শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

ইসলামী জীবন

আল্লাহ্র অস্তিত্ব : আধুনিক বিজ্ঞান ও দর্শন তত্ত¡

মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান | প্রকাশের সময় : ২৯ মার্চ, ২০১৯, ১২:০৬ এএম

 

এক
আল্লাহ্র অস্তিত্বের ধারণা ও স্বীকৃতি মানব প্রকৃতির মধ্যেই বিদ্যমান। “সূরা ২৯, আয়াত ৬১, ৬৩”। কিন্তুু সর্বকালে ও সর্বদেশে আল্লাহ্র ধারণা, তাঁর প্রকৃতি প্রভৃতির রূপ একই রকম ছিল না; এমনকি বর্তমানেও নেই। তাছাড়া ধর্মে আল্লাহ্র অস্তিত্বের বিষয়টি প্রধান কেন্দ্রবিন্দু হলেও দৃশ্যত বিভিন্ন ধর্মে আল্লাহ্র প্রকৃতি, গুণাগুণ, সংখ্যা প্রভৃতির মধ্যে বিস্তর পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। এহেন পরিস্থিতিতে ধর্মীয় ইতিহাস পর্যালোচনা করে আদিতে প্রত্যেক ধর্মই যে এক আল্লাহ্র দিকে মানুষকে আহ্বান জানিয়েছে সেটি নিরূপণ করা প্রয়োজন। তাছাড়া বর্তমান যুগ জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিষ্ময়কর আবিস্কারের যুগ। এমতাবস্থায় বিজ্ঞানী এবং দার্শনিকদের মন থেকে আল্লাহ্র অস্তিত্বের ধারণা কি মুছে গেছে, না প্রখ্যাত সব বিজ্ঞানী ও দার্শনিক আল্লাহ্র অস্তিত্বে বিশ্বাস রাখেন- এ বিষয়ে দৃষ্টি দেওয়া সময়ের দাবী। কিন্তুু আমার জানা মতে, বাংলা ভাষায় ঠিক এই আংগিকে উল্লেখযোগ্য গবেষণামূলক প্রবন্ধ বা গ্রন্থ খুব কমই লক্ষ্য করা যায় বিধায় বর্তমান প্রবন্ধের উদ্দেশ্য হচ্ছে “আল্লাহ্ সম্পর্কে দর্শন, পরিবেশ, বিজ্ঞান ও ধর্মের দৃষ্টিভঙ্গি” নিরূপণ করা। উপরোক্ত উদ্দেশ্য অনুসারে সাধারণভাবে মানুষের মনে আল্লাহ্র ধারণা, বিজ্ঞানে আল্লাহ্র ধারণা, দর্শনে আল্লাহ্র ধারণা, বিভিন্ন ধর্মে আল্লাহ্র ধারণা, একত্ববাদের ধারণা, আল্লাহ্র সঙ্গে জীব জগতের সম্পর্ক, আল্লাহ্র প্রকৃতি, আল্লাহ্র অস্তিত্ব এবং সবশেষে আল্লাহ্র সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক বিষয়ে বিভক্ত করে প্রবন্ধের আলোচনাকে সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছে। নিম্নে এতদ্সম্পর্কিত বিষয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হল ঃ
মানুষের মনে আল্লাহ্র ধারণা বিষয়ে বলতে গেলে প্রথমেই যেটা বলা প্রয়োজন মনে হয় সেটি হলো, মানুষ কমবেশী ধর্মভাবাপন্ন। আদিম যুগ থেকে বর্তমানকাল অবধি প্রত্যেক সমাজই জগতের একজন স্রষ্টা আছে বলে বিশ্বাস করে। “আমিনুল ইসলাম, জগৎ জীবন দর্শন (বাংলা একাডেমী, ঢাকা, প্রথম পুনূমুদ্রণ, ১৯৯৫), পৃ. ১৭৭”। কেননা মানুষের প্রকৃতিতে ও অনুভূতিতে একজন সৃষ্টিকর্তা ও অধিকর্তার ধারণা জন্মগতভাবে সম্পৃক্ত রয়েছে। এটা হচ্ছে তার অবচেতন মনের একটি অনিবার্য অংশ। আর এই কারণেই যারা আল্লাহ কে পেতে আগ্রহী হয় না, তাদের আগ্রহ উদ্দীপনা অন্য কোন কৃত্রিম জিনিসের দিকেই ধাবিত হয়। মানুষ মাত্রই নিজের অন্তরে এই বাসনা পোষণ করতে বাধ্য যে, এমন কোন বস্তুু ব্যক্তি বা সত্তা তার নাগালের মধ্যে আসুক যার সামনে সে তার জীবনের শ্রেষ্ঠতম উপলব্ধিকে উৎসর্গ করতে পারে। তবে এটা ঠিক যে, এ অনুভূতি যেহেতু প্রকৃত গত তাই তা প্রথমে স্বাভাবিক আকারেই প্রকাশিত হয়। এর প্রথামিক ঝোঁক থাকে নিজের প্রকৃত ইলাহ্ (মাবুদ)- এর দিকে, পরে অবস্থা ও পরিবেশের প্রভাবে তা ভ্রান্তির দিকে মোড় নেয়। আর তাই মানুষ যখন কিছুদিন একটি বিশেষ জীবন ধারায় অভ্যস্ত হয়ে ওটে তখন সেটার মধ্যেও সে এক ধরনের স্বাদ পেতে থাকে। এই করণে যে সমস্ত মহাপন্ডিতকে আল্লাহ্ নেই বলতে শোনা যায় তারাও আল্লাহ্কে আপন উপাস্য হিসেবে মেনে না নিলেও অপর একজন উপাস্যের প্রয়োজন থেকে নিজেকে নির্লিপ্ত রাখতে পারেন না। এ প্রসঙ্গে বিবিসিতে ১৯৫৯ সনে ফ্রিম্যানকে দেয়া বাট্রান্ড রাসেলের একটি কথোপকথনকে এখানে উল্লেখ করা মনে হয় মোটেও অপ্রাসংগিত হবে না। ফ্রিম্যান রাসেলকে জিজ্ঞাসা করেন, “আপনি কি সার্বিকভাবে অংক ও দর্শন চর্চাকে ধর্মীয় চর্চার শ্রেষ্ঠ বিকল্প হিসেবে পেয়েছেন?” রাসেল উত্তর দেন, “জী, হ্যা, নিশ্চিতভাবে আমি চল্লিশ বছর বয়স পর্যন্ত এই প্রশান্তি থেকে বঞ্চিত ছিলাম যার সম্পর্কে প্লেটো বলেছেন, ‘আপনি অংক শাস্ত্র দ্বারা তা লাভ করতে পারেন, সত্যি এটা একটা চিরন্তন বিশ্ব, কালোত্তীর্ণ জগৎ। যেখানে আমি সেই প্রশান্তি লাভ করেছি, যা ধর্মের মধ্যে পাওয়া যায়।” “ড. ওয়াহীদুদ্দীন খান, আধুনিক চিন্তাধারা বনাম ধর্ম, অনুবাদক, আব্দুল মতীন জালালাবাদী (ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ঢাকা, ১৯৮৮) পৃ. ২০২”। মানব প্রকৃতির এইস্বরূপটিই পবিত্র কুরআনের নিম্নোক্ত আয়াতে পরিস্কারভাবে ফুটে উঠেছে, “যদি অবিশ্বাসীদের তুমি জিজ্ঞেস কর, কে তাদের সৃষ্টি করেছে? তারা নিশ্চয় বলবে- আল্লাহ্ তবু তারা সত্য পথ থেকে কী করে বিপথগামী হয়?” সূরা ৪৩, আয়াত ৮৭”
শুধু তাই নয়, প্রকৃত আল্লাহকে ভুলে নিজের ইচ্ছামত মানুষ যে অন্য কাউকে আল্লাহ্ হিসেবে বেছে না নিয়ে থাকতে পারে না সেটাও কুরআনে বিবৃত হয়েছে। বলা হয়েছে, “হে নবী! যে ব্যক্তি নিজের নফসের খাহেশাতকে নিজের খোদা বানিয়ে নিয়েছে তুমি কি তার সম্পর্কে ভেবে দেখেছ?” “সূরা ২উপরের আলোচনা হতে একথা বলা যেতে পারে যে, আবহমান কাল থেকে মানুষের আল্লাহ্ সম্পর্কিত ধারণা বদ্ধমূল। যদিও পরিবেশগত বিভিন্ন কারণে বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন ধরনের মানুষের কাছে এ ধারণার রূপ বিভিন্ন। এবার দর্শনে এ বিষয়ে দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন।
প্রথমেই উল্লেখ করা হয়েছে মানব প্রকৃতির মধ্যে আল্লাহ্ র ধারণা কোন না কোনভাবেই বিরাজমান থাকে। এখন এই মানুষই বুদ্ধি-বিবেচনা ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিশ্লেষণকল্পে বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। দার্শনিক ও বিজ্ঞানী শ্রেণী তাদের মধ্যে অন্যমত। দর্শনের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, নিসর্গবাদ (চধমধহরংস) দিয়েই দর্শনের সূচনা হয়েছে। “ড. আব্দুল হাই তালুকদার, গ্রীক দর্শনের ইতিহাস (থেলিস থেকে প্লাটিনাস), কাজলা, রাজশাহী, ১৯৯১”। যেটাকে পাশ্চত্য দর্শনের ইতিহাসে প্রাচীন যুগ নামে আখ্যায়িত করা হয় । কিন্তুু এই ধারা সমসাময়িক কয়েকজনের মধ্যে থাকলেও অল্প কিছুদিনের মধ্যে দেখা যায় দাশনিকরা প্রত্যয়বাদের দিকে ঝুঁকে পড়েছেন। তাইতো দর্শনের ইতিহাসে জগতের মূল সত্তা হিসেবে থেলিসকে পানি (Water), এ্যনাক্সিমেন্ডারকে সীমাহীন Boundless), এ্যানাক্সিমিনিসকে বায়ু (Air), হেরাক্লিটাসকে হেরাক্লিটাসকে অগ্নি (Fire) বলতে যেমন শোনা যায় ঠিক তেমনি সক্রেটিস, প্লেটো ও এরিষ্টটলের মত মহান চিন্তানায়কদের প্রত্যয়বাদের পক্ষে জোর সমর্থন দিতে দেখা যায়। “প্রাগুক্ত, পৃ. ৯; W.T. Stace, A Critical History of Greek Philosophy (London: Macmillan and Co. Ltd. ১৯৬০).” এরপর খৃষ্ট ধর্মের সংস্পর্শে এসে এই প্রত্যয়বাদ আরো গুরুত্ব লাভ করে। ফলে মধ্যযুগীয় পাশ্চত্য দর্শনে আল্লাহ্র একত্বকে যুক্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করার এক বিরবচ্ছিন্ন প্রয়াস লক্ষ্য করা যায়- যাঁদের দলে সেন্ট-অগাষ্টিন, প্লাটিনাসসহ আরো অনেক জাত্যাভিমান দার্শনিকের পরিচয় মেলে। “নূরুল ইসলাম মানিক, ইসলামী দর্শনের রূপরেখা (ঢাকা ঃ ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ১৯৮২), “ভূমিকা”। এরপর পঞ্চদশ শতক-রেনেসাঁর পর হতে যাকে পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিহাসে আধুনিক যুগ নামে।
অভিহিত করা হয়, সেখানে বুদ্ধি ও অভিজ্ঞতার সমান প্রভাব দৃষ্ট হয়। ফলে আল্লাহ্র ধারণাও দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে। বুদ্ধিবাদীদের মধ্যে ডেকার্ট (যিনি আধুনিক পাশ্চাত্য দর্শনের জনক নামে খ্যাত), লাইবনিজ এবং অভিজ্ঞতাবাদীদের মধ্যে জন লক, জর্জ বাকলী প্রমুখকে যেমন আল্লাহ্-বিশ্বাসের পক্ষে জোর সমর্থন দিতে দেখা যায় ঠিক তারই পাশাপাশি ডেভিড হিউমের মত চরম অভিজ্ঞতাবদী দার্শনিকেরও পরিচয় মেলে যিনি পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের বাইরে এক কদমও পা ফেলতে রাজী হননি। যার ফলশ্রুতিতে তিনি শুধু আল্লাহ্র অস্তিত্বকে অস্বীকার করেন নি সাথে সাথ কার্যকারণ তত্তে¡র চিন্তামূলেও কুঠারাঘাত হানেন। “শ্রী প্রমোদবন্ধু সেনগুপ্ত, পাশ্চাত্য দর্শনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাসা (আধুনিক) (ব্যানার্জী পাবলিশার্স, কলিকাতা, ষষ্ঠ সংস্করণ, ১৯৬৩-৯৪), অধ্যায়-নবমঃ Bertrand Russell, History of Western Philosophy (London : George Allen and Unwin Ltd. 1971), Book Three, Part-1, Chapter-XVII” অবশ্য আধুনিক দর্শনের সূচনায় ইন্দ্রয়লব্ধ জ্ঞান ও বুদ্ধিজাত জ্ঞানকে বেশী প্রাধান্য দেওয়ায় স্বজ্ঞালব্ধ (ওহঃঁরঃরড়হ) জ্ঞান প্রায় লুপ্ত হওয়ার পথে ছিল। যার নিবু নিবু প্রকাশ স্পিনোজা ও শেলিং এর মধ্যে লক্ষ করা যায়। শ্রী প্রমোদবন্ধু সেনগুপ্ত, পাশ্চাত্য দর্শন (ব্যানার্জী পাবলিশার্স, কলিকাতা চতুদর্শ সংস্করণ, ১৯৮৫) পৃ. ১০৩; Bertrand Russell, History of Western Philosophy, Book Three, Part-2, ChapterXXVIII. যার কারণে উপরোক্ত স্বজ্ঞাবাদী দার্শনিকরা এক অতিজাগতিক সত্তায় বিশ্বাস করতেন। কিন্তুু ইংল্যান্ড তথা ইউরোপ ও আমেরিকায় প্রথমে ‘বাস্তবাদ’ (জবধষরংস) এবং তারপর বিশ্লোষনী (অহধষুঃরপ) দর্শন প্রধান্য বিস্তার করার পর থেকে স্বজ্ঞা আবার তার অজ্ঞাতবাসে চলে যেতে বাধ্য হয়। এ বিশ্লেষণী ধারা কেবলমাত্র বস্তুুজগতকে অস্তিত্ব স্বনির্ভর বলে প্রমাণ করেই থামেনি।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন