গতকাল বৃহস্পতিবার দৈনিক ইনকিলাবের প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায় যে, ঢাকার ধানমন্ডি, গ্রিন রোড, কলাবাগান, সায়েন্স ল্যাব, কাঁঠাল বাগানসহ অনেক এলাকার লাখ লাখ মানুষ দৈনিক একঘণ্টা করে ৭-৮ বার অর্থাৎ ৭-৮ ঘণ্টা লোডশেডিংয়ের দুর্ভোগ পোহাচ্ছে। রিপোর্টে বলা হয়েছে যে, এই সরকারের সাড়ে সাত বছর শাসনের পর এমন দীর্ঘস্থায়ী এবং প্রলম্বিত লোডশেডিং হওয়ার কথা নয়। কারণ ইতোমধ্যেই সরকার অর্ধশতাধিক ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র বেসরকারী খাতে স্থাপনের অনুমতি দিয়েছে এবং সেইগুলো সবই উৎপাদনে গেছে বলে অতীতে একাধিকবার বলা হয়েছে। এরপর আর লোডশেডিং থাকার কথা নয়। এসব ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রকে রেন্টাল বা কুইক রেন্টাল পাওয়ার প্ল্যান্ট বলে। ওই রিপোর্টে আরো বলা হয়েছে যে, ওইসব ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র ছাড়াও ভারত থেকে ৬শ’ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করা হচ্ছে। এর পরে তো আর দৈনিক ৭-৮ বার লোডশেডিং হওয়ার কথা নয়। কিন্তু তারপরেও লোডশেডিং হচ্ছে। শুধু ঢাকার কোনো কোনো অঞ্চলেই যে লোডশেডিং হচ্ছে তাই নয়, মফস্বলেও লোডশেডিং হচ্ছে। মফস্বলের লোডশেডিং সম্পর্কে ওই রিপোর্টে একটি পরিসংখ্যান দেয়া হয়েছে। রিপোর্টে বলা হয়েছে, ঢাকায় বিদ্যুৎ বিতরণকারী দু’টি কোম্পানি ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি) ও ঢাকা বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানি (ডেসকো) সূত্রে জানা গেছে, কয়েক দিন ধরে এই দু’টি কোম্পানির মোট লোডশেডিং হচ্ছে প্রায় ৩০০ মেগাওয়াট। ঢাকার বাইরে প্রতিটি শহর-নগরে লোডশেডিং ও বিদ্যুৎ বিভ্রাট এখন নৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর পল্লী বিদ্যুতের (আরইবি) আওতাধীন বিস্তীর্ণ গ্রামাঞ্চলের অবস্থা আরও খারাপ। আরইবি’র এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, গত ৯ মে, সোমবার তারা লোডশেড করেছে ১১৭৭ মেগাওয়াট। এর মধ্যে রাজশাহী অঞ্চলে ২৬৫; ঢাকা অঞ্চলে (ডিপিডিসি ও ডেসকোর এলাকা ছাড়া) ৩৮৫; ময়মনসিংহ অঞ্চলে ৫৯; যশোর ও খুলনা অঞ্চলে ১৩১; রংপুর অঞ্চলে ১২৩; চট্টগ্রাম অঞ্চলে ৮৩; কুমিল্লা অঞ্চলে ৮১; বরিশাল অঞ্চলে ৩০ ও সিলেট অঞ্চলে ২০ মেগাওয়াট লোডশেডিং করা হয়েছে। এই লোডশেডিং ছাড়া সঞ্চালন ব্যবস্থার সমস্যার কারণে ৩৭০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ বিঘিœত হয়েছে। বর্তমানে আরইবি’র দৈনিক সর্বোচ্চ চাহিদা চার হাজার মেগাওয়াটের বেশি। এসব ছাড়াও এই সরকার আসার পর থেকে বিশেষ করে বিগত তিন চার বছরে বিদ্যুতের মূল্য বাড়ানো হয়েছে ৬ গুণ। ইউনিট প্রতি বিদ্যুতের যে মূল্য বেড়েছে সেটি একটি টেকনিক্যাল হিসাব। আমরা সেই টেকনিক্যাল দিকে না গিয়েও বলতে পারি যে, প্রতিটি বাসা-বাড়ীর বিদ্যুৎ বিল ৩/৪ বছর আগের তুলনায় বর্তমানে অন্তত ৫গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। একজন সাধারণ মানুষ, যাকে মাত্র ৫০০ টাকা বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করতে হতো, তাকে এখন মাসে অন্তত আড়াই হাজার টাকা বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করতে হয়। সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, বিদ্যুৎ ব্যবহার বাবদ এতো বেশী টাকার বিল পরিশোধ করার পরেও এই দীর্ঘ সময়ের জন্য লোডশেডিংয়ের দুর্ভোগ পোহাতে হবে কেন?
পাঠকদের হয়তো স্মরণ আছে যে, এই সরকার যখন ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসে তখন বলা হয়েছিলো যে, বিদ্যুতের তীব্র সংকট দূর করার জন্য সাময়িক ব্যবস্থা হিসেবে ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের অনুমতি দেয়া হচ্ছে। এসব কেন্দ্র ২/৩ বছরের জন্য স্থাপনের অনুমতি দেয়া হচ্ছে। এই সময়ের মধ্যে বড় বড় বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রসমূহ স্থাপিত হলে এবং উৎপাদনে গেলে ভাড়ায় চালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো বন্ধ করে দেয়া হবে। তার পর সুদীর্ঘ সাড়ে সাত বছর পার হয়ে গেছে। পিকিং প্ল্যান্ট, রেন্টাল বা কুইক রেন্টাল এখনো বহাল তবিয়তে আছে। যেসব বড় বড় বিদ্যুৎ কেন্দ্র উৎপাদনে আসার কথা ছিলো সেগুলোর কোনো দেখা নাই। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, সরকার ২ হাজার ৩শ’ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ৬টি বড় বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য সাড়ে ১৩ হাজার কোটি টাকা জোগাড় করতে পারছে না, অথচ প্রতিবছর রেন্টাল আর কুইক রেন্টাল খাতে ভর্তুকি দিয়ে যাচ্ছে ১০-১২ হাজার কোটি টাকা। জানা গেছে, বড় পুকুরিয়ায় ২৫০ মেগাওয়াট, ঘোড়াশালে ৩০০-৪৫০ মেগাওয়াট, আশুগঞ্জে ৪৫০ মেগাওয়াট এবং সিরাজগঞ্জে ৪৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের জন্য ২০১৩ থেকে ২০১৫ সালকে লক্ষ্যমাত্রা হিসেবে নির্ধারণ করলেও এখনো কাজের কাজ কিছুই হয়নি।
বিশেষজ্ঞদের মতে মাঝারী বা বড় আকারের একটি বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট প্রতিষ্ঠা করতে ৩/৪ বছর লাগে। কয়লা এবং পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ইউনিট প্রতি উৎপাদন খরচ যদি হয় ২ টাকা হয় তাহলে গ্যাস চালিত কেন্দ্রে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ইউনিট প্রতি ব্যয় হয় ৪ টাকা। আর তেলচালিত কেন্দ্রে ইউনিটপ্রতি ব্যয় হয় প্রায় ১৬ টাকা। রেন্টাল বা কুইক রেন্টাল প্ল্যান্টগুলো তেলচালিত। সুতরাং এগুলো পোষা মানে হাতি পোষা। সেই জন্যই বৃহৎ আকারে বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট স্থাপনের জন্য কয়লা বা পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্রকে বেছে নেয়া হয়। অথবা প্রয়োজনীয় গ্যাস থাকলে গ্যাসচালিত বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। পারমাণবিক শক্তিচালিত বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচও কম। কিন্তু বাংলাদেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের এতোগুলো বিকল্প থাকা সত্ত্বেও রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল অর্থাৎ তেলচালিত বিদ্যুৎ উৎপাদন আজ সাড়ে ৭ বছর হলো অব্যাহত রাখা হয়েছে। এ সব বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট চালু রাখার জন্য সরকারকে বছরে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা গচ্চা দিতে হচ্ছে। তার পরেও এ সব হাতি পোষা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এর কারণ হলো সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা ধন্য মুষ্টিমেয় কয়েক ব্যক্তির পকেট ভারী করা। সরকারী সমর্থনপুষ্ট এ সব ব্যক্তি তাদের কায়েমী স্বার্থ অব্যাহত রাখার জন্য তেল ছাড়া অন্যান্য বিকল্পভিত্তিক মাঝারী বা বড় আকারের বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠায় বাধা দিচ্ছে। অন্যদিকে এদেরকে যেভাবে সরকারী অনুগ্রহ বিতরণ করা হয়েছে সেটিকেও দায় মুক্ত করা হয়েছে। তাদেরকে সিলেক্ট করার জন্য কোনো নীতিমালা বা বিধিমালা প্রণয়ন করা হয়নি। তাদেরকে যে ভর্তুকি দেয়া হচ্ছে, সেই ভর্তুকি এবং খেয়াল খুশি মতো তাদের নির্বাচনকে আদালতে চ্যালেঞ্জ করা যাবে না। অথবা তাদেরকে প্ল্যান্ট বরাদ্দ করার ব্যাপারে জাতীয় সংসদেও কোনো প্রশ্ন তোলা যাবে না। তাদেরকে এইরূপ বহুমুখী সুযোগ-সুবিধা দেয়ার পরেও জনগণ আজও কেন ৭-৮ দফা লোডশেডিংয়ের দুর্ভোগ পোহাবে সেটিই আজ সবচেয়ে বড় প্রশ্ন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন