কাব্যের বিষয়বস্তু অনুসারে পাঠকের মনে বিচিত্র ধরণের অনুভূতির জন্ম হয়। দৈনন্দিন জীবনে ব¯‘জগৎ থেকে আমরা যে রস আস্বাদন করি তা ইন্দ্রিয়ের রসনার ফল। আর সাহিত্যের রস আস্বাদন করতে হয় অন্তরেন্দ্রিয় মন দিয়ে। মানুষের মন গহŸরে অসংখ্য ভাব সুপ্ত অবস্থায় নিহিত থাকে। চিত্তজগতে এইসব ভাবের গতিবিধি বড় বিচিত্র। এই ভাব একটি থেকে আরেকটি স্বতন্ত্র। অলংকার শাস্ত্রবিদরা এই ‘ভাব’- এর পরিণতিকেই রস হিসেবে অভিহিত করেছেন। তারা বিভিন্ন- শ্রেণিতে একে ভাগ করেছেন। এগুলো হলো : হাস্যরস, করুণরস, রৌদ্ররস, বীররস, ভয়ানক রস, বীভৎরস, অদ্ভূত রস, শান্তরস ইত্যাদি। আল মাহমুদের ‘‘পানকৌড়ির রক্ত’’ গল্পগ্রন্থে’ এই সম্ভোগরসের প্রাবল্য দেখা যায়।
কবি আল মাহমুদের প্রথম গল্পগ্রন্থ হলো ‘‘পানকৌড়ির রক্ত’’। এটি ঢাকার বর্ণমিছিল প্রকাশনী থেকে ১৯৭৫ সালে প্রকাশিত হয়। গ্রš’টি প্রকাশের পর পাঠক ও সমালোচকবৃন্দের মধ্যে ব্যাপক আলোচিত-সমালোচিত হতে থাকে। বিশেষ করে এ গ্রšে’র গল্পগুলোতে শৃঙ্গার রসের যে বর্ণনা রয়েছে তার শ্লীলতা-অশ্লীলতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। যৌনতা বিষয়ক বাক্যগুলো শিল্পিত কিনাÑ এ নিয়ে চলতে থাকে চুলছেঁড়া বিশ্লেষণ। অবশেষে আল মাহমুদই জয়ী হন তাঁর প্রতীকী ভাষা ও শিল্পিত বাক্যবিন্যাসের কারণে।
সম্ভোগ রস সাহিাত্য প্রাচীনকাল থেকেই চলে আসছে। সংস্কৃত সাহিত্যে তো এর জোয়ার প্রবলতর; কিছুটা ভয়াবহও বটে। বাংলাসাহিত্যের দ্বিতীয়গ্রš’ ‘‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’’সহ মধ্যযুগের অনেক কাব্যগ্রšে’ই শৃঙ্গার রসের প্রাবল্য লক্ষ্যণীয়। এর ধারাবাহিকতা আধুনিক সাহিত্যেও আছে। আল মাহমুদের সমসাময়িক লেখক সৈয়দ শামসুল হকের ‘‘খেলারাম খেলে যা’’ ও ‘‘নিষিদ্ধ লোবান’’ উপন্যাসে দেখা যায় শৃঙ্গার রসের খোলামেলা বর্ণনা। তাঁর মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক উপন্যাস ‘‘নিষিদ্ধ লোবান’’-এ ধর্ষণের আগে পাকিস্তানি মেজরের উক্তিÑ
সৈয়দ শামসুল হক এখানে অত্যন্ত খোলামেলা বর্ণনা দিয়েছেন। এজন্য অনেক সমালোচিত হয়েছেন তিনি। আল মাহমুদের গল্পে এমন খোলামেলা বর্ণনা দেখা যায় না। তাঁর নামগল্প ‘‘পানকৌড়ির রক্ত’’-এ আছে শৃঙ্গার রসের প্রতীকী ও শিল্পিত বর্ণনাÑ
‘আমি আমার একনলা বন্দুক হাতে ত্রিকোণাকৃতির চরাভূমির নরম পা মাড়িয়ে চলতে লাগলাম। নদীটা যেখানে বাঁক নিয়েছে আমি সেখানে এসে পেশাদার শিকারীর মতো হাঁটু গেঁড়ে বন্দুক বাগিয়ে বসলাম।...’’
মানুষের জীবনের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি আল মাহমুদের গল্পের মূল ক্যানভাস। নারীর রূপের বর্ণনা, প্রকৃতির সাথে নারীর তুলনা, পরিবার ও সমাজে নারীর অবস্থান এবং নিয়তির অমোঘতা তাঁর গল্পের কেন্দ্রবিন্দু। ‘‘পানকৌড়ির রক্ত’’ গল্পে চিত্রিত হয়েছে আল মাহমুদের গভীর গ্রামপ্রীতি। গল্পকথক গল্পটির প্রারম্ভেই প্রকৃতির বিচিত্র রঙ আর শোভার সাথে ভালোলাগার মানুষকে মিলিয়ে অনুভব করেন। কালো হলেও পানকৌড়ির দৈহিক সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হন তিনি; মনে পড়ে যায় সদ্য পরিণীতা স্ত্রীর মুখের আদল। রোদে গায়ের পানি শুকাতে-থাকা পানকৌড়ির মাঝে তিনি যেন কেবলই দেখতে পান চুল শুকাতে-থাকা স্ত্রী আদিনার শ্যামল বর্ণের নিটোল কচি-কোমল মুখ।
‘‘পানকৌড়ির রক্ত’’ গল্পের প্রতীকী তাৎপর্যের মধ্যে ফুটে উঠেছে স্বদেশ ও পল্লীপ্রকৃতি। গল্পকার খুঁজে পেয়েছেন প্রকৃতির নির্মলতার মধ্যে প্রিয়তমার প্রতিচ্ছবি। নববিবাহিতা স্ত্রী আদিনা তার প্রথম ঋতু¯্রাবের অসুবিধার দরুন রতিক্রিয়ায় স্বামীকে আদর করতে বারণ করে। স্বামী সেখানে সফল হতে না পেরে শিকারে গিয়ে সমতুল্য এক উত্তেজনা অনুভব করতে চায়। বিল ও পানকৌড়ির বর্ণনায় লেখকের তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ শক্তির পরিচয় পাওয়া যায়। পানকৌড়ির বুক, পুচ্ছ ও পাখনায় যুবকটি তার স্ত্রীর দেহের পেলব কৃষ্ণশোভা ও কমনীয়তা দেখতে পায়। প্রথম গুলিটা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয় কিন্তু যুবকের দ্বিতীয় প্রচেষ্টা পানকৌড়ির পড়ন্ত দেহে রক্তের ছোপ এঁকে দেয়। যেন স্ত্রীর প্রথম রক্তের বাধা পেরিয়ে সেখানে নতুন এক রক্ত সাগরের সম্ভাবনা দেখা দেয়। যেটা নারীর জীবনে একই সাথে পুরনো সত্তার মৃত্যু ও নুতন জীবনের শুরু। প্রতীকী চিত্রে পানকৌড়ি ও আদিনা এক অপরের পরিপূরক।
‘‘কালোনৌকা’’ গল্পটিতে দারিদ্রতা নয়, নি¤œবিত্ত জেলে রাসু জলদাসের মনোবৈকল্য প্রকাশিত হয়েছে তার ছেলের বৌ কালীর প্রতি। অনেকটা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘‘পদ্মানদীর মাঝি’’ উপন্যাসের কুবের ও কপিলার সমাজ বিগর্হিত প্রেমের মতো। তবে এখানে প্রেম নয়, কাম বা যৌনতাই প্রাধান্য পেয়েছে। রাসুর ছেলে দামোদর মারা যায় মাছ মারতে গিয়েÑ সাগরের মধ্যে ঝড়ের কবলে পরে। স্বামীর মৃত্যুতে স্ত্রী কালী শোকে পাথর হয়ে যায়। বাপের বাড়ি থেকে ফিরে এসে সে পাগলামি শুরু করে। বিশেষ করে সে গায়ে কোনো কাপড় রাখতে চায় না; যখন তখন নগ্ন হয়ে পড়ে। কালী ছিল রাসুর স্ত্রী (শাশুড়ির) মতোই সংসারী-গুণী। আর রাসুর ছেলে দামোদর দেখতে ছিল বাপের মতো। পরিশেষে শোকাহত কালী যেন রাসুর মধ্যে তার স্বামী দামোদরকে খুঁজে পায়; আর রাসু পায় কালীর মধ্যে তার স্ত্রী সতীকে। তাই রাসুÑ ‘উন্মত্তের মতো কালীর গলা, বুকে, ঠোঁটের স্পর্শ দিতে দিতে বলল, তুই সতীÑ তোর বুকে আমার সতীর গন্ধ। তুই সতী হয়ে যা কালী।’ এ সমাজ বিগর্হিত প্রেম বা কামকে আল মাহমুদ শিল্পিত করে তুলেছেনÑ কালীকে সতী ও রাসুকে দামোদর প্রতীকে রূপ দিয়ে।
‘‘রোকনের স্বপনদোলা’’ গল্পে শৃঙ্গার রস বা যৌনতা মুখ্য না হলেও এখানে রোকনের চিন্তা বা স্বপ্নের মধ্যে যৌনতার বর্ণনা পাওয়া যায়। রোকনের সাথে বিয়ে হবার কথা ছিল সেকেন্ড মাস্টারের মেয়ের; কিন্তু বিয়ে হয় তার ভাবীর খালাত বোন রোকেয়ার সাথে। ভাগ্যক্রমে তাদের দেখা হয় ট্রেনের মধ্যে। তার স্ত্রী রোকেয়ার সঙ্গে সে গল্পে মশগুল। এক সময় দুজনকেই রোকন নগ্ন দেখেÑ যারা জড়াজড়ি করে শুয়ে আছে। পরিশেষে স্বপ্ন ছুটে গেলে রোকনের কাছেÑ ‘চন্দ্রনাথ পাহাড়কে ধরিত্রীর বিশাল পাথরের স্তনের মতো মনে হলো। তার ফাঁক দিয়ে সূর্যের অর্ধাংশকে মনে হলো অভাবিত উজ্জ্বল ধাতুর লকেট।’ এই প্রতীকী ও শৈল্পিক বর্ণনার মধ্যে সম্ভোগ রস অন্তর্নিহিত আছে। রোকন যাকে এক সময় বিয়ে করতে চেয়েছিল তাকে পাবার জন্যে সে মনোবৈকল্যে ভুগছে। মনের মধ্যে (বা স্বপ্নে) সবকিছু ঘটে যাচ্ছে কিন্তু বাস্তবে সে অনেক দূরে। ফ্রয়েডীয় মনোবৈকল্যই এ গল্পে প্রকট রূপে প্রকাশিত।
আল মাহমুদের ‘জলবেশ্যা› গল্প শুধু সাধারণ নরনারীর যাপিত জীবনের কোন কাহিনী নয় এবং হাটের বর্ণনা বা হাটে আসা নানা শ্রেণীর মানুষের চরিত্র চিত্রনের ব্যর্থ চেষ্টাও নয়। এটি ভাসমান বেদে স¤প্রদায়ের ছলাকলায়পূর্ণ জৈবিক আকর্ষণের শিল্পিত উপস্থাপনা। কবি আল মাহমুদের লেখনিতে উঠে এসেছে দেহবৃক্ষের কামনা-বাসনার তাড়না, সেখানে শ্রেণিচরিত্র অনুযায়ী ভাষার যাদুময় বর্ণনা, উপমা রূপকের ব্যবহার; যা শুধু বাংলাসাহিত্যেই নয়, গল্পটিকে বিশ্বসাহিত্যের একটি অনন্য সম্পদে পরিণত করেছে।
‘জলবেশ্যা’-র প্রস্তুতিপর্ব দীর্ঘ হলেও খুব মুন্সিয়ানার সঙ্গে সমস্ত পরিমÐলটা গড়ে তোলা হয়েছে এবং তা শেষের অভিযানটাকে প্রাসঙ্গিক ও অনিবার্য করে তুলেছে। মিলনের অবস্থানে সাপের ঝুঁড়িতে পা দিয়ে ঝুড়ি ফেলে দিয়ে জলবেশ্যা নির্লিপ্ততার সঙ্গে মিলনকাঙ্ক্ষী পুরুষটার সাপের ছোবল খাওয়া অচৈতন্য দেহকে নিজের হাতে ও কাঁধে তুলে পুরুষটাকে নৌকাতে ফেলে দিল তাতে বস্তুতই মেয়েটার চারিত্রায়নে নতুন এক মাত্রা যুক্ত হলো।
‘জলবেশ্যা’ গল্পটি সম্পর্কে আল মাহমুদ বলেছেন-‘‘ ‘জলবেশ্যা’ আমার বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে জেগে উঠেছে। আমার নিজের অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে আমি যা দেখেছি, তাই উঠে এসেছে গল্পটিতে। জলবেশ্যাদের তো আমি নিজের চোখে দেখেছি, কথা বলেছি। তারপর তাদের নিয়ে লিখেছি।’’
গল্পটিতে তার ব্যক্তিগত আবেগ অনুভূতির কোন প্রকাশ নেই তবে তার যাদুকরি ভাষা ব্যবহারের যে আবেগ তা গল্পটিকে স্বাতন্ত্রতা দিয়েছে। (অসমাপ্ত)
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন