(পূর্বে প্রকাশিতের পর)
কোন প্রতিবেশী যেন তার প্রতিবেশীর দেয়া হাদিয়াকে তুচ্ছ জ্ঞান না করে, যদিও (হাদিয়া) বকরির খুরের অংশ হোনা কেন। অতএব সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী সমাজের সকলের হাদিয়া গ্রহণ করার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারীদেরকে অনেকে হাদিয়া প্রদানের মাধ্যমে স্বার্থ সিদ্ধি করতে চায়। ফলে হাদিয়া বা উপঢৌকন গ্রহণের ক্ষেত্রে তাদেরকে সর্তক থাকতে হয়। বর্তমান সময়ে পদস্থ কর্মকর্তা ও অফিসারদেরকে তাদের পদের কারণে উপঢৌকনের নামে যে ঘুষ দেয়া হয় সে বিষয়ে নি¤েœর হাদিসটি লক্ষণীয়। আবু হুমাইদ সায়ীদী (রাঃ) বলেন: রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বনু আসাদের ইবনুল উতবিয়্যা নামের এক ব্যক্তিকে সাদাকা উসূল করার কাজে নিযুক্ত করলেন। সে ফিরে এসে বললো, এই সম্পদ আপনাদের (বায়তুল মালের), আর এই সম্পদ আমাকে হাদিয়া দেয়া হয়েছে। তখন রাসূূূূূলুল্লাহ (সাঃ) মিম্বরে আরোহণ করে আল্লাহর হামদ ও সানা বর্ণনা করলেন। অুঃপর বললেন, যাকাত উসূলে নিযুক্ত ব্যক্তির কী হলো, আমরা তাকে পাঠাই, এরপর সে এসে বলে, এটা আপনাদের আর এাঁ আমার! সে নিজ মা- বাবার ঘরে বসে থাকুক, এরপর দেখুন, তাকে হাদিয়া দেয়া হয় কি না। ঐ সত্তার শপথ, যার হাতে আমার প্রাণ, যে ব্যক্তি এমন কোন সম্পদ নেবে, সে তা কেয়ামতের দিন বহন করে আনবে। যদি উট হয় তবে তা চিৎকার করবে অথবা যদি গাভী হয় তবে তা হাম্বা হাম্বা করবে, অথবা যদি বরকি হয় তবে ভ্যাঁ ভ্যাঁ করবে।
স্বজনপ্রীতি বর্তমান সময়ের দুর্নীতির অন্যতম কারণ। সরকারি পদাধিকারী ও রাষ্ট্রীয় সম্পদের রক্ষক নিজের আত্মীয়স্বজনকে প্রাধান্য দেয়ার সমাজ ও রাষ্ট্রেনানাবিধ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। ইসলাম বিচারসহ সর্বক্ষেত্রে স্বজনপ্রীতি থেকে দূরে থেকে ন্যায়কে গ্রহণ করার নির্দেশ দিয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন ঃ হে ইমানদারগণ। তোমরা ন্যায় বিচারে দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত থাকবে আল্লাহর সাক্ষীস্বরূপ; যদিও তা তোমাদের নিজেদের অথবা পিতা-মাতা এবং আত্মীয় স্বজনদের বিরূদ্ধের হয়, এ আয়াত থেকে স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় হক ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে প্রয়োজনে স্বজনের বিরূদ্ধে নেয়া হয় অবশ্যক।
অধীনস্থদের প্রতি স্নেহের আচরণ ঃ ইসলামী রাষ্ট্রে কর্মরত সকল অফিসার কর্মকর্তা এবং ছোট বড় দায়ীত্বশীলদের যোগ্য হওয়ার সাথে সাথে তাদের মধ্যে আপসোসে হৃদ্যতা ও ¯েœহের আচরণ থাকা জরুরি। উচ্চপদস্থদের কর্তব্য হলো, অধীনস্থ কর্মকর্তাদের সাথে সদাচরণ করা। যদি অফিসারগণ অধীনস্থদের সাথে সদাচরণ করে তাহলে অধীনস্থরাও নিজ নিজ কর্তব্য ও দায়িত্ব ভালোভাবে আঞ্জাম দেবে। সুন্নাহর আলোকে উচ্চপদস্থ অফিসার ও রাষ্ট্রের কর্মকর্তাদের সীমাতিরিক্ত আড়ম্বরতা ও জাঁকজমক প্রদর্শনের কোন সুযোগ নেই একারণে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন: হে আল্লাহ! যে ব্যক্তি আমার উম্মতের কোন দায়িত্ব লাভ করে এরপর তাদের সাথে কঠোরতা করে, আপনি তার প্রতিও কঠোরতা করুন, আর যে ব্যক্তি আমার উম্মতের কোন দায়িত্ব লাভের পর তাদের প্রতি সদয় হয় আপনিও তার প্রতি সদয় হোন।
ইসলাম সরকারি পদ ও সম্পদের যথাযথ ও দায়িত্বপূর্ণ ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্যে নীতিমালা প্রণয়ন করেছে।
রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব ও সম্পদের দায়িত্বশীলদের জন্য আবশ্যক হলো- সর্বাবস্থায় তারা রাষ্ট্রের উপকার ও স্বার্থের প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখবেন। সর্বক্ষেত্রে স্বজনপ্রীতি ও ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে থেকে দায়িত্ব পালন করবেন, এমনকি যে বিষয়গুলো আংশিক বা পরিপূর্ণভাবে রাষ্ট্রের উপকার সাধন করে সেসব ক্ষেত্রেও। এ প্রসঙ্গে আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত হাদিসটি প্রণিধানযোগ্য। তিনি বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন: শ্রেষ্ঠতম উপার্জন হলো শ্রমিকের নিজ হাতের উপার্জন, যখন সে কল্যাণকামী হয়। এ হাদিস অনুসারে, নিজ হাতে উপার্জনকারীর উপার্জনকে শ্রেষ্ঠ সাব্যস্ত করা হয়েছে কল্যাণকামী হওয়ার শর্তে। সরকারি কর্মকর্তার জন্য রাষ্ট্রের প্রতি কল্যাণকামী হওয়ার অর্থ হলেঅ, সে সর্ববিষয়ে উপকারের দিককে প্রাধান্য দেবে।
প্রত্যেক দায়িত্ব বা পদে কর্মরত ব্যক্তির সাথে প্রথমে রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের ও কর্মকর্তার মাঝে একটি চুক্তি সম্পন্ন হয়। এটিকে কর্মের চুক্তিপত্র বলা হয়ে থাকে । যে শর্তগুলোর ভিত্তিতে এই দায়িত্ব পালনের প্রতিশ্রæতি সম্পন্ন হয় সে শর্তগুলো পুঙ্খানুপুঙ্খরুপে আদায় করা সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীর কর্তব্য। এই চুক্তিপত্র রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তার মাঝে একপ্রকার প্রতিশ্রæতি। আর প্রতিশ্রæতি সম্পর্কে কুরআন শরীফে এসেছে- আর তোমরা প্রতিশ্রæতি পূর্ণ করো।নিঃসন্দেহে প্রতিশ্রæতি পূর্ণ করার বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হবে।
আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) যখন খলীফা নিযুক্ত হলেন, তখন তিনি নিজ দায়িত্বের প্রতিশ্রæতিনামা জনসম্মুখে এ ভাষায় প্রকাশ করেছেন এবং এর মাধ্যমেই তিনি নিজ দায়িত্বের সীমানা নির্ধারণ করে নিয়েছেন, তিনি বলেন: যদি আমি সঠিক কাজ করি তাহলে তোমরা আমাকে সহযোগিতা করবে, আর ভুল কাজ করলে তোমরা আমাকে সংশোধন করবে। সত্য বলা আমানত ও মিথ্যা বলা প্রতারণা। তোমাদের দৃষ্টিতে দুর্বল ব্যক্তি আমার কাছে সবল, যতক্ষণ না আমি তার প্রাপ্য দিতে পারি। তোমাদের মধ্যকার শক্তিশালী ব্যক্তি আমার দরবারে অতি দুর্বল, যতক্ষণ না আমি তার কাছ থেকে মজলুমের হক আদায় করতে পারি।
একজন সরকারি কর্মকর্তার অন্যতম বৈশিষ্ট্য, তিনি সরকারি সম্পদকে আমানত গণ্য করবেন এবং ব্যক্তিগত ও রাষ্ট্রীয় সম্পদের মধ্যে পার্থক্য করবেণ। এ বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে খেয়াল করা উচিত যে, দায়িত্ব বা পদচ্যুত হওয়ার সাথে সাথে রাষ্ট্রীয় সম্পদ ও উপকরণও তার কর্তৃত্বশূন্য হয়ে যাবে। এ জন্যে এই সম্পদকে সে সংরক্ষণকারী ও বন্টনকারী হিসেবে নিজের কাছে রাখবে। রাষ্ট্রীয় সম্পদ ও উপকরণে অন্যায়ভাবে হস্তক্ষেপ করা বা ব্যবহার করা কখনো বৈধ হবে না।
ইসলামী রাষ্ট্র ও অন্যান্য শাসনব্যবস্থার মৌলিক পার্থক্য এটাই যে, ইসলামী রাষ্ট্রে পদস্ত ব্যক্তিবর্গ বিশ্বস্ত, সংরক্ষণকারী ও বন্টনকারী হিসেবে পালন করেন, পক্ষান্তেরে সাধারণত অন্যান্য রাষ্ট্রব্যবস্থায় কর্মকর্তা ও কর্মচারীগণ সরকারী উপকরণ ও সম্পদকে ব্যক্তিগত বস্তুর ন্যায় নিজ স্বর্থে ব্যবহারের ক্ষেত্রে খুব একটা কুণ্ঠাবোধ করেন না।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) রাষ্ট্রীয় সম্প ও উপকরণের ব্যবহারের ক্ষেত্রে নিজ কর্মপদ্ধতি এভাবে বর্ণনা করেছেন: আমি না তোমাদেরকে কোন কিছু দেয়ার ক্ষমতা রাখি, আর না তোমাদেরকে কোন কিছু থেকে বঞ্চিত করতে পারি। আমি তো ¯্রফে খাযানার দায়িত্বশীল। যেখানে সম্পদ খরচের হুকুম হয় আমি সেখানে সম্পদ খরচ করি।
ইসলামী শিক্ষার আলোকে কারো পক্ষে একজন সৎ ও আদর্শ সরকারি কর্মকর্তা বা দায়িত্বশীল হওয়া তখনই সম্ভব, যখন সে নিজ কর্তব্য সঠিকভাবে পালন করার মাধ্যমে নিজ মাসহারা ও পারিশ্রমিককে হালাল মনে করবেন।অনেকে সময় এমন দেখা যায় যে, সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারীগণ নানা বাহানায় কর্তব্য পালনে অবহেলা করে বা কাজটি অস্পূর্ণ করে ফেলে রাখে। এদেরকে যে বেতন বা বিনিময় দেয়া হয় তা গ্রহণে এরা অপরাধী। ইসলামী সমাজ ব্যবস্থায় শ্রমদান ও পারিশ্রমিককে হালাল মনে করে গ্রহণ করার বিষয়ে অনেক গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) প্রত্যেককে শ্রমদান ও পরিশ্রমের মাধ্যমে উপার্জন করার শিক্ষা দিতেন। ইসলামী সমাজ ব্যবস্থায় কর্মক্ষম লোকদের কাজকর্ম না করে অলস বসে থাকা বা অন্যায়ভাবে রিযিকের অন্বেষণ করতে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। উমর (রাঃ) বলেন ঃ তোমাদের কেই যেন রিযিক অন্বেষণ থেকে বসে পড়ে এ দু’আ না করে যে, আয় আল্লাহ! আমাকে রিযিক দান করুন। তোমাদের তো জানা আছে, আসমান স্বর্ণ- রুপা বর্ষণ করে না, বরং আল্লাহ মানুষদেরকে পরস্পরের মাধ্যমে রিযিক প্রদান করেন। মাসহারা এবং কাজের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান প্রসঙ্গে কুরআনে কারীমের নির্দেশনা হচ্ছে; মানুষ তাই পায়, যা সে করে। উপার্জনকে হালাল মনে করে গ্রহণ করাও সরকারি কর্মকর্তাদের কর্তব্য।
উপরোক্ত আলোচনায় পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, ইসলামী শিক্ষার আলোকে সরকারি পদ ও সম্পদের উদ্দেশ্যই হলো জনগণের সেবা করা। সরকারি পদমর্যাদায় অধিষ্ঠিত হতে হলে তার মধ্যে আবশ্যক কিছু গুণাবলি বিদ্যমান থাকতে হবে। যেমন জ্ঞান, শারীরিক ও মানসিক সক্ষমতা ইত্যাদি। ইসলাম সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারীদেরকে ঘুষ ও উপঢৌকন গ্রহণ, স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি ও অপকর্ম থেকে নিষেধ করেছে। ইসলাম এ শিক্ষাও দিয়েছে যে, সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারীদের সবসময় দেশের ও রাষ্ট্রের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে কাজ করতে হবে এবং সরকারি সম্পদকে নিজ মালিকানাধীন সম্পদের ন্যায় মনে করা ও নিজ প্রয়োজনে ব্যবহারের কোন সুযোগ নেই। অতএব রাষ্ট্রীয় পদ ও জাতীয় সম্পদের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের কর্তব্য হলো, তারা সুন্নাহ থেকে সরকারি চাকুরির নীতি মালা অনুধাবন করবেন এবং সে অনুসারে আমল করবেন, বিদ্যমান রাষ্ট্র ব্যবস্থায়কে ইসলামী আদর্শের আলোকে গড়ে তুলবেন, তবেই রাষ্ট্রব্যবস্থায় যে অনিয়ম, সুপারিশ, ঘুষ গ্রহণ ও অবৈধ পন্থায় সম্পদের পাহাড় গড়ার প্রবণতা পরিলক্ষিত হচ্ছে তার লাগাম টেনে ধরা সম্ভব হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন