সোমবার, ২০ মে ২০২৪, ০৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১১ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

নজিরবিহীন বর্বরতা

| প্রকাশের সময় : ৮ এপ্রিল, ২০১৯, ১২:০৫ এএম

ফেনীর সোনাগাজী উপজেলার সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদরাসা কেন্দ্রে আলিম পরীক্ষা দিতে যাওয়া ওই মাদরাসারই ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফীকে পুড়িয়ে মারার যে চেষ্টা করা হয়েছে, তাকে চরম বর্বরতা বললেও কম বলা হয়। ঘটনার বিবরণ থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়, অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে লোমহর্ষক ও মর্মান্তিক এই ঘটনাটি ঘটানো হয়েছে। মাদরাসার প্রশাসনিক ভবনের ছাদে তার এক বান্ধবীকে মারধর করা হচ্ছে বলে খবর দেয়া হয় নুসরাতকে। সে ছাদে উঠে দেখতে পায় সেখানে কয়েকজন মুখোশধারী অবস্থান করছে। তারা তাকে অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা নিয়ে তাকে শাসায় এবং মামলা যে মিথ্যা সেটা বলার জন্য দাবি জানায়। এতে সে রাজি না হওয়ায় কেউ তার হাত, কেউ তার পা ধরে গায়ে কেরোসিন জাতীয় দ্রব্য ঢেলে দিয়ে আগুন লাগিয়ে দেয়। মারাত্মক অগ্নিদগ্ধ নুসরাত এখন ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন ইউনিটে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে। একজন চিকিৎসক জানিয়েছেন, তার শরীরের ৭৫ শতাংশ পুড়ে গেছে, যার মধ্যে ৪০-৪৫ শতাংশই গভীর। তার অবস্থা আশংকাজনক। যেখানে শরীরের ১৫ শতাংশ পুড়ে গেলেই জীবন সংশয়ের আশংকা করা হয়, সেখানে নুসরাত যে জীবন-মরণের সন্ধিক্ষণে অবস্থান করছে, সেটা সহজেই বোঝা যায়। আমরা মহান আল্লাহর কাছে তার জীবন ও দ্রæত আরোগ্য লাভের জন্য প্রার্থনা জানাই। 

নুসরাতের ‘অপরাধ’ ওই মাদরাসার অধ্যক্ষ মওলানা সিরাজ উদদৌলার বিরুদ্ধে তাকে শ্লীলতাহানির অভিযোগে দায়ের করা একটি মামলা। গত ১৭ মার্চ অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলা নিজ কক্ষে ডেকে নিয়ে তার শ্লীলতাহানি করেন। এই অভিযোগে তার মা মামলাটি দায়ের করেন। এ মামলায় অধ্যক্ষ এখন কারাগারে। গ্রেফতারের পর শিক্ষার্থীদের একাংশ অধ্যক্ষের মুক্তির দাবিতে মানববন্ধন করে। অন্যদিকে শিক্ষার্থীদের আরেকটি অংশ ও স্থানীয় লোকজন অধ্যক্ষের শাস্তির দাবিতে মানববন্ধন করে। এই প্রেক্ষাপটেই নুসরাতের পুড়িয়ে মারার চেষ্টার ঘটনাটি ঘটেছে। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলা এক সময় জামায়াতের রোকন ছিলেন। ফেনী জেলা জামায়াতের আমির এ তথ্য জানিয়ে বলেছেন, বিভিন্ন অভিযোগে ২০১৬ সালে তাকে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হয়। এছাড়া নাশকতা ও পুলিশের ওপর হামলার অভিযোগে ফেনী ও সোনাগাজী মডেল থানায় তার বিরুদ্ধে তিনটি মামলা রয়েছে। তখন তিনি গ্রেফতার হয়ে কারা ভোগের পর জামিনে মুক্তি পান। ওই খবরেই উল্লেখ করা হয়েছে, নুসরাতকে শ্লীলতাহানির অভিযোগে তার মায়ের দায়ের করা মামলা তুলে নেয়ার জন্য নানা মহল থেকে চাপ সৃষ্টি করা হয়। চাপ সৃষ্টিকারীদের মধ্যে মাদরাসা শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি শাহাদত হোসেনের নাম জানিয়েছে নুসরাতের বড় ভাই। শাহাদত শুক্রবার রাতে নুসরাতের ছোট ভাইকে ফোনে মামলা নিয়ে আগালে মেরে ফেলার হুমকি দেয়। ওদিকে মামলাটি তুলে নেয়ার জন্য মাদরাসা পরিচালনা পর্ষদের সহসভাপতি ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি রুহুল আমিন বিভিন্ন মাধ্যমে মামলা তুলে নেয়ার জন্য নুসরাতের পরিবারের ওপর চাপ সৃষ্টি করেন। মাদরাসার শিক্ষার্থীদের একটি অংশও নিয়মিত হুমকি দিয়ে যাচ্ছিল। এসব কারণেই ঘটনাটিকে সুপরিকল্পিত বলে মনে করছে নুসরাতের পরিবার। অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক, আমাদের দেশে কোনো ঘটনা-দুর্ঘটনা ঘটলেই তার সঙ্গে রাজনীতির সংশ্লিষ্টতা বড় হয়ে ওঠে। সব কিছুকেই রাজনীতিকরণ করা হয়। এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির যে অভিযোগ উঠেছে, তদন্ত ও বিচারের মাধ্যমেই তার সত্য-মিথ্যা নির্ণীত হবে। এক্ষেত্রে মামলা তুলে নেয়ার জন্য চাপ দেয়া শুধু অন্যায় নয়, তা বিচার প্রক্রিয়ার ওপর হস্তক্ষেপের শামিল এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠার প্রয়াসের নামান্তর।
এ কথা কারো অজানা নেই, মাদরাসা শিক্ষা ইসলামী নীতি-নৈতিকতাশাসিত একটি শিক্ষা ব্যবস্থা। শিক্ষার্থী-শিক্ষক সবাইকে এই নীতি-নৈতিকতা মেনে বা অনুসরণ করে চলতে হয়। বলাবাহুল্য, মাদরাসা শিক্ষা তার দীর্ঘ ধারাবাহিক ঐতিহ্যের কারণেই অত্যন্ত জনপ্রিয়। প্রচলিত অন্যান্য শিক্ষায় শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের মধ্যে নীতি-নৈতিকতার বাঁধনটি আর আগের মত দৃঢ়বদ্ধ নেই। মাদরাসা শিক্ষায় সেটি অটুট রয়েছে। মাদরাসায় একই সঙ্গে ধর্মীয়, আধুনিক ও প্রযুক্তি শিক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে। অভিভাবকরা তাদের অভিজ্ঞতা থেকেই অনুধাবন করেন, তাদের ছেলে বা মেয়েকে মাদরাসায় দিলে সে ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষায় যেমন বলীয়ান হতে পারবে, একইসঙ্গে আধুনিক ও প্রযুক্তি শিক্ষাও লাভ করতে পারবে। এই দ্বিবিধ লক্ষ্য অর্জনের জন্যই অভিভাবকদের অনেকে তাদের ছেলে-মেয়েদের মাদরাসায় পাঠাচ্ছেন। মাদরাসায় ছাত্র-ছাত্রীর ক্রমবর্ধমান সংখ্যা বৃদ্ধিই এর সাক্ষ্য বহন করে। মাদরাসা শিক্ষার্থীরা ব্যবহারিক ও কর্মজীবনে সজ্জন, সদাচারী ও দুর্নীতিমুক্ত, এটা প্রমাণিত সত্য। তারা তাদের আচার-ব্যবহার, নৈতিকতা-ধার্মিকতা, কর্তব্যনিষ্ঠা ও দায়িত্বশীলতা দিয়ে এই স্বাক্ষর রেখে যাচ্ছে যে, তারা সব সময় সুনাগরিক। এহেন শিক্ষার ওপর কোনো কারণে বা কারো কারণে কালিমা লেপিত হোক বা তা প্রশ্নবিদ্ধ হোক, এটা কোনোভাবেই বরদাশত করা যায় না। অবশ্যই মাদরাসার শিক্ষক, শিক্ষার্থী, পরিচালনা পর্ষদ সবাইকে মাদ্রাসা শিক্ষার ভাবমর্যাদা ও ঐতিহ্যের বিষয়টি স্মরণ রাখতে হবে। প্রত্যেককেই সতর্ক ও দায়িত্বশীল হতে হবে। মাদরাসা শিক্ষার মর্যাদা ও সুনাম ধরে রাখার দায়িত্ব সমাজ এবং রাষ্ট্রেরও। সমাজ ও রাষ্ট্রকে এদিকে যথাযথ দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে হবে। সোনাগাজীতে যা ঘটেছে, তার নিন্দা জানানোর ভাষা আমাদের নেই। আমরা নুসরাতের পুড়িয়ে মারার চেষ্টার সঙ্গে যারাই জড়িত, তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই। এ ব্যাপারে জিরো টলারেন্স দেখাতে হবে সরকারকে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন