আমাদের বুকের অনেকটা মাঝ বরাবর হার্টের অবস্থান। মায়ের গর্ভে থাকাকালীন অবস্থায় এর গঠন সমাপ্ত হয়। সারাশরীরে নিরন্তর রক্ত পাম্প করাই এর কাজ। অর্থাৎ হার্ট শরীরে রক্ত চলাচল বা পুষ্টি সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করে। যদি কোনও কারণে হার্ট সঠিক নিয়ম অর্থাৎ ছন্দে রক্ত পাম্প করতে না পারে, তবে রক্ত সরবরাহ বিঘিœত হয়ে দেহের যে কোনও অঙ্গের এমনকি হার্টের মাংসপেশিরও ক্ষতিসাধন হতে পারে। এ অবস্থায় বুকে ব্যথা অনুভত হবে, তবে দীর্ঘদিনের বা অনিয়ন্ত্রিক ডায়াবেটিক রোগীর হার্টের সমস্যার ব্যথা নাও থাকতে পারে। তাই ডায়াবেটিসকে বলা হয় সাইলেন্ট কিলার বা নীরব ঘাতক। 

* সাধারণত যে কোনও ধরনের পরিশ্রম করলে বা সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠলে বা এক্সারসাইজ করলে বুকে ব্যথা হয়। এ কাজ থেকে বিরত থাকলে বা পরিশ্রম কমিয়ে দিলে ব্যথা আস্তে আস্তে কমে যায়- এ থেকে হার্টের ব্যথা নিশ্চিতভাবে বোঝা য়ায়।
* এ ব্যথায় আক্রান্ত রোগীর মনে হবে যেন দম আটকে আসছে বা বুকের মধ্যে ভারি ওজন কেউ দিয়ে চেপে আছে বা বুক চেপে আসছে বা মৃত্যু আসন্ন । এমন হলে বোঝা যায়, তার একিউট বা হঠাৎ হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। এ অবস্থায় নিকটস্থ চিকিৎসক বা হাসপাতালে কিংবা হৃদরোগ বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হওয়া বাঞ্ছনীয়।
* ব্যথা বুকের বাম বা ডান যে কোনও পাশে হতে পারে। অনেকের ধারণা, হার্ট দেহের বাম পাশে বেশি অংশ থাকে বলে শুধুমাত্র বামপাশে ব্যথা হলেই তা হার্টের ব্যথা-যা ঠিক নয়।
*এ ব্যথা ছড়িয়ে যেতে পারে। নিচের চোয়ালে, ডান বা বাম হাতে বা গলার কাছে ব্যথা আসতে পারে। কারও যদি উপরের যে কোনও এক বা একাধিক লক্ষণ থাকে, তবে মোটামুটি নিশ্চিত হওয়া যায় তিনি হার্টের সমস্যায় ভুগছেন।
বুকব্যথা মানেই কি হার্টের ব্যথা : বুকব্যথা আরও অনেক কারণে হতে পারে। যেমন-মাংসপেশি ও হাড় থেকে, শ্বাস-প্রশ্বাস বা ফুসফুসের কোনও কারণে এবং বুকের নিচে পেটের কোনও কারণে। মনে রাখবেন, এ ব্যথাগুলোর কোনওটাই মৃত্যুঝৃঁকি বয়ে আনে না। তবে এর যথাযথ চিকিৎসা প্রয়োজন। উঠলে-বসলে, একাত-ওকাত হলে, নড়াচড়া করলে, শোয়া থেকে বসা বা বসা থেকে উঠলে যদি ব্যথা হয়, তবে ধারণা করা যায়, এটি মাংসপেশি বা হাড়জনিত কোনও ব্যথা। শ্বাসের সঙ্গে যদি ব্যথা কম-বেশি থাকে তবে ফুসফুসের কোনও সমস্যা থেকে এ ব্যথা হতে পারে। পেটে-বুকে জ্বালাপোড়া ভাবের সঙ্গে ব্যথা কিংবা খাওয়ার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত যেমন-খালি বা ভরা পেটে ব্যথা হলে বা বুকের মাঝখানে জ্বালা থেকে ব্যথা হলে ধরে নেয়া যায় এটি খাদ্যনালী বা পাকস্থলীজনিত কোনও ব্যথা। তবে হার্টজনিত ব্যথাই সবচেয়ে মারাত্মক। কারণ এ থেকে মৃত্যুঝুঁকি থাকে-তাই একে গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে।
কাদের হার্টের ব্যথা হতে পারে: * যাদের বয়স-৪০ এর ওপর। মহিলাদের চেয়ে পুরুষদের সাধারণত হার্টের সমস্যা বেশি হয়ে থাকে। * যারা ধূমপায়ী। ধূমপান রক্তনালীর দেয়াল পুরু করে রক্তনালী চিকন করে দেয়। একে এথেরোস্কে¬ারোসিস বলে। * যাদের উচ্চরক্তচাপ বা হাইপারটেনশন আছে। * যাদের রক্তে উচ্চমাত্রায় কলেষ্টেরল আছে। * যারা ব্যায়াম করেন না। * যারা সেডেন্টারি লাইফ ষ্টাইল বা অলস জীবনযাপনে অভ্যস্ত। * যাদের ফিজিক্যাল একটিভিটি কম। তবে এ ফ্যাক্টর বা ফ্যাক্টরগুলো না থাকলেও কারও হার্টের সমস্যা হতে পারে।
যেভাবে হৃদরোগ শনাক্ত করা হয়: হৃদরোগ বিশেষজ্ঞরা রোগীকে পরীক্ষা করেন এবং রোগের লক্ষণ ও ইতিহাস জেনে হৃদরোগ নির্ণয় করে থাকেন। এক্ষেত্রে কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষারও প্রয়োজন হয়ে থাকে। যেমন-ইসিজি-এটি কোনও সূ² পরক্ষিা বা কনফারমেটরি টেস্ট নয় । প্রাথমিকভাবে রোগ নির্ণয়ে ইসিজি সাহায্য করে। এক্সারসাইজে টলারেন্স টেস্ট বা ইটিটি-এর সাহায্যে হার্টের কন্ডিশন বা পারফরমেন্স টলারেন্স জানা যায়। করোনারি এনজিওগ্রামের সাহায্যে হার্টের রক্তনালীগুলো কী অবস্থায় আছে অর্থাৎ চেপে গেছে কিনা বা বøক আছে কিনা তা বোঝা যায়। রক্তনালী বেশি চেপে গেলে বেলুন করে রিং লাগানো হয়, কোনও কোনও ক্ষেত্রে অপারেশনের প্রয়োজন হতে পারে। এছাড়া আরও কিছু রুটিন টেস্টের দরকার হয় । হৃদরোগ কি প্রতিরোধ করা যায় : হৃদরোগ অনেক ক্ষেত্রেই প্রতিরোধযোগ্য। এ জন্য যা করতে হয় তা হলো-*ধূমপান থেকে বিরত থাকতে হবে। * উচ্চরক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। *ডায়াবেটিস পূর্ণমাত্রায় নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। *রক্তের কলেষ্টেরলের মান স্বাভাবিক মাত্রায় রাখতে হবে। * নিয়মিত ব্যায়াম করার অভ্যাস করতে হবে।
হঠাৎ বুকে ব্যথা হলে কী করবেন : প্রথমেই নিশ্চিত হতে হবে,এটি হৃদরোগজনিত ব্যথা কিনা। এ জন্য হৃদরোগ বিশেষজ্ঞের সঙ্গে অবশ্যই কনসাল্ট করতে হবে। হার্টের কারণে ব্যথা হলে রক্ত সরবরাহ বাড়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে। এ জন্য নাইট্রেট জাতীয় ওষুধ যেমন নাইট্রোগিøসারিন জিহবার নিচে দিলে হার্টে রক্ত সরবরাহ সাময়িকভাবে বাড়ানো যায়। মনে রাখবেন, হঠাৎ কারও এ সমস্যা হলে চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়াই নাইট্রোগিøসারিন ব্যবহার করা ঠিক হবে না। অনেকে এ অবস্থায় নিজে থেকে অ্যাসপিরিন জাতীয় ওষুধ খেয়ে নেন। পেটের সমস্যা থেকে এ ব্যথা হলে অ্যাসপিরিনে হিতে বিপরীত হবে। তাৎক্ষণিক চিকিৎসার জন্য নিকটস্থ ডাক্তার বা হাসপাতালে যেতে হবে।
হৃদরোগের চিকিৎসা : এর চিকিৎসার প্রথমেই প্রতিরোধের উপায়ের দিকে নজর দিতে হবে। হার্টডিজিজের রোগীদের দীর্ঘসময় এমনকি আজীবন অ্যাসপিরিন বা ক্লোপেডিগ্রিল জাতীয় ওষুধ খেতে বলা হয়। অ্যাসিপিরিনে কারও কারও এসিটিডির সমস্যা দেখা দিলে এন্টিআলসারেন্ট ওষুধ খেতে হয়। এছাড়া হেপারিন জাতীয় ওষুধেরও প্রয়োজন হতে পারে। এ ওষুধ বাংলাদেশের সর্বত্র এমনকি উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত পাওয়া যায়। এছাড়া অন্যান্য ওষুধের সাহায্যে হৃদরোগের চিকিৎসা করা হয়।
টাইম ইজ মাসেল : হৃদরোগ চিকিৎসায় একটি বহুল ব্যবহৃত বাক্য আছে, তা হলো টাইম ইজ মাসেল। অর্থাৎ হার্টে রক্ত চলাচল কমে যাওয়ার পর বা ব্যথা শুরু হওয়ার পর যত তাড়াতাড়ি হাসপাতালে যাওয়া যাবে তত হার্টের মাংসপেশির নেক্রোসিস বা ক্ষয় হওয়া রোধ করা যাবে। বলা হয় ৬-১২ ঘণ্টার মধ্যে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার বা বিশেষায়িত হাসপাতালে রোগীকে নিয়ে যেতে হয়।

চিকিৎসক-কলামিস্ট, মোবা : ০১৭১৬২৭০১২০