হযরত আল্লামা সালেম কাসেমী (রহ) ছিলেন উপমহাদেশের একজন শীর্ষস্থানীয় আলেম, শায়খুল হাদীস, শাইখুত তাফসীর ও ইসলামী দার্শনিক। দেওবন্দী চিন্তাধারায় উপমহাদেশে তিনিই ছিলেন প্রবীনতম আলেম।
সারা পৃথিবীতে তার অসংখ্য প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ শাগরিদ, ভক্ত ও মুরিদ রয়েছেন। দারুল উলুম দেওবন্দ ও দারুল উলুম (ওয়াকফ) দেওবন্দে তিনি সূদীর্ঘ ৭০ বছর শিক্ষকতা করেছেন। গত ২৬ শে রজব ১৪৩৯ হিজরী, ১৪ এপ্রিল ২০১৮ইং শনিবার ২টা ১৭ মিনিট সময়ে ৯৪ বছর বয়সে দেওবন্দস্থ “তৈয়ব মঞ্জিলে” তিনি ইন্তেকাল করেছেন।
রাত ১০টায় দেওবন্দে তার নামাযে জানাযা অনুষ্টিত হয়। এতে লাখো মানুষ অংশ গ্রহণ করেন। নামাযে জানাযায় ইমামতি করেন মরহুমের পুত্র দারুল উলুম (ওয়াকফ)-এর মুহতামিম হযরত মাওলানা সুফিয়ান কাসেমী। ‘মাকবারায়ে কাসেমী’ কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়। তার পিতা হাকিমুল ইসলাম মাওলানা ক্বারী মুহাম্মদ তৈয়ব কাসেমী (রহ), দাদা হযরত মাওলানা হাফেজ মুহাম্মদ আহমদ সাহেব (রহ), দাদার পিতা হুজ্জাতুল ইসলাম হযরত আল্লামা মুহাম্মদ কাসেম নানুতবী (রহ)। (প্রতিষ্টাতা বিশ্ববিখ্যাত দারুল উলুম দেওবন্দ।) যার চিন্তাধারা ও চেষ্টায় উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থানে বহু কওমী মাদ্রাসা প্রতিষ্টিত হয়। সিয়াহসিত্তা হাদিসের দরস বিভিন্ন স্থানে চালু হয়। ইসলাম বিদ্বেষী ও খ্রীষ্টান মিশনারীদের সাথে মোকাবিলা করে ইসলামের শ্রেষ্টত্ব কায়েম করে কাসেম নানুতবী (রহ) হুজ্জাতুল ইসলাম উপাধি লাভ করে।
আল্লামা সালেম কাসেমী (রহ) ২৪ জমাদিউস্সানী ১৩৪৪ হিজরী মোতাবেক ৮ই জানুয়ারী ১৯২৬ইং দেওবন্দে জন্মগ্রহণ করেন। দারুল উলুম দেওবন্দে শিক্ষা লাভ করেন। ১৯৪৮ইং সনে দারুল উলুম দেওবন্দ থেকে দাওরায়ে হাদীস পাশ করেন। তার উস্তাদগনের মধ্যে ছিলেন শাইখুল ইসলাম হযরত মওলানা সৈয়দ হোসাইন আহমদ মাদানী (রহ), হযরত আল্লামা ইব্রাহীম বলিয়াবী (রহ), হাকীমুল ইসলাম মাওলানা ক্বারী মুহাম্মদ তৈয়ব সাহেব (রহ), শাইখুল আদব ওয়াল ফিক্হ আল্লামা মুফতি এজাজ আলী সাহেব (রহ) প্রমুখ।
বাল্যকালে তিনি হাকীমুল উম্মত মুজাদ্দেদে মিল্লত হযরত মাওলানা শাহ আশরাফ আলী তানভী (রহ) এর কাছে থানা ভবনে খানেকাহে এমদাদীয়ায় শিক্ষালাভ করার সৌভাগ্য লাভ করেন। তিনি ছিলেন হযরত থানবী (রহ) এর সর্বশেষ জীবিত শাগরিদ।
আল্লামা সালেম কাসেমী (রহ) শিক্ষা সমাপনের পরপরই দারুল উলুম দেওবন্দে শিক্ষক নিযুক্ত হন। ১৯৮১ সাল পর্যন্ত সেখানে শিক্ষকতা করেন। দারুল উলুম দেওবন্দের শত বার্ষিকী মহা সম্মেলনের পর তিনি ১৩০৩ হিজরী/১৯৮৩ ইং সালে হযরত আল্লামা সৈয়দ আনজর শাহ কাশমিরী (রহ), আল্লামা নাঈম (রহ), আল্লামা খুরশীদ (রহ) প্রমুখের সহযোগিতায় দারুল উলুম (ওয়াকফ) দেওবন্দ প্রতিষ্টা করেন। তিনি ছিলেন এর প্রতিষ্ঠাতা মুহতামিম। ইন্তেকালের কয়েক বছর আগ পর্যন্ত তিনি এর মুহতামিম এবং অন্যতম শাইখুল হাদীস হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। ইন্তেকালের কয়েক বছর আগে মুহতামিমের দায়িত্ব থেকে অবসর গ্রহণ করেন। সদর মুহতামিম হিসাবে দায়িত্ব পালন করতে শুরু করেন। সাহেবজাদা মাওলানা সুফিয়ান কাসেমী মাদ্রাসার মুহতামিম নিযুক্ত হন।
আল্লামা সালেম কাসেমী সাহেবের শতাধিক খলীফা ও বহু মুরিদ রয়েছেন। উল্লেখ্য যে আল্লামা সালেম কাসেমী (রহ) ছিলেন বিখ্যাত বুজুর্গ হযরত মাওলানা আবদুল কাদের রায়পুরী (রহ) এর মুরিদ এবং হাকিমুল ইসলাম মাওলানা ক্বারী তৈয়ব সাহেব (রহ) এর খলিফা।
আল্লামা কাসেমী (রহ) দেওবন্দে মেয়েদের জন্য একটি উচ্চতর ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্টান প্রতিষ্টা করেন। এই প্রতিষ্টানে ডাকযোগে শিক্ষা ও পরিক্ষা গ্রহণ করা হয়। ‘কাসেমুল মাআরিফ’ নামে তার একটি গবেষণা ও প্রকাশনা প্রতিষ্টান রয়েছে। তিনি সর্ব ভারতীয় ‘মুসলিম পার্সনাল ল’ বোর্ড এর সহ সভাপতি, ‘মজলিসে মুসলিম মুশাওয়ারাত’ -এর সভাপতি হিসাবে নিয়োজিত ছিলেন।
তা’ছাড়াও তিনি দারুল উলুম নাদওয়াতুল উলামা লাখনৌ, মুজাহেরুল উলুম (ওয়াকফ) সাহারানপুর, আলিগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটি এর মজলিসে শূরার সদস্য ছিলেন। তিনি সর্ব ভারতীয় রাবেতায়ে মাসাজিদ, ইসলামী ফেকাহ একাডেমী এর পৃষ্টপোষক এবং ফেকাহ একাডেমী মিশর এর সদস্য ছিলেন।
আল্লামা সালেম কাসেমী (রহ) একজন বিখ্যাত বক্তা ও ওয়ায়েজ ছিলেন। দেশ বিদেশে তিনি ব্যাপক সফর করেন। ইসলাম প্রচারে তার বিরাট অবদান রয়েছে।
এ লেখকের সুযোগ হয়েছিল মরহুমের দেওবন্দস্থ বাড়ি ‘তৈয়ব মঞ্জিলে’ গিয়ে তাঁর সাথে আলাপ করার। তাঁর বাংলাদেশ সফরে তাঁর দরসে বুখারী শরীফে বসার এবং তাঁর তত্ত¡পূর্ণ্য বয়ান শ্রবণ করার। হাটাজারী মাদ্রাসার শত বার্ষিকী মহাসম্মেলনের পূর্বে তাঁর সাথে দীর্ঘ আলাপ করার সুযোগ হয়েছিল।
তিনি হাটহাজারী মাদ্রাসার বুজুর্গগণের খেদমতের প্রসংসা করেছিলেন। এবং শত বার্ষিকী মহাসম্মেলনে অংশ গ্রহনেরও আশ্বাস দিয়েছিলেন। উল্লেখ্য যে, হাটাজারী মাদ্রাসার অন্যতম প্রতিষ্টাতা হযরত মাওলানা আবদুল ওয়াহেদ (রহ) ছিলেন হযরত কাছেম নানুতবী (রহ) এর প্রত্যক্ষ সাগরিদ। আল্লামা সালেম (রহ) বাংলাদেশে এসে ছিলেন বিভিন্ন সময়ে। নাজিরহাট বড় মাদ্রাসায়ও তিনি এসেছিলেন। তাঁর বয়ান শুনেছিলাম। তাঁর সাথে বসারও সুযোগ হয়। আর একবার ঢাকা পল্টন ময়দানে তাঁর বয়ান শ্রবণ করেছিলাম। গুলিস্থানের জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের একটি হলে তিনি আলোচনা সভায় বক্তব্য রেখেছিলেন। তাতেও উপস্থিত থাকার সৌভাগ্য হয়। ঢাকা মীরপুর কাসেমুল উলুম মাদ্রাসায় তিনি বুখারী শরীফের সবক দিয়েছিলেন। সে সবকে বসারও সুযোগ হয়েছিল। বৃদ্ধ বয়সেও তাঁর এলমের গভীরতা, জ্ঞানগর্ভ আলোচনা সকলকে মুহিত করেছিল।
আল্লাহপাক তাঁকে জান্নাতে উচ্চ মর্যদা নসিব করুন। আমীন
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন