মুফতী শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী
‘লা মাযহাবী’ ‘আহলে হাদিস’ নয় :
‘লা মাযহাবী’গণ নিজেদেরকে কখনো ‘আহলে হাদিস’ বলে দাবি করেন। প্রকৃতপক্ষে ‘আহলে হাদিস’ অর্থ হলো ইলমে হাদিস বা হাদিস শাস্ত্রবেত্তা ও হাদিস শাস্ত্রের বিশেষজ্ঞ তথা হাদিসবিশারদ। তারা যেহেতু সবাই হাদিসবিশারদ নন; তাই তাদের ‘আহলে হাদিস’ দাবি যথার্থ নয়; বরং তা অজ্ঞতাপ্রসূত ও বিভ্রান্তিমূলক।
‘গায়রে মুকাল্লিদ’ ‘সালাফী’ নয় :
‘গায়রে মুকাল্লিদ’গণ কখনো নিজেদেরকে ‘সালাফী’ বলে দাবি করেন; সালাফ অর্থ হলো সালাফ বা পূর্বসূরিদের অনুসারী। ‘সালাফ’ হলেনÑ সাহাবায়ে কিরাম, তাবিয়ীন ও তাবে তাবিয়ীন তথা খয়রুল কুরূন, একত্রে এদেরকে ‘সালফে সালিহীন’ বলা হয়। যাদের মুতাকাদ্দিমীনও বলা হয়। ‘সালাফ’-এর বিপরীত হলো ‘খালাফ’ অর্থাৎ উত্তরসূরি, যাঁদেরকে মুতাকাদ্দিমীনও বলা হয়। ‘সালাফ’-এর বিপরীত হলো ‘খালাফ’ অর্থাৎ উত্তরসূরি, যাদের মুতাআখখিরীন বলা হয়। ইমাম আযম আবু হানিফা (র.) বিশিষ্ট তাবিয়ী ছিলেন, চার মাযহাবের ইমামগণ ‘সালাফ’ ছিলেন; সুতরাং মাযহাব অনুসারীগণই প্রকৃত সালাফী। ‘গায়রে মুকাল্লিদ’গণ যেহেতু সালাফগণের অনুসরণ করেন না, তাই তাদের সালাফী দাবি করা সঠিক নয়; বরং তারা যেহেতু খালাফগণের অনুসরণ করেন, তাই তাদেরকে ‘খালাফী’ বলাই ব্যাকরণসম্মত, বাস্তবসম্মত ও বিশুদ্ধ। তারপরও যদি তারা তা মানতে রাজি না হন, তবে তারা হবেন ‘খেলাফী’ মানে খেলাফকারী; কারণ তারা ব্যাকরণও মানছেন না। আল্লাহ আমাদের বিভ্রান্তি থেকে রক্ষা করুন।
আল্লাহতায়ালা মানুষের হেদায়াতের জন্য নবী রাসূল (আ.)-গণকে পাঠিয়েছেন এবং তাঁদের প্রতি ওহী তথা কিতাব নাজিল করেছেন। ওহীর দুটি অংশ, ওহী মাতলু তথা কোরআন, ওহী গায়রে মাতলু অর্থাৎ হাদিস। দীনের ওপর চলতে আমাদের এই দুইয়ের অনুসরণ করতে হবে। আল্লাহতায়ালা বলেন : “রাসূল (সা.) তোমাদের যা দিয়েছেন, তা তোমরা ধারণ কর এবং যা তিনি বারণ করেছেন, তা হতে তোমরা বিরত থাক”। (সূরা-৫৯ হাশর, আয়াত ৭, পারা : ২৮)। নবী করীম (সা.) বলেন : ‘আমি তোমাদের মাঝে দুটি জিনিস রেখে গেলাম, যতক্ষণ তোমরা এতদুভয়কে দৃঢ়ভাবে ধরে রাখবে, ততক্ষণ তোমরা পথভ্রষ্ট হবে না; তা হলো আল্লাহর কিতাব ও আমার সুন্নাহ’। (বুখারি)।
মানব সৃষ্টির ক্ষেত্রে আল্লাহর উদ্দেশ্য ৩টি হলো : (ক) ইবাদত, (খ) খিলাফত ও (গ) আল্লাহর বিধানকে সকল বিধানের ঊর্ধ্বে প্রতিষ্ঠা করা। শরিয়তের উদ্দেশ্য হলো আল্লাহর উদ্দেশ্য সাধনের লক্ষ্যে এ ৫টি বিষয় রক্ষা করা। যথা : (১) হিফযে জান/জীবন রক্ষা (২) হিফযে মাল/সম্পদ রক্ষা। (৩) হিফযে নসল/বংশ রক্ষা। (৪) হিফযে আকল/জ্ঞান রক্ষা। (৫) হিফযে দীন/ধর্ম রক্ষা।
ফিকহের উদ্দেশ্য হলো : শরিয়তের উদ্দেশ্য সাধনের জন্য আল্লাহর উদ্দেশ্য ও শরিয়তের লক্ষ্যের আলোকে ইসলামের বিধিবিধান সাধারণের বোধগম্য উপায়ে উপস্থাপন করা। শরিয়ত ও ফিকহের মধ্যে সূক্ষ্মতম পার্থক্য বিদ্যমান। মূলত শরিয়ত হলো, কোরআন সুন্নাহ প্রসূত মূলনীতি বা আহকাম; শরিয়তের উৎস হলো- (ক) কোরআন ও (খ) সুন্নাহ। ফিকহ হলো শরিয়তের মূলনীতির আলোকে ইজতিহাদ ও ইস্তিম্বাতকৃত মাসায়িল। ফিকহের উৎস হলোÑ (১) কোরআন, (২) সুন্নাহ, (৩) ইজমা ও (৪) কিয়াস।
মুজতাহিদগণের ইজতিহাদের ভিত্তি হলো : (১) মানশায়ে ইলাহিয়্যাহ বা আল্লাহর উদ্দেশ্য, (২) মাকাসিদে শরিয়াহ বা শরিয়তের লক্ষ্য, (৩) ইসলাহে উম্মাহ বা উম্মাতের কল্যাণ চিন্তা ও (৪) ফাকাহাহ বা প্রজ্ঞা। মুজতাহিদ কর্তৃক প্রদত্ত সিদ্ধান্ত হলো ফিকাহ বা মাছআলাহ। ফাতওয়া হলো : সময় ও অবস্থা বিবেচনায় বিশেষজ্ঞ ফকীহ কর্তৃক প্রদত্ত মতামত। উপযুক্ত আদালত কর্তৃক প্রদত্ত রায় বা ফয়সালা হলো কাযা। ফিকহী বিষয়ে ইখতিলাফের বিশেষ কারণসমূহ হলো : (১) দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতা, (২) অগ্রাধিকারের ভিন্নতা ও (৩) মূলনীতির ভিন্নতা।
সহজ কথা হলো, দীনের ওপর চলার জন্য কোরআন সুন্নাহর অনুসরণ করতে হবে। আর এর জন্য হয়তো নিজে বুঝতে হবে, নয়তো যিনি বুঝেন তাকে অনুসরণ করতে হবে। কোরআন ও সুন্নাহ বুঝতে গিয়ে মুজতাহিদ ফকীহগণের মাঝে ইখতিলাফ বা মতভিন্নতা দেখা যায়। যার প্রধান কারণগুলো হলো : (১) একই শব্দের একাধিক অর্থ থাকা এবং একই বাক্যের বিভিন্নভাব ধারণ সম্ভাবনা। (২) হাদিস সহিহ হওয়ার শর্তের বিভিন্নতা। (৩) হাদিসের মর্ম অনুধাবনে বিভিন্নতা। (৪) একই বিষয়ে হাদিসের বিভিন্নতা। (৫) নাসেখ মানসুখ সম্পর্কে বিভিন্ন মত থাকা।
ফিকহী মাসায়িলে ইখতিলাফ থাকাটা একেবারেই স্বাভাবিক এটি মোটেই দোষণীয় নয়। কিন্তু বর্তমান জমানায় কিছু ‘লা মাযহাবী গায়রে মুকাল্লিদ’ লোকজন ফিকহী মতভিন্নতাকে চরম বিভেদে রূপান্তরিত করার প্রয়াস চালাচ্ছে। তারা উদ্ভট দাবি করছেÑ কালেমা এক, রাসূল এক, কোরআন এক, হাদিস এক, সুতরাং সব মাসআলাহ মাসায়িল একই হতে হবে। তারা আরো অবান্তর কথা বলছে যে, মাযহাবের কারণে মতভিন্নতা, বিভেদ ও বিরোধ হচ্ছে। আমরা তাদের অলিক দাবির অসারতা প্রমাণের জন্য তথাকথিত আহলে হাদিস নামধারী সালাফী দাবিদার আলেমগণের নিজেদের মধ্যেও যে ফিকহী ইখতিলাফ মতভেদ, মতপার্থক্য ও ভিন্ন মত রয়েছে তার কিছু নমুনা মাত্র আলোকপাত করছি।
আমরা অনেকেই অনেক সময় আরব মুহাক্কিকগণের মতামতকে অত্যধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকি। বিশিষ্ট আরব আলেম সায়্যিদ সাবিক তার ‘ফিকহুস সুন্নাহ’ নামে ৩ খ-ের বিশাল গ্রন্থে বলেছেনÑ ‘মাযহাব মানা এবং যঈফ হাদিস গ্রহণ করা ও না জানার কারণে মুসলিম উম্মাহর মাঝে ইবাদতের বিরোধ তৈরি হয়েছে’। কিন্তু উনারই অনুসারী বিশিষ্ট মুহাদ্দিস নাসিরুদ্দীন আলবানী সায়্যিদ সাবিক রচিত গ্রন্থ (ফিকহুস সুন্নাহ)-এর জওয়াবে ‘তামামুল মিন্নাহ ফীত তালীকি আলা ফিকহিস সুন্নাহ’ নামে ৪ খ-ের সুবিশাল কিতাব লিখে তার সংশোধনী দিয়েছেন। এতে তিনি তার বিভ্রান্তিগুলো স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন। এ গ্রন্থের ১৪ পৃষ্ঠাব্যাপী সুদীর্ঘ ভূমিকায় তিনি লিখেছেন : ‘উস্তাদ সায়্যিদ সাবিক (র.) তার ‘ফিকহুস সুন্নাহ’ কিতাবে ১৪ প্রকার ভুলের শিকার হয়েছেন বা ১৪ ধরনের ভুল করেছেন। (নাসিরুদ্দীন আলবানীর ভাষায়) : “এই অধ্যয়ন গবেষণা এমন ভ্রান্তিসমূহের বিষয়ে যার একটি হতে আরেকটি বেশি জটিল, কুটিল ও গুরুত্বপূর্ণ। তাতে এমন এমন ত্রুটি রয়েছে যার বাস্তবতা আমি কল্পনাও করতে পারি না। এ জন্যই আমি তা বর্ণনা করা জরুরি মনে করছি। আল্লাহ আমাকে সে তাওফিক দিয়েছেন এবং সকল প্রশংসা তাঁর জন্য, দয়া তাঁরই। আশা করি এর দ্বারা এই বিচ্যুতিসমূহের প্রতি সামগ্রিকরূপে ইঙ্গিতের ফল লাভ হবে। যাতে পাঠক এর থেকে সাধারণ ধারণা নিতে পারেন; তাতে করে এই সংযোজনীর গুরুত্ব প্রকাশ পাবে। তাই আমি বলিÑ এই বিভ্রমগুলো মোটামুটি সমাগতভাবে সীমাবদ্ধ করা যায়।”
১. ‘বহু হাদিস সঙ্কলক সে বিষয়ে নীরব, অথচ তা যঈফ।’
২. ‘অন্য বহু হাদিস যা তিনি কভি, শক্তিশালী বলেছেন, অথচ তা তাহকীকে ওয়াহিয়াহ (বাতিল)।’
৩. ‘বহু হাদিস যা তিনি যঈফ বলেছেন, অথচ তা সহিহ অথবা উহার অন্য বহু সহিহ সনদ রয়েছে।’
৪. ‘বহু হাদিস যা তিনি সহীহাঈন-এর বাইরে উল্লেখ করেছেন, অথচ তা সহীহাঈনে বা এতদুভয়ের কোনো একটিতে রয়েছে।’
৫. ‘বহু হাদিস যা তিন সহীহাঈনের একটিতে বা অন্য গ্রন্থে আছে উল্লেখ করেছেন, অথচ এ উভয় কিতাবে তার কোনো অস্তিত্বই নেই।’
৬. ‘বহু হাদিস যা তিনি পেশ করেছেন, অথচ তার অস্তিত্ব হাদিসের কোনো কিতাবেই নেই।’
৭. ‘তিনি কোনো হাদিসকে একজন সাহাবি থেকে এক দল মুহাদ্দিস বর্ণনা করে বলেছেন, অথচ তা তাদের অনেকে অন্য সাহাবি বা বহু সাহাবি থেকে বর্ণনা করেছেন।’
৮. ‘এমন হাদিস যার বর্ণনাকারীর বিষয়ে তিনি নীরবতা পালন করেছেন, বাস্তবে তার বর্ণনাকারী এমন যে, তার বিশুদ্ধতা প্রশ্নবিদ্ধ।’
৯. ‘তিনি বহু মাসআলার দলিল পেশ করেননি, তাতে অনেক মাসআলা দালিলিক ভিত্তি ছাড়াই এসেছে যাতে ‘কিয়াস’-এর দ্বারস্থ হতে হয়; যদিও সে বিষয়ে সহিহ হাদিস রয়েছে। আর কখনো তিনি ‘আম’ সাধারণ দলিল পেশ করেছেন, যদিও তার ‘খাছ’ বিশেষ দলিল রয়েছে।’
১০. ‘তিনি ফছল বা নির্দিষ্ট বিষয়ের মাসায়েলসমূহের পূর্ণ বিবরণ বা সামগ্রিকতা প্রদান করেননি; যেমনÑ সুস্তাহাব গোসল ও অনুরূপ বিষয়।’
১১. ‘তিনি একই মাসআলায় বিপরীতমুখী বিভিন্ন উক্তির সমাহার করেছেন, উহার এক মতকে অন্য মতের ওপর তারজীহ বা প্রাধান্য দেওয়া ব্যতিরেকে।’
১২. ‘কোনো কোনো মাসআলায় তার মতের ইযতিরাব বা দোদুল্যমানতা বিদ্যমান; একই স্থানে তিনি বিষয়ের সূচনাতে এমন বিষয় বলেছেন যা তার শেষাংশে নকজ বা বাতিল হয়েছে।’
১৩. ‘তিনি এমন বক্তব্য সকল ও এমন বিপরীতমুখী মতামতসমূহকে তারজীহ দিয়েছেন, যা তারজীহর উপযুক্ত নয়; তার দলিলের দুর্বলতা ও বিপক্ষ দলিলের সবলতার কারণে।’ (চলবে)
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন