘোড়ার উপর তিনি আরোহণ করতেন তা হলো- সাকাব, সাবহা, লাহিফ ও তাররায।
আল্লাহ রাব্বুল আলামিন পবিত্র আল কুরআনে ঘোষণা করেছেন- হে নবী! আপনি বলুন, তোমরা যদি আল্লাহকে ভালোবাসতে চাও তা হলে আমার (মোহাম্মদ সা.)-এর অনুসরণ করো। তা হলে আল্লাহ তোমাদিগকে ভালোবাসবেন। আর আল্লাহ তোমাদের গুনাহসমূহকে ক্ষমা করে দেবেন, কারণ আল্লাহ তায়ালাই একমাত্র ক্ষমা প্রদর্শনকারী (আল কুরআন)। বিশ্বনবী মোহাম্মদ (সা.) বলেন, তোমরা ততক্ষণ পর্যন্ত পরিপূর্ণ মু’মিন হতে পারবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত আমি নবী মোহাম্মদ (সা.) তোমাদের নিকট তোমাদের পিতা-মাতা, ছেলেমেয়ে এবং সকল মানুষ থেকে অধিক প্রিয় ও ভালোবাসার না হয়ে উঠব। রাসূল (সা.)-এর সাথে যদি ভালোবাসার সম্পর্ক থাকে, তা হলে কিয়ামতের দিন তার সাথেই হাশর হবে।
বুখারি শরিফে এক হাদিসে আছে যে, এক সাহাবি রাসূল (সা.)-এর নিকট এসে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! কিয়ামত কবে হবে? রাসূল (সা.) তাকে পাল্টা প্রশ্ন করে বললেন, কিয়ামত কবে হবে জিজ্ঞাসা করছো, কিয়ামতের জন্য তুমি কি প্রস্তুতি গ্রহণ করেছ? উত্তরে সে বলল, নামাজ-রোজা একটা তেমন বেশি আমার নেই, কিন্তু আমি আপনাকে ভালোবাসি। হুজুর (সা.) তখন তাকে বললেন, যে যাকে ভালোবাসে, তার সাথে তার হাশর হবে। মোহাম্মদ (সা.) ছিলেন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানুষ। রূপ সৌন্দর্যের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন অদ্বিতীয়। চারিত্রিক মাধুর্যতায় তার আসন সকলের উপরে। বিশ্বব্যাপী আজ দাবানলের মতো দাউদাউ করে অশান্তির আগুন জ্বলছে। কোথাও আজ শান্তির লেশমাত্র নেই। মানুষের জান-মালের নিরাপত্তা নেই। মারামারি, কাটাকাটি নিত্যদিনের সঙ্গী।
দুনিয়াব্যাপী শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হলে আমাদের সকলকে বিশ্বনবী মোহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর আদর্শ ব্যক্তিপর্যায় থেকে শুরু করে সকল স্থরে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এর বিকল্প কোনো ব্যবস্থাই দুনিয়াবাসীকে শান্তি দিতে পারবে না।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন