সব সময়ই নতুনের প্রতি আগ্রহটা বেশি। নতুন কোন জায়গা অথবা দর্শণীয় স্থানের কথা বললে তো অস্থিরতা আরো বেড়ে যায়। সরকারী চাকরীর সুবাদে দেশের অনেক বিখ্যাত দর্শণীয় স্থান ঘুরেছি। দেশের বাইরেও যেখানে গিয়েছি সেখানেও সেদেশের জনপ্রিয় দর্শণীয় স্থান দেখতে পিছুপা হইনি। আজ আমি সংক্ষেপে মধ্যেপ্রাচ্যের পারস্য উপসাগরীর কুয়েতের রাজ্যের কিছু দর্শনীয় স্থানের কথা বলবো-
কুয়েত রাজ্যটি ছোট ও তেল সমৃদ্ধ, দক্ষিণে সৌদি আরব ও উত্তরে ইরাক বেষ্টিত রাজতান্ত্রিক। এর আয়তন ১৮৭৮২ বর্গ কিঃমিঃ, জনসংখ্যা ৪৭ লাখ, স্থানীয় ১৭ লাখ। কুয়েতের রাজধানীর নাম কুয়েত সিটি। দেশটির সাথে ১৯ জুন ১৯৬১ সালে ‘ব্রিটিশদের নিরাপত্তা দান চুক্তি’ বাতিল হয়ে গেলে কুয়েতের স্বাধীনতা ঘোষিত হয়। স্বাধীন হওয়ার পরেও পাশ্চাত্যের লোলুভ দৃষ্টিতে বারবার নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশটি। কুয়েতে দুইটি জাতীয় দিবস পালন করা হয়, একটি ২৫ ফেব্রুয়ারি অন্যটি ২৬ ফেব্রুয়ারি। কুয়েতের ইতিহাস থেকে জানা যায় ১৯৫০ সালের ২৫শে ফেব্রুয়ারি শেখ আব্দুলাহ আলসালিম আল সাবাহ আমির হয়ে ব্রিটেনের সাথে চুক্তি বাতিল করে নতুন সংবিধান ঘোষণার পর দেশটির প্রথম জাতীয় সংগীত ব্যবহার করেন। আর ২৬শে ফেব্রুয়ারি ১৯৯১ সালে ইরাকি আগ্রাসন থেকে পূর্ণ স্বাধীনতার স্বাদ গ্রহন করে। তাই কুয়েতিরা ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি কুয়েতের জাতীয় ও স্বাধীনতা দিবস পালন করে থাকে।
এদেশে শীতের যেমন তীব্রতা, গরমও তেমন তেজস্বী। দিনের তাপমাত্রা মাইনাস ৩ ডিগ্রিতেও ঘর থেকে বের হওয়া কষ্টকর। তেমনি গরমের সময়ও ৫০-৬৩ ডিগ্রিতে কাজ করা দুঃসাধ্য। মধ্যপ্রাচ্যের এই দেশটিতে যেমন আছে বিস্তীর্ণ ধুধু মরুভূমি তেমনি আছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যও। মরুভূমিতে যাওয়ার পথে দুইচোখে যা দেখেছি অনেক সময়ই ফেরার পথে তেমনটি আর পাওয়া যায়নি। অবিরাম ছুটে চলা বাতাসের সাথে উড়ে আসা বালিতে ঢেকে যায় মরুভূমিতে গাড়ি চলাচলের ‹টায়ার মার্ক’ও। যেদিকে চোখ যায় শুধু জনমানবশূন্য বসতিবিহীন তেপান্তর। গরমের সময় সূর্যের আলোতে মরিচিকার ফাঁদে দিকভ্রমও ঘটে।
আমাদের দেশে হঠাৎ বৃষ্টি নামলে মানুষের মনে প্রশান্তি ছুঁয়ে যায়, ভালোলাগার অনুভূতির প্রকাশ করতে ছেলে-বুড়ো সবাই বাড়ির বাইরে চলে আসে। কিন্তু এদেশে হঠাৎ আকাশে মেঘ জমলে মানুষজন ছুটোছুটি করে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যায়। কারণ, এদেশে ঝড়ে সমতলের উপর দিয়ে ছুটে চলে প্রবল স্রোতের মত রাশিরাশি বালি। এতো বিড়ম্বনার মাঝেও সানগ্লাসের ফাঁকে চোখ রাখলে এই ঝড়ের সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়।
কুয়েত লিবারেশন টাওয়ারঃ কুয়েতের রাজধানী কুয়েত সিটি পারস্য উপসাগরের তীর ঘেষে গড়ে উঠেছে। পারস্য উপসাগরের বুকে তৈরী করেছে ভ্রমণ পিপাসুদের জন্য নানা ধরনের দৃষ্টিনন্দন স্থাপনা, আছে উলেখযোগ্য ও বিখ্যাত দর্শণীয় স্থান। কুয়েত সিটির প্রাণকেন্দ্র ‹মিরকাব› (মুরগাব)। এখানেই আছে বিশ্বের ৩৯তম দৃষ্টিনন্দন উঁচু টাওয়ার। যার নাম কুয়েত লিবারেশন টাওয়ার। এর উচ্চতা ৩৭২ মিটার বা ১২২০ ফুট। রাতের বেলায় এই রূপসী সৌন্দর্য বিলায় অহর্ণিশ। এই টাওয়ারটি বছরে একবার স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে দর্শনার্থীদের জন্য খোলে দেয়া হয়। টাওয়ারের উপরের ল্যান্ডিং থেকে সমগ্র কুয়েতকেই দেখা যায়।
কুয়েত টাওয়ার্সঃ সাগরতীরে অত্যন্ত দৃষ্টিনন্দন ও উঁচু মাথায় পাশাপাশি দাড়িয়ে আছে তিনটি টাওয়ার। পৃথিবীর অন্যতম সৌন্দর্য ও আধুনিক স্থাপত্যের অসাধারণ কারুকাজের সৌন্দর্যের প্রতীক এই কুয়েত টাওয়ার। ডেনিশ স্থপতি মালেনে বজোরন টাওয়ার দলের নকশা করেন। বড় টাওয়ারটির উচ্চতা ১৮৭ মিটার (৬১৪ ফুট), এর মাথায় দুইটি গোলক আছে উপরের গোলকটি ছোট এবং নিচের গোলকটি বড়। অন্য টাওয়ারটির উচ্চতা ১৪৭ মিটার (৪৮২ ফুট), এর মাথায় একটি গোলক আছে। তৃতীয় টাওয়ারটি নিচ থেকে উপরের দিকে সূচালো হয়ে উঠে গেছে। সন্ধ্যার পর এই একদল টাওয়ারের দিকে তাকালে চোখ ফেরানোই কষ্টকর।
গ্রীণ আইল্যান্ডঃ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপর নাম সবুজ গাছ-গাছালি। নাম দেখেই বুঝা যায় এই মরুর দেশে এ যেন এক সবুজ স্বর্গ। পারস্য উপসাগরের প্রায় তীর ঘেষেই অবস্থান এই ছোট সবুজ দ্বীপের। পার্ক, ফুটবল খেলার মাঠ, রেস্টুরেন্ট, শুটিং স্পট এবং এই আইল্যান্ড এর একপাশে হাজার হাজার ছোট, মাঝারি গাছের সারি অন্য পাশে বৃত্তের মত পানির উপর দিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে চলার পথ। এছাড়াও রয়েছে পর্যবেক্ষণ টাওয়ার, যার উপর থেকে কুয়েত টাওয়ার একেবারেই কাছে দেখা যায় এবং আরেক প্যাঁচানো টাওয়ারের উপর থেকে সন্ধ্যার পর নানান রঙে আলোকিত স্থাপনাগুলো অনায়াসে দেখে যেকোন পর্যটক তৃপ্তি পেতে পারেন। একটা দিন সেখানে কাটিয়ে এলে মৃত্যু অবধি দাগ কেটে রবে মনে। বন্ধুদের সাথে গান, আড্ডা ও ছবি তুলে খুবই আনন্দে কাটিয়েছি একটি দিন। ক্যাম্প বুবিয়ান আইল্যাণ্ডঃ কুয়েত সিটি থেকে রাস্তাটি সাগরের মধ্য দিয়ে গিয়ে শেষ হয়েছে বুবিয়ান আইল্যান্ডে। রাস্তার দুপাশে জোয়ারের সময় থৈথৈ পানি আর ভাটার সময় বিস্তীর্ণ বালুকাবেলা। ঝাঁকবেঁধে সামুদ্রিক পাখিরা খাদ্যের সন্ধানে উড়তে থাকে, যা দেখে অনায়াসে সুখের কাব্য লেখা যায়। বুবিয়ান আইল্যান্ডে রয়েছে ছোট্ট সেনা ক্যাম্প। সেনা ক্যাম্পের পর্যবেক্ষণ টাওয়ারে উঠে সামনে দৃষ্টি বাড়ালেই সাগরের ঢেউ দেখা যায় এবং শোনা যায় ঢেউয়ের একটানা গর্জন। সেনা ক্যাম্পটিতে রয়েছে ইরাক যুদ্ধের সময় সৈনিকদের নিরাপত্তায় নির্মিত মজবুত কংক্রিটের ব্যাংকার। এছাড়াও পর্যবেক্ষণ টাওয়ার থেকে সামুদ্রিক মাছ ধরার ট্রলারগুলোকে কাগজের নৌকার মত দেখায়। যা প্রকৃতির আরেক অপরূপ দৃশ্য।
সাফাত স্কয়ারঃ কুয়েত সিটির অন্যতম জনবহুল এলাকা মুরগাব সিটি। বাংলাদেশীদের অন্যতম মিলনমেলার স্থান ‹সুক আল-ওয়াতানিয়া›র পাশেই এই বিখ্যাত ও দৃষ্টিনন্দন স্থান।বিকেল থেকেই জনসমাগম বাড়তে থাকে, মোবাইল রেস্টুরেন্টগুলোতে তখন উপচেপড়া ভিড়। ভিড় ঠেলে এগিয়ে গেলেই চোখে পড়বে অসাধারণ কারুকার্য ও নানা রঙের বিজলী বাতির সমন্বিত চোখ ধাঁধানো পানির ফোয়ারা। বিভিন্ন দিবসে বিভিন্ন রঙের দৃশ্য ফুটে উঠে ওই পানির ফোয়ারায়। যা দেখে মুগ্ধ হয়ে যেতে হয় সবারই।কুয়েতের আরও অনেক বিশ্বনন্দিত স্থানে গিয়েছি যা অন্য কোন দিন বলবো।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন