শুক্রবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১, ১২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ধর্ম দর্শন

বিশ্বময় ইসলামের জাগরণ - মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় বিশ্বনবী (সা.)

প্রকাশের সময় : ৫ মে, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
দয়া, ক্ষমা ও শ্রমিকের অধিকার প্রতিষ্ঠায় রাসূল (সা.)-এর অনন্য পদক্ষেপ : মহানবী (সা.) ছিলেন অত্যন্ত দয়ালু, ক্ষমাশীল ও কোমল। দয়া, ক্ষমা, শান্তিও সাম্যের প্রতিরূপ এই মহামানব স্পষ্ট ঘোষণা করেছেন, ‘যে মানুষকে দয়া করে না, আল্লাহ্ তাকে দয়া করেন না।
এখানে কেবল মুসলমানদের কথাই নয় বরং সমগ্র সৃষ্টির কথা বলা হয়েছে। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের প্রতি দয়া ও ক্ষমা প্রদর্শনকে তিনি নানাভাবে উৎসাহিত করেছেন। অন্য একটি হাদীসে মহানবী (সা.) বলেন : ‘পৃথিবীতে যারা আছে তাদের প্রতি দয়া কর। ঊর্ধ্বলোকে যারা আছেন তারাা তোমার প্রতি সদয় হবেন’। অন্যদিকে শ্রমিক, অধীনস্থ কর্মচারী ও চাকর-চাকরানীদের প্রতি সদয় ব্যবহার করা, তাদেরকে নিজেদের অনুরূপ, খাওয়া-দাওয়া, পোশাক-পরিচ্ছদ, বিশ্রাম ইত্যাদির ব্যবস্থা করতেও তিনি বার বার তাগিদ দিয়েছেন। বস্তুত বিশ্বনবী (সা.) শ্রমিকদের সব প্রকার বঞ্চনা, অত্যাচার, নিপীড়ন আর গ্লানির অবসান করে এমন সব শ্রমনীতির প্রবর্তন করে গেছেন যার সিকি শতাংশও জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) বিগত ১১৮ বছর ধরে মে দিবস উদযাপনের মাধ্যমেও প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। বুখারী ও মুসলিম শরীফে উদ্ধৃত এক হাদীসে বলা হয়েছে, মুহাম্মদ (সা.) স্পষ্ট ঘোষণা করেছেনÑ ‘শক্তি-সামর্থ্যরে অতিরিক্ত কাজ শ্রমিকদের উপর চাপাবে না। যদি তার সামর্থ্যরে অতিরিক্ত কোন কাজ তাকে দাও তাহলে সে কাজে তাকে সাহায্য কর।
মহানবী (সা.) এভাবে শান্তি, মৈত্রী, ক্ষমা, দয়া, শ্রমের মর্যাদা ও ন্যায়বিচারের যে মহান আদর্শ রেখে গেছেনÑ মানব মর্যাদা ও মানবাধিকারের ধারণা ও তা অর্জনের ক্ষেত্রে তা এক অতুলনীয় দিকনির্দেশনা। তাঁর এই গুণাবলী ও দৃষ্টিভঙ্গীতে মুগ্ধ বিখ্যাত দার্শনিক, সাহিত্যিক জর্জ বার্নড শ’ তাই বলতে কুণ্ঠাবোধ করেননিÑ ‘ওভ ধষষ ঃযব ড়িৎষফ ধিং ঁহরঃবফ ঁহফবৎ ড়হব ষবধফবৎ, গড়যধসসধফ ড়িঁষফ যধাব নববহ ঃযব নবংঃ ভরঃঃবফ সধহ ঃড় ষবধফ ঃযব ঢ়বড়ঢ়ষবং ড়ভ াধৎরড়ঁং পৎববফং, ফড়মসধং ধহফ রফবধং ঃড় ঢ়বধপব ধহফ যধঢ়ঢ়রহবংং.
নারী অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় রাসূল (সা.)-এর গৃহীত কর্মপন্থা : নারীর অধিকার ও মর্যাদা রক্ষার বিষয়টি বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে আলোচিত বিষয়গুলোর একটি। নারী মুক্তির প্রবক্তা হিসেবে আমরা হয়ত কেট মিলে (শধঃব গরষষবঃ), জার্মেন গ্রীয়ার (এবৎসধরহব এৎববৎ) বা অ্যানী নূরাকীন (অহহব ঘঁৎধশরহ) প্রমুখের নাম জানি; এছাড়াও রয়েছে মেরী উল’ন, অ্যানী বেসান্ত, মার্গারেট সাঙ্গার, সুলতানা রাজিয়া, বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন প্রমুখ মহীয়সী মহিলাদের সংগ্রামের ইতিহাস। কিন্তু মানব সভ্যতার ইতিহাসে নারীর অধিকার ও মর্যাদার জন্য যে ব্যক্তি প্রথম সোচ্চার হয়ে ওঠেন, নারীকে সংযম ও সমাজের অবিচ্ছেদ্য ও অপরিহার্য অংশ হিসেবে যে ব্যক্তি প্রথম স্বীকৃতি দেন, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে নারীর অধিকার পরিপূর্ণ আকারে যে ব্যক্তি প্রথম প্রচেষ্টা করেন, সত্যিকার অর্থে নারীর জাগরণ ও নারী মুক্তির যিনি প্রবক্তা তিনি হচ্ছেন মুহাম্মদ (সা.)। একথা বলা অত্ত্যুক্তি হবে না যে, জীবনে অন্যকিছু না করলেও শুধু নারী জাগরণের ক্ষেত্রে তাঁর অবদানই বিশ্ব মনীষার মুহাম্মদ (সা.)কে সুউচ্চ আসনে সুদৃঢ়ভাবে অধিষ্ঠিত করবে। নারীর প্রতি রাসূল (সা.)-এর দর্শন এসেছে মূলত কুরআনের নীতি-দর্শন থেকে। প্রকৃতপক্ষে তাঁর জন্মকালে নারীকে বিশ্বের কোথাও এমনকি স্বাধীন মর্যাদাবান মানুষ হিসেবেও বিবেচনা করা হতো না। নারীকে ‘ভোগের বস্তু’ লাঞ্ছনা ও পাপের প্রতিমূর্তি’ এবং কোথাও কোথাও অন্যান্য অস্থাবর সম্পতির মত ‘সম্পত্তি’ মনে করা হতো। কুরআনে সূরা আন-নাহল এ আল্লাহ তা’আলা তৎকালীন সমাজে নারী সম্পর্কে মানুষের মানসিকতাকে চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন। ‘যখন তাদের কাউকে কন্যা সন্তানের সুসংবাদ দেয়া হয় তার মুখম-ল কোলে হয়ে যায়, সে অসহনীয় মনস্তাপে ক্লিষ্ট হয়। তাকে যে সংবাদ দেয়া হয় তার গ্লানি হেতু সে নিজ সম্প্রদায় হতে আত্মগোপন করে। সে চিন্তা করে হীনতা সত্ত্বেও সে তা রেখে দেবে না মাটিতে পুঁতে দেবে। এভাবে নারীর প্রকৃত মুক্তি, তার স্বাধীনতা, অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় মহানবী (সা.) এক অনন্য সাধারণ দিকনির্দেশনা দিয়ে গেছেন যা বর্তমান নারী স্বাধীনতা ও নারী মুক্তির ধারণার চেয়ে বহুগুণে উন্নত, পরিণত ও সুদূর প্রসারী। প্রখ্যাত লেখিকা নাসিমা খাতুন তার একটি গবেষণা নিবন্ধে বিষয়টি পর্যালোচনা করতে গিয়ে বলেছেনÑ ‘ডরযরহ ঃযব ঃবিহঃু-ঃযৎবব ুবৎং ফঁৎরহম যিরপয ঃযব ঢ়ৎড়ঢ়যবঃ গঁযধসসধফ (ঢ়বধপব নব ঁঢ়ড়হ যরস) ঢ়ৎড়সঁষমধঃবফ ঃযব গবংংধমব ড়ভ ওংষধস, ঃযব ঢ়ড়ংরঃরড়হ ড়ভ ঢ়ড়ংরঃরড়হ ড়ভ ড়িসধহ ধিং ৎধরংবফ ভৎড়স ঃযব ষড়বিংঃ ফবমৎধফধঃরড়হ ঃড় ঃযব মৎবধঃবংঃ যবরমযঃং ড়ভ বংঃববস, যড়হড়ঁৎ ধহফ ৎবংঢ়বপঃ।
রাসূল (সা.)-এর প্রতিষ্ঠিত নারী স্বাধীনতা ও নারী মর্যাদাকে সমসাময়িক অন্যান ধর্মমত ও জীবনদর্শনের সাথে তুলনা করে নাসিমা দেয়িছেন যে, যে, ‘...পড়সঢ়ধৎবফ ঃড় ধষষ ড়ঃযবৎ পরারষরুধঃরড়হং ধহফ ষধি ড়ভ ঃযব ড়িৎষফ ওংষধসরপ ষধি যধং মরাবহ ড়িসবহ যবৎ ৎরমযঃং ঃড় ঃযব যরমযবংঃ ফবমৎবব, নবভড়ৎব বাবৎুনড়ফু ধষংড় ধহফ সড়ংঃ ফরংরহঃবৎংঃবফষু ধহফ ৎবপড়মহরুবফ যবৎ ঃঁৎব ফরমহরঃু মনীষী পিয়েরে ক্রাবাইট এর মতে, ঐব (গঁযধসসধফ) ধিং ঢ়ৎড়নধনষু ঃযব মৎবধঃবংঃ পযধসঢ়রড়হ ড়ভ ড়িসবহং ৎরমযঃং ঃযব ড়িৎষফ যধং বাবৎ ংববহ.
পরিবার, আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশীদের মধ্যে শান্তি ও অধিকার প্রতিষ্ঠা : অনেক ধর্মগুরু, ধর্মপ্রচারক বা মহাপুরুষের পারিবারিক ও সামাজিক জীবন কিভাবে কেটেছে তা জানা যায় না। কিন্তু মুহাম্মদ (সা.)-এর পারিবারিক ও সামাজিক জীবন সম্পর্কে বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে বেশি আলোচনা হয়েছে। রাসূল (সা.) পারিবারিক জীবনকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিতেন। ‘বৈরাগ্য সাধনে মুক্তির’ পথ তিনি পরিহার করে চলেছেন। বরং তাঁর মতে পরিবার ও সমাজে শান্তি, সাম্য, ন্যায়বিচার ও আল্লাহর আনুগত্য প্রতিষ্ঠা করাই প্রকৃত ধর্মাচরণ। আমরা ইতঃপূর্বে ‘বিবাহ’ ব্যবস্থার মাধ্যমে পরিবারের ভিত্তি রচনা, পুত্রসন্তানের পাশাপাশি কন্যাসন্তানকে স্বাগত জানানো এবং কন্যাকে অধিক গুরুত্বদান, স্ত্রীর অধিকার প্রভৃতি সম্পর্কে তাঁর জীবন-দর্শন আলোচনা করেছিÑ যেখানে দেখা গেছে মানুষের জীবনের একেবারে তৃণমূল পর্যায়ে অধিকার ও মানবতা প্রতিষ্ঠায় তাঁর অবিস্মরণীয় অবদান রয়েছে। এখানে পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে মানুষের মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় তাঁর অবদান সম্পর্কে অন্য কয়েকটি বিশেষ দিকের উপর আলোকপাত করা হলোÑ
ক. মানবাধিকারের এই উচ্চকণ্ঠের যুগে পরিবার-ব্যবস্থা ক্রমশ যেখানে দুর্বল হয়ে পড়ছে নগরায়ন ও শহরায়নের পাশাপাশি লাগামহীন ভোগবাদী দৃষ্টিভঙ্গি পরিবারের নির্ভরশীল সদস্য বিশেষত শিশু-বৃদ্ধ-বৃদ্ধা ও অন্যদের প্রতি ক্রমশ নিরাপত্তাহীনতা, অধিকার না পাওয়ার ও লাঞ্ছনার আশংকা বাড়ছে। অথচ রাসূল (সা.) দৃঢ়ভাবে পারিবারিক দায়িত্ব পালনে তাগিত দিয়েছেন। কুরআনে পিতা-মাতার সাথে সন্তানের সম্পর্ক ও দায়িত্বের কথা স্পষ্ট ঘোষণা করে বলা হয়েছেÑ ‘তাদের একজন অথবা উভয়েই তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হলে তাদেরকে ‘উফ’ বলো না এবং তাদেরকে ধমক দিও না। তাদের সাথে সম্মানসূচক কথা বলবে।
খ. মুহাম্মদ (সা.) নিজ মা-বাবার সম্মান-মর্যাদা ও পরিবারে তাদের অধিকার রক্ষার বিষয়টি কুরআনের নির্দেশনার আলোকে সমাজে প্রতিষ্ঠা করেছেন। তিনি বলতেন, পিতা-মাতার সন্তুষ্টি ব্যতীত বেহেশতের দ্বার উন্মুক্ত হবে না।
নিজের পরিবারে যিনি সততা, ন্যায়পরায়ণতা, দায়িত্ববোধ ও সকল সদস্যের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারবেন না তিনি যতই জগৎ জয় করুন, শ্রেষ্ঠ মানুষ হতে পারবেন না- এটিই মহানবী (সা.)-এর জীবন দর্শন। অন্যদিকে তাঁর মতে পরিবারে স্ত্রীর মর্যাদাও অনেক উঁচুতে। তিনি বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে তারাই সবচেয়ে উৎকৃষ্ট ব্যক্তি যারা তাদের স্ত্রীদের কাছে উৎকৃষ্ট এবং পরিবার-পরিজনদের সাথে স্নেহশীল ব্যবহার করে।’ তাঁর যুগে এই কথা বলা ও পরিবারে তার অনুশীলন করা ছিল অত্যন্ত কঠিন এবং যুগান্তকারী এক পদক্ষেপ। বৃহত্তর সমাজ-জীবনে শান্তি, সাম্য ও অধিকার প্রতিষ্ঠা : মুহাম্মদ (সা.) নিজ পরিবার, আত্মীয়-স্বজনের পর দৃঢ়ভাবে প্রতিবেশীর অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছেন। মেহমানদের অধিকারও তিনি নির্ধারিত করেছেন। তাঁর মতে ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ও শেষদিনে ঈমান রাখে, সে যেন অবশ্যই মেহমানদের সম্মান করে, প্রতিবেশীকে কষ্ট না দেয় এবং অবশ্যই ভাল কথা বলে অথবা চুপ থাকে।
অসহায়-বঞ্চিত ইয়াতিম ও বিধবাদের অধিকার : মুহাম্মদ (সা.) সমাজে ইয়াতিম, বিধবা অসহায়দের অধিকার রক্ষার ও তাদের কল্যাণে সারা জীবন কাজ করে গেছেন এবং অন্যকেও তেমনি দায়িত্ব পালনের তাগিদ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন : ক্ষুধার্তকে খাবার দিও, পীড়ত ও রুগ্নকে দেখতে যেও এবং মুসলমান হোক কি অমুসলমান, সকল নির্যাতিত মানুষকে সাহায্য করো।  ইয়াতিমের তত্ত্বাবধানকে উৎসাহিত করতে তিনি বলেছেনÑ আমি এবং ইয়াতিমের তত্ত্বাবধানকারী বেহেশতে এভাবে থাকবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন