শুক্রবার, ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১, ০১ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

ইসলামী জীবন

কর্মমুখী জীবনের তাগিদ দেয় ইসলাম ধর্ম

মুহাম্মদ আতিকুর রহমান | প্রকাশের সময় : ৩০ নভেম্বর, ২০১৮, ১২:০৩ এএম

কর্মের তাগিদে চঞ্চল আজ বিশ্ব। অনুন্নত থেকে উন্নত বিশ্ব সবখানেই কর্মমুখী মানুষের কর্মতৎপরতা। তাইতো পরিবার, সমাজ, শিক্ষা, সংস্কৃতিতে কর্মের তাগিদ বৃদ্ধি পাচ্ছে। কেননা কর্ম ছাড়া দেশ-জাতির উন্নয়ন সম্ভব নয়। বাংলাদেশও তার বিশাল কর্মযজ্ঞের কারণেই বিশ্বে রোল মডেল হয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্ম ইসলাম। যে ধর্মের প্রতিটি বিধানের মূলে রয়েছে কর্ম ও কর্ম তৎপরতা। যদিও অনেকরই এ ধর্ম সম্পর্কে জ্ঞান না থাকার কারণে একে ‘পরকালমুখী কর্মবিমুখ ধর্ম’ হিসেবে উল্লেখ করে থাকেন, কিন্তু ইসলামের বিধান পর্যালোচনা করলে একে বাস্তববাদী ও কর্মমুখী ধর্ম বলেই প্রতিয়মান হয়। আল-কুরআনে আল্লাহ তাআলা মুসলমানদেরকে উত্তম জাতিকে হিসেবে উল্লেখ করে তাদেরকে সৎ কর্মের আদেশ ও অসৎ কর্মের নিষেধাজ্ঞ প্রদান করেছেন এবং তিনি প্রত্যেককেই শেষ বিচারের দিন ‘অনু’ পরিমান কর্মেরও ফলাফল প্রদান করবেন। ইসলামী বিধানে দুনিয়াকে আখেরাতের “কর্মক্ষেত্র” উল্লেখ করে তার অনুসারীদের উত্তম কর্মের মাধ্যমে উভয় জগতের কল্যাণ সাধনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আল-কুরআনের বিভিন্ন স্থানে আল্লাহ তাআলা কর্ম, মালিক-শ্রমিকের বৈশিষ্ট্য ও পারিশ্রমিকের বিষয়ে উল্লেখ করেছেন। যেমন হযরত মুসা আ. এর মাদয়ান নগরীতে গমনের পর তার কর্ম তৎপরতার উল্লেখ করে ইরশাদ করা হয়েছে, “অতঃপর নারীদ্বয়ের একজন লাজুকভাবে হেঁটে তার কাছে এসে বলল যে, আমার পিতা আপনাকে ডাকছেন, যেন তিনি আপনাকে পারিশ্রমিক দিতে পারেন, আমাদের পশুগুলোকে আপনি যে পানি পান করিয়েছেন তার বিনিময়ে। অতঃপর যখন মূসা তার নিকট আসল এবং সকল ঘটনা তার কাছে খুলে বলল, তখন সে বলল, তুমি ভয় করো না। তুমি যালিম কওম থেকে রেহাই পেয়ে গেছ। নারীদ্বয়ের একজন বলল, ‘হে আমার পিতা, আপনি তাকে মজুর নিযুক্ত করুন। নিশ্চয় আপনি যাদেরকে মজুর নিযুক্ত করবেন তাদের মধ্যে সে-ই উত্তম, যে শক্তিশালী ও বিশ্বস্ত’। সে বলল, ‘আমি আমার এই কন্যাদ্বয়ের একজনকে তোমার সাথে বিয়ে দিতে চাই এই শর্তে যে, তুমি আট বছর আমার মজুরী করবে। আর যদি তুমি দশ বছর পূর্ণ কর, তবে সেটা তোমার পক্ষ থেকে (অতিরিক্ত)। আমি তোমাকে কষ্ট দিতে চাই না। তুমি ইনশাআল্লাহ আমাকে সৎকর্মপরায়ণদের অন্তর্ভুক্ত পাবে’। মূসা বলল, ‘এ চুক্তি আমার ও আপনার মধ্যে রইল। দু’টি মেয়াদের যেটিই আমি পূরণ করি না কেন, তাতে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকবে না। আর আমরা যে বিষয়ে কথা বলছি, আল্লাহ তার সাক্ষী”(সূরা আল-কাসাস ২৫-২৮)। আল্লাহ তাআলা পৃথিবীকে মানুষের জীবিকা অন্বেষণের জন্য সুগম করে দিয়েছেন। যাতে করে তারা জলে, স্থলে পরিভ্রমণ করে তাদের আহার্যের সন্ধান করতে পারে। যেমনি ভাবে আল-কুরআনে জলপথে ভাসমান নৌযানগুলোকে আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ হিসেবে উল্লেখ করে ইরশাদ হয়েছে, “তোমরা এতে (সমুদ্রে) নৌযানকে দেখতে পাও তার বুক চিরে চলাচল করে যা এজন্য যে, তাঁর অনুগ্রহের অনুসন্ধান করতে পার” (সূরা ফাতির ১২)। ইসলাম বৈরাগ্যবাদী কোন ধর্ম নয়, এ জীবন-বিধানে বলা হয়েছে যে, রুযীর তাগিদে মানুষকে দেশ-দেশান্তরে ভ্রমণ করার প্রয়োজন হতে পারে, তাই তাদের জন্য আল্লাহ তাআলা ইসলামের বিধি-বিধানও সহজ করে দিয়েছেন।এ প্রসঙ্গে আল-কুরআনে ইরশাদ হচ্ছে, “কাজেই আল-কুরআনের যতটুকু তোমাদের জন্য সহজ, ততটুকু(রাতের নামাজে) আবৃত্তি কর। তিনি (আল্লাহ) জানেন তোমাদের মধ্যে কেউ কেউ অসুস্থ হবে, কেউ কেউ আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধানে দেশে-বিদেশে যাবে এবং কেউ কেউ আল্লাহর পথে জিহাদে লিপ্ত হবে। কাজেই কোরআনের যতটুকু তোমাদের জন্য সহজ ততটুকু আবৃত্তি কর”(আল মুযাম্মিল-২০)। রাসুল সা. কর্মের দ্বারা রুজি উপার্জনকে ফরজ ইবাদত হিসেবে গণ্য করেছেন এবং শ্রম বা কর্ম দ্বারা অর্জিত খাদ্যকে সর্বোৎকৃষ্ট খাদ্য হিসেবে উল্লেখ করে বাস্তবতানুযায়ী কর্মের শিক্ষা দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সা. বলেছেন, তোমাদের কারও পক্ষে এক বোঝা জ্বালানি সংগ্রহ করে পিঠে বহন করে নিয়ে আসা কারও কাছে সওয়াল করার চেয়ে উত্তম। কেননা অনেক সময় সওয়াল করলে সে দিতেও পারে আবার নাও পারে।” (সহিহ বুখারী-২০৭৪) ইসলামী বিধানে প্রাত্যহিক কাজকর্ম থেকেও আধ্যাত্মিক কল্যাণের সুযোগ রয়েছে। এ বিধানে জীবিকা নির্বাহের জন্য আয়-উপার্জনকে আল্লাহর পথে জিহাদ বলে উল্লেখ করেছে এবং সকল ধরনের কায়িক বা শারীরিক শ্রমকে আল্লাহর নৈকট্য লাভের বিশেষ মাধ্যম হিসেবে উল্লেখ করেছে। আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দাদের যথাময়ে নামাজ আদায়ের পরপরই তাঁর দেয়া নেয়ামতরাজী থেকে কর্মের দ্বারা অনুগ্রহ তালাশের নির্দেশ দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে আল-কুরআনে ইরশাদ হচ্ছে “অতঃপর নামায সমাপ্ত হলে তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড় এবং আল্লাহর অনুগ্রহ তালাশ কর”(সূরা জুমা’-১০)। ইসলাম স্বহস্তে কর্মকে উৎসাহিত করে সম্মানজনক ও আত্মতৃপ্তি মূলক জীবিকার ব্যবস্থা করেছে এবং একে শ্রেষ্ঠ জীবিকা হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। এক সাহাবী রাসুল সা. এর কাছে আর্থিক সাহায্য চাইলে তিনি তার(সাহাবী) শেষ সম্বল কম্বল ও বাটি বিক্রি করে তা দিয়ে কুঠার কিনতে বলেন এবং তিনি (রাসূল সা.) নিজ হাতে কুঠারের হাতল লাগিয়ে সেই সাহাবীকে জঙ্গল থেকে কাঠ কেটে তা বাজারে বিক্রি করে কর্মমুখী জীবন নির্বাহের ব্যবস্থা করে দেন। এ প্রসঙ্গে হাদিসে বর্ণিত হয়েছে যে, মিকদাম রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সা. বলেন, নিজ হাতের শ্রমে উপার্জিত জীবিকার চেয়ে উত্তম আহার কেউ কখনও গ্রহণ করেনি। আল্লাহর নবী দাউদ আ. নিজ হাতে উপার্জন করে জীবিকা নির্বাহ করতেন(বুখারী-২০৭২)। নবী ও রাসুলগণও স্বহস্তে কর্ম করতেন এবং শেষ রাসুল মুহাম্মদ সা. নিজে সবসময় কর্মব্যস্ত থাকতেন এবং সাহাবাদেরকেও কাজ করে জীবিকা উপার্জনের উৎসাহ দিতেন। এমনকি কাজ করার কারণে তাঁর হাতে ফোস্কা পড়ে যেত, সে হাত দেখিয়ে তিনি বলতেন, আল্লাহ ও তাঁর রাসুল এরূপ শ্রমাহত হাত খুবই পছন্দ করেন ও ভালবাসেন। সাহাবাদের অ-ক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে তাদের শরীর থেকে ঘামের গন্ধ বের হতো এ প্রসঙ্গে হাদিসে বর্ণিত আছে, রাসূল সা. এর সাহাবীগণ নিজেদের কাজ-কর্ম নিজেরা করতেন। ফলে তাদের শরীর থেকে ঘামের গন্ধ বের হতো। সেজন্য তাদের বলা হলো, যদি তোমরা গোসল করে নাও (তবে ভালো হয়) (বুখারী-২০৭১)। ইসলাম কর্মে উৎসাহিত করার পাশাাপাশি অলসতা দূর করার নির্দেশনা দিয়েছে। কেননা অলসতাই কাপুরুষতা, ভীরুতা ও দুশ্চিন্তাগ্রস্থ করে। আর এজন্যই ইসলামী বিধানে যাদেরই কর্মশক্তি রয়েছে তাদের প্রত্যেককে সামর্থনুযায়ী কর্মের নির্দেশনা দিয়েছে। কর্মের প্রতি উৎসাহদানের পাশাপাশি এ বিধানে কর্মজীবীদের কর্মঘন্টা, কর্মপরিবেশ ও পারিশ্রমিক প্রাপ্তির নিশ্চয়তাসহ তাদের সকল অধিকার বাস্তাবায়নেরও নির্দেশনা দিয়েছে। রাসুলুল্লাহ সা. অধীনস্থদের নিজেদের ভাই হিসেবে উল্লেখ করে তাদের অধিকারের ব্যাপারে শতর্ক হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন এবং তাদের ওপর সাধ্যাতিরিক্ত কাজের বোঝা চাপিয়ে দিতেও নিষেধ করেছেন। ইসলাম শ্রমিকের পারিশ্রমিক তার ঘাম শুকানের পুর্বেই প্রদানের নির্দেশনা দিয়েছে এবং তা প্রদানে টালবাহানা করলে তার জন্য কঠিন শাস্তির ঘোষণা দিয়েছে। এ প্রসঙ্গে রাসূল সা. বলেনে, “মহান আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেছেন যে, কিয়ামতের দিন আমি নিজে তিন ব্যক্তির বিরুদ্ধে বাদী হবো। এক ব্যক্তি, যে আমার নামে ওয়াদা করে তা ভঙ্গ করে। আরেক ব্যক্তি, যে কোনো আযাদ মানুষকে বিক্রি করে তার মূল্য ভোগ করল। আর এক ব্যক্তি, যে কোন মজুর নিয়োগ করে তার থেকে পুরো কাজ আদায় করে এবং তার পারিশ্রমিক দেয় না (বুখারী-২২২৭)। ইসলাম বেকার যুবকদের কর্মমুখী করা ও অনাবাদি জমির সঠিক ব্যবহারের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এ প্রসঙ্গে রাসূল সা. ইরশাদ করেছেন, সমস্ত যমীনই আল্লাহর এবং বান্দারা সবাই আল্লাহর বান্দা।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন