(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
উপরের আয়াতসমূহের প্রতি গভীরভাবে তাকালে একটি সমুজ্জ্বল দিক নির্দেশনা অবশ্যই লাভ করা যায়। তা’হলো দু’ ওয়াক্তের নামাজ একত্র করা। প্রথম আয়াতগুলোতে যোহর এবং আসরের নামাজ সম্মিলিতভাবে আছে। অর্থাৎ উভয়টিকে একই শব্দ দ্বারা কাবলাল গুরুব অথবা আছীল অথবা তারফাইন্নাহার শব্দ দ্বারা বর্ণনা করা হয়েছে। আখেরী আয়াতে, যা সূরা রূমে আছে, যোহর এবং আসর নামাজের নাম স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু সন্ধ্যার নামাজকে ইজমালীভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। অর্থাৎ মাগরিব ও এশা উভয় ওয়াক্তকে যখন রাতে উপনীত হও শব্দ দ্বারা তুলে ধরা হয়েছে। এর দ্বারা একটি সূ² দিক নির্দেশনা লাভ করা যায় যে, এর দ্বারা উভয়টিকেই এক অথবা পৃথক পৃথক ও বুঝায়। এ কারণে কোনও একান্ত প্রয়োজনের সময় এবং সফরের অশান্তির সময় যোহর ও আসরকে এক সাথে এবং মাগরিব ও এশাকে এক সাথে মিলিয়েও আদায় করা যায়।
এক্ষেত্রে লক্ষ্যণীয় ব্যাপার হচ্ছে, মুয়াত্তা, ইমাম মালেক, সহীহ মুসলিম, জামে তিরজিমীর “মুকীম এবং মুসাফির অবস্থায় দু’নামাজকে একত্র করা” অধ্যায়ে বর্ণিত হাদীস দৃষ্টে কতিপয় প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের পন্ডিত ব্যক্তি সন্দেহে নিপতিত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সা:)-এর আমলে হয়ত তিন ওয়াক্তের নামাজই আদায় করা হত। ইসলামী বিশ্বকোষের প্রবন্ধকার ওয়েসিষ্কও এমনই সন্দেহে নিপতিত হয়েছিল। কিন্তুু মূল অবস্থা তা’ নয়। বরং নামাজ পাঁচ ওয়াক্তই আদায় করা হত। বরং আপতকালে যোহর এবং আসরকে এক সাথে এবং মাগরিব ও এশাকে এক সাথে আদায় করা হত। এছাড়া নামাজের রাকায়াতগুলো ঠিকই থাকত। শুধু কেবল ওয়াক্তকে কমানো হত।
ফুকাহাদের মাঝে এ ব্যাপারে এখতেলাফ আছে। দু’ওয়াক্তের নামাজকে এক সাথে আদায় করা যায় কিনা? আহনাফদের অভিমত এই যে, সত্যিকার অর্থে শুধু একস্থানে হজ্জের মওসুমে আরাফাত ময়দানে নবম যিলহজ্জ তারিখে যোহর এবং আসর নামাজকে একসাথে যোহরের সময় আদায় করা যায়। কেননা সেদিন আসরের সময়টি হজ্জের দোয়া ও মোনাজাতের সময়। তাছাড়া মুযদালেফায় মাগরিব এবং এশা একসাথে এশার সময়ে আদায় করা যায়। এছাড়া অন্যান্য সময় দু’ওয়াক্তের নামাজকে একসাথে আদায় করার নিয়ম হানাফী মাযহাবে নেই। কখনো কখনো এক ওয়াক্তের নামাজকে শেষ ওয়াক্তে এবং অপর ওয়াক্তের নামাজকে প্রথম ওয়াক্তে আদায় করা যায়। বাহ্যত: উভয় ওয়াক্তের নামাজ একসাথে মনে হলেও পৃথক ওয়াক্তই বটে। হানাফী মাযহাব ছাড়া অন্যান্য ফুকাহাদের নিকট মূলত: দু’ওয়াক্তের নামাজ একসাথে এক ওয়াক্তে পাঠ করা যায়। এবং রাসূলুল্লাহ (সা:) এমন আমলও করেছেন। কিন্তুু শিয়াদের মাঝে দু’ওয়াক্তের নামাজকে একসাথে পাঠ করার সাধারণ নিয়ম চালু আছে। এখানে স্মর্তব্য যে, ফজরের নামাজ যেহেতু প্রত্যেক আয়াতে সর্বদা পৃথকভাবে উল্লেখ করা হয়েছে এজন্য একে অন্য নামাজের সাথে মিলানো যায়েজ নয়। আহাদীসে দু’ নামাজ একত্র করার শিরোনামে রাসূলুল্লাহ (সা:)-এর আমলী উদাহরণসমূহ কুরআনুল কারীমের এই দৃষ্টিকোণকে তুলে ধরেছে।
পাঞ্জেগানা ওয়াক্ত ও আয়াতে আসরা :
মুহাদ্দেসীন ও ঐতিহাসিকদের ঐকমত্যে পাঞ্জেগানা নামাজের ওয়াক্তের নির্দিষ্টকরণ হয় মিরাজে। যা আমাদের তাহকীক মত নবুওত লাভের দ্বাদশ বর্ষে এবং হিজরতের একবছর পূর্বে সংঘটিত হয়েছিল। যদিও পাঞ্জেগানা ওয়াক্তগুলোর উল্লেখ সূরা ক্কাফ এবং সূরা রূমে আছে যা এর পূর্বেই নাজিল হয়েছিল। কিন্তু তবু একামাতে সালাতের নির্দেশের সাথে সর্বপ্রথম এই সূরায়ে আসরার (মিরাজ) মাঝেই নামাজে পাঞ্জেগানার হুকুম হয়। এতে প্রমাণিত হয় যে, নামাজে পাঞ্জেগানার পরিপূর্ণতা নামাজের আকারে এই মিরাজেই হয়। যেমন অজুর আমল পূর্বেই ছিল কিন্তু এর হুকুম কুরআনের মাদানী সূরাগুলোর মাঝে নাজিল হয়। সূরা আসরা (মিরাজ)-এর ঐ আয়াত যার মাঝে নামাজে পাঞ্জেগানার উল্লেখ আছে, তাহলো এই, “সূর্যের ঢলে পড়ার সময়, রাতের অন্ধকার পর্যন্ত নামাজ কায়েম কর এবং ফজরের পাঠ কায়েম কর, অবশ্যই ফজরের পাঠে মনোনিবেশ পাওয়া যায়। (সূরা আসরা : রুকু-৯) এই আয়াতে কারীমা পাঞ্জেগানা ওয়াক্তসমূহের নির্দিষ্টকরণ এবং এর কারণকে পূর্ণরূপে বর্ণনা করা এর মাঝে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিশ্লেষণের উপযুক্ত শব্দ হচ্ছে দুলুক। দুলুকের মূল অর্থ হচ্ছে, ঝুঁকা, অবনত হওয়া। কিন্তু এখানে লক্ষণীয় ব্যাপার হচ্ছে সূর্য ঢলে পড়ার অর্থ কি? আরবী ভাষীরা একে কোন অর্থে ব্যবহার করে? হাকীকত হচ্ছে এই যে, আরবী ভাষায় দুলুক শব্দটির ব্যবহার তিনটি সময় অথবা সূর্যের তিনটি অবস্থার উপর হয়। (১) সূর্য ঢলে পড়া (২) বরাবর দৃষ্টি সীমা হতে সূর্য নীচে চলে যাওয়া, (৩) এবং সূর্য অস্ত যাওয়া।
উল্লিখিত আয়াতে যখন একথা বলা হয়েছে যে, সূর্য ঢলে পড়ার পর নামাজ কায়েম কর, তখন এই তিনটি দুলুক অর্থাৎ সূর্যের ঢলে পড়ার তিনটি সময়ের মাঝে এক এক নামাজ অপরিহার্য হয়। মোটকথা সূর্য মাথার উপর উঠার পর যখন সূর্য ঢলতে থাকে, তখন এই তিনটি দুলুক সংঘটিত হয়। একটি ঠিক মাতার উপর হতে, দ্বিতীয়টি চোখের দৃষ্টির বরাবর অবস্থা হতে, এবং তৃতীয়টি দিকচক্রবালের অন্তরাল হতে। প্রথমটি যোহরের সময়, দ্বিতীয়টি আসরের এবং তৃতীয়টি মাগরিবের এবং এই প্রত্যেক দুলুক অর্ধাৎ ঢলে পড়ার ওপর ভ্রান্তউপাস্যের অপনোদন এবং সত্য স্রষ্টা আল্লাহ প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। এবং এই স্বীকৃতি ও ঘোষণার জন্য এক এক নামাজ রাখা হয়েছে। এভাবে দুলুক শব্দের মাঝে তিন ওয়াক্তের নামাজের সময় নির্দেশ করা হয়েছে। চতুর্থ নামাজের সময় হচ্ছে রাতের অন্ধকার (গাছাকুল লাইল)। এটা এশার নামাজের সময়। মূলত : এ নামাজ অর্ধরাতে আদায় হওয়া চাই। যখন সূর্যের উজ্জ্বল চেহারা অন্ধকারের পর্দার অন্তরালে হারিয়ে যায় কিন্তুু মানুষের কষ্টের কথা খেয়াল করে তা’ শয়নের পূর্বে রাখা হয় যেন স্বপ্নের অচেতনতার পরিপূরণ হয়ে যায়। আর পঞ্চম নামাজের ওয়াক্ত হচ্ছে ফজরের পাঠ (কুরআনাল ফাজরি)। এটা সূর্যোদয়ের পূর্বে আদায় করা হয। এর পরই সূর্য উদিত হয়ে তার উপাসনাকারীদের আকৃষ্ট করে এরজন্য প্রয়োজন তার উদয় হওয়ার পূর্বেই মহান স্রষ্টার নাম লওয়া এবং ভ্রান্ত পূজারী সূর্য উপাসকদের প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন করা। মোটকথা এই আয়াতে পাকের দ্বারা নামাজ কায়েম করার পাঞ্জেগানা ওয়াক্তের প্রমাণ পাওয়া যায়। এখন আমাদের স্মরণ রাখতে হবে যে, আরবী ভাষায় সূর্যের এই তিনটি অবস্থার উপর দুলুকের ব্যবহার হয়। যদি প্রমাণিত হয় যে, এই আয়াতের দ্বারা তা নিষ্পন্ন হয়, তাহলে পাঞ্জেগানা ওয়াক্তকে স্বীকার করে নিতে কাহারো ওজর থাকবে না।
দুলুকের তাহকীক
মুফাসসেরীনদের মাঝে কেউ দুলুকের দ্বারা সূর্য ঢলে পড়ার সময় এবং কেউ অস্ত যাওয়ার সময়কে গ্রহণ করেছেন। আর অভিধানকারগণও এই দুটো অর্থই তুলে ধরেছেন। তাছাড়া অপর একটি তৃতীয় অর্থও বর্ণনা করেছেন অর্থাৎ বরাবর দৃষ্টি হতে নীচে নেমে যাওয়া। এর সপক্ষে অন্ধকার যুগের কবির একটি কবিতাও উপস্থাপন করেছেন। আর লিসানুল আরব গ্রন্থে আছে। (১) সূর্যের দুলুক হয়েছে অর্থাৎ তা’ ডুবে গেছে। এবং একথাও বলা হয়েছে যে, (২) সূর্য লাল হয়ে গেছে এবং তা’ অস্ত যাওয়ার জন্য ঝুঁকে পড়েছে। কুরআনুল কারীমে আছে, সূর্য ঢলে পড়ার সময় হতে রাতের অন্ধকার পর্যন্ত নামাজ কায়েম কর। (৩) আর সূর্য ঢলে পড়েছে অর্থাৎ তা’ আকাশ মন্ডল হতে লুক্কায়িত হয়ে গেছে। আর ফাররা বলেছেন, ইবনে আব্বাস (রা:) হতে বর্ণিত আছে, দুলুকে শামস-এর অর্থ যোহরের সময় সূর্যের ঢলে পড়া। এবং আমি বর্ণনা করেছি যে, আমি আরবদেরকে দুলুক দ্বারা সূর্যাস্তকে বুঝাতে দেখেছি। জনৈক কবি বলেন, “এটা ঐ জায়গা যেখানে রাবাহের উভয় পা থেমে গিয়েছিল। সে শত্রæদের থেকে স্বীয় সম্মানকে অক্ষুন্ন রেখেছিল। এমনকি সূর্য হাতের তালু হতে ঢলে পড়েছিল।” আবু মানসুর বলেছেন, আমি ইবনে মাসউদ (রা:) হতে বর্ণনা করেছি যে, দুলুকে শামস হচ্ছে সূর্যের অস্ত যাওয়া। এবং ইবনে হানী আখদাশ হতে বর্ণনা করেছে যে, দুলুকে শামস হচ্ছে সূর্য ঢলে পড়া হতে অস্ত যাওয়া পর্যন্ত সময়। এবং আজ্জাজ বলেছে, দুলুক হচ্ছে যোহরের সময় সূর্য ঢলে পড়া। এবং এর অর্থ অস্ত যাওয়ার জন্য ঢলে পড়াও। এটাও সূর্যের দুলুক। প্রবাদ বাক্যে বলা হয়, “সূর্য ঢলে পড়ার জন্য ঝুঁকে পড়েছে। এমনকি লক্ষ্যকারী যখন এটাকে দেখতে চায়, তখন এর জ্যোতির তেজকে কমানোর জন্য হাতের তালুকে চোখের উপর রাখতে হয়। তবে যদি বলা হয় যে, আরবী প্রবাদে দুলুকের অর্থ কি? তাহলে উত্তর দেয়া হবে যে, দুলুকের অর্থ হচ্ছে সূর্য ঢলে পড়া। এ জন্য সূর্যকে দালেকাহ বলা হয়। যখন তা’ দ্বিপ্রহরে ঢলে পড়ে এবং যখন সূর্য ডুবে যায়, তখনো একে দালেকাহ বলা হয়। কেননা, এই দুটি সময়েও তা’ ঢলে পড়ে। ফাররা বলেছেন, “কবির কবিতায় যে বা’রাহ শব্দটি আছে, তা রাহ শব্দের বহুবচন। যার অর্থ হাতের তালু। কথকের উদ্দেশ্য হচ্ছে এই যে, উভয় চোখের উপর হাতের তালু রেখে দৃষ্টিপাত করা। যদিও সূর্য তখনো অস্ত যাক চাই না যাক। আরবী কবিরা সূর্য ঢলে পড়ে চোখের সামনে এসে গেলে চোখের উপর হাতের তালু রেখে দেখার উল্লেখ অধিকাংশ ক্ষেত্রে করেছেন।
আজ্জাজ বলেছেন, সূর্য রুগ্ন হয়ে সরু হয়ে যাওয়ার নিকটবর্তী ছিল। আমি এসে হাতের তালু দ্বারা হটাতে ছিলাম, যেন তা’ হটে যায়। এই দ্বিতীয় কবিতাটি দ্বারা প্রথম কবিতার মর্ম আরও সুস্পষ্ট হয়ে যায়। সূর্য ঢলে পড়ে যখন চোখের বরাবর হয়ে যায়, তখন তা’ আসরের সময়।
মোটকথা, সূর্য মধ্য গগন হতে ঢলে পড়লে যোহর, তারপর নজর বরাবর হলে আসর এবং অস্ত গেলে মাগরিব হয়। এই তিনটি দুলুকই সূর্যের তিনটি অবস্থাকে ফুটিয়ে তোলে। এসকল বিস্তৃত আলোচনার মর্ম হলো এই আয়াতটি :
অর্থাৎ-সূর্য ঢলে পড়ার সময় নামাজ কায়েম কর। এর দ্বারা তিন ওয়াক্তের নামাজই বুঝায়। (১) যোহর: যখন সূর্য মাথার উপর হতে ঢলে পড়ে। (২) আসর : যখন সূর্য চোখের দৃষ্টি বরাবর এসে যায় এবং (৩) মাগরিব : যখন সূর্য অস্তমিত হয় এবং (৪) এরপর আসে এশা (গাছাকুল লাইল) এবং সর্বশেষে আসে (৫) ফযর: (কুরআনাল ফাজরি) এই আয়াতে পাক দ্বারা পাঞ্জেগানা ওয়াক্তের পরিচয় লাভ করা যায়।
নামাজের সময়ে একটি রহস্য :
এই আয়াতটি আবারো পাঠ করুন। তাহলে বুঝা যাবে নামাযের সময়ে ক্রম শুরু হয় যোহর হতে। কেননা, ঐ সময়ে সূর্য ঠিক মাথার উপর হতে ক্রমশ: ঢলতে আরম্ভ করে এবং তা’ঐ হাদীস দ্বারাও সমর্থিত যা ‘হাদীসে জিব্রীলে’ নামাজে পাঞ্জেগানার সময় নির্ধারণ সম্পর্কে আছে। (সীরাতে ইবনে হিশাম : ফরযিয়াতে সালাতের প্রারম্ভ অধ্যায়)
এখানে স্মর্তব্য যে বিভিন্ন তফসীর গ্রন্থে সাহাবীদের বর্ণনাবলীর মাঝেও ঐ সকল পাঞ্জেগানা নামাজের সময় সংক্রান্ত বর্ণনা পাওয়া যায়। হযরত ইবনে মাসউদ (রা:)-এর মতে দুলুক হচ্ছে, সূর্য অস্ত যাওয়া এবং হযরত ইবনে আব্বাস (রা:)-এর মতে, দুলুক হলো সূর্য পশ্চিমাকাশে ঢলে পড়া। অনুরূপভাবে গাসাকিল্লাইল বলতে কেউ মাগরিব এবং এশা বলে থাকেন এবং তারা এই সিদ্ধান্ত প্রদান করেছেন যে, দুলুকিস শামস হলো যোহর এবং আসর, গাসাকিল্লাইল হলো মাগরিব এবং এশা এবং কুরআনুল ফাযর হচ্ছে ফযর।
ক্রমানুসারে প্রথমে আসে যোহরের ওয়াক্ত। তারপর আসর, তারপর মাগরিব এবং তারপর নিদ্রা যাওয়ার পূর্বে এশা। যোহর হতে এশা পর্যন্ত নামাজের ওয়াক্তে অন্যূন দু’তিন ঘণ্টার ব্যবধান হয়ে থাকে। তারপর ফযরের নামাজ। এশার নামাজ হতে তা’ সাত আট ঘণ্টার ব্যবধানে অনুষ্ঠিত হয়। অনুরূপভাবে ফযর হতে যোহর পর্যন্তও সাত আট ঘণ্টার ব্যবধান হয়। সুতরাং উপরোক্ত আয়াতে যোহর হতে এশা পর্যন্ত একসাথে ক্রমান্বয়ে নামাজ আদায়ের হুকুম এসেছে। তারপর কয়েক ঘণ্টা বিরতির পর ফজরের নামাজের সময় হয়। তারপর দীর্ঘ বিরতির পর যোহরের ওয়াক্ত ফিরে আসে। মোটকথা, যোহর হতে আসর, আসর হতে মাগরিব এবং মাগরিব হতে এশা পর্যন্ত ক্রমাগত নামাজের ওয়াক্ত আসে। তারপর ফযর পর্যন্ত দীর্ঘ শ্রান্তি দূর করার অবকাশ থাকে। তারপর প্রত্যুষে উঠে আল্লাহর স্মরণের সময় আরম্ভ হয়। এরপর মানবিক কায়কারবারের জন্য দীর্ঘ বিরতি রাখা হয়েছে। যা ফযর হতে যোহর পর্যন্ত দীর্ঘ। এ সময়ে কোন ফরজ নামাজও নেই।
পাঞ্জেগানা ওয়াক্তের অপর একটি আয়াত :
সূরা আসরা-এর অনুরূপ সূরা ত্বাহাতেও একটি আয়াত রয়েছে। যাতে পাঞ্জেগানা ওয়াক্তের বিস্তৃত বিবরণ বিধৃত আছে। এরশাদ হচ্ছে, “স্বীয় প্রতিপালকের প্রশংসাসুলভ পবিত্রতা বর্ণনা কর, সূর্য উদয়ের পূর্বে, সূর্য অস্ত যাওয়ার আগে এবং রাতের কিয়দংশে তাসবীহ পাঠ কর এবং দিনের প্রান্ত সীমায়। (১) সূর্যোদয়ের পূর্বে হলো ফযর, (২) অস্ত যাওয়ার আগে হচ্ছে আসর, (৩) রাতের কিয়দংশ দ্বারা এশা বুঝায় এবং দিনের প্রান্ত সীমায় (৪) যোহর এবং (৫) আসর।
আতরাফুন্নাহারের তাহকীক :
কেউ যদি শাব্দিক দিক বিবেচনা করে এই প্রশ্ন করে যে, আতরাফ শব্দটি তরফ শব্দের বহু বচন। যার অর্থ কিনারা বা প্রান্তসীমা বহু বচন কম পক্ষে তিন-এর সাথে সংশ্লিষ্ট। কারণে দিনের তিনটি কিনারা বা প্রান্তসীমা পাওয়া দরকার। অথচ দিনের কিনারা হচ্ছে, দুটি। সকাল এবং সন্ধ্যা। এখন কথা হলো, যদি মধ্যবর্তী প্রান্তকেও ধরা হয়, অর্থাৎ সকাল, দ্বিপ্রর এবং সন্ধ্যা, তাহলে ফযরের উল্লেখ বার বার হয়ে যায়। অর্থাৎ সকাল ও দ্বিপ্রহর। এ দুটি মিলে একই প্রান্ত। এক্ষেত্রে যোহর থাকে না। যদি দু’প্রান্ত হিসেবে দ্বিপ্রহরকে শুমার করা হয়, তাহলে যোহরকে পাওয়া যায় কিন্তুু তবুও ফজরের উল্লেখ বার বারই থেকে যায়। এই শাব্দিক অভিযোগ সম্বলিত প্রশ্নের উত্তর এই যে, আতরাফ শব্দটি যদিও বহু বচন কিন্তুু আরবী আষায় তাসনিয়া অর্থাৎ দ্বিবচনের উপরও বহু বচনের ব্যবহার হয়ে থাকে। এ ধরনের ব্যবহারিক প্রক্রিয়া খোদ কুরআনুল কারীমেও আছে। যেমন আল-কুরআনের একস্থানে মাশরেক্কাইন দু’মাশরিক, এবং মাগরেবাইন দু’মাগরিব বলা হয়েছে। অপর স্থানে এই শব্দদ্বয়কেই মাশারিক এবং মাগরিব বলা হয়েছে।
সূরা তাহরীমে আছে এখানে অর্থাৎ তোমরা দু’জনের অন্তরসমূহ। একথা সুস্পষ্ট যে, দু’জন লোকের অনেকগুলো অন্তর হতে পারে না। বরং দু’জনের মাত্র দু’টি অন্তরই থাকবে। এ কারণে অন্তরসমূহের ব্যবহার হতে পারে না।
কিন্তু দ্বিবচনের দ্বারা বহুবচন বুঝানো আরবী ভাষায় একটি কথাবার্তার রীতি ও বাকধারা। এখানে কিয়াস বা বুদ্ধি-বিবেচনার স্থান নেই। ঠিক একই অর্থে আতরাফ বহু বচনের দ্বারাও দু’টি প্রান্তই বুঝায়। একথা সকলেই স্বীকার করেন যে দিনের দুটি বিশেষ প্রান্ত রয়েছে। প্রথমটি সকাল যা দ্বিপ্রহর পর্যন্ত প্রলম্বিত। দ্বিতীয়টি দ্বিপ্রহর হতে সন্ধ্যা পর্যন্ত বিস্তৃত। এখানে আতরাফ দ্বারা উভয় প্রান্তের শেষ কিনারা বুঝায়। সকাল হতে দ্বিপ্রহর পর্যন্ত অংশের শেষ কিনারায় হচ্ছে যোহর এবং দ্বিপ্রহর হতে সূর্যাস্ত অংশের শেষ প্রান্ত হচ্ছে আসর অথবা মাগরিব। কিন্তুু আসরের কথা যেহেতু সূর্যাস্তের আগে কথার মাঝে আছে সেহেতু আসর সুনির্দিষ্ট হয়ে গেছে। তাই সূর্যাস্তের শেষ-প্রান্ত বলতে মাগরিবকেই বুঝাবে।
আরোও একটি প্রমাণ :
যদি আমরা কুরআনুল কারীমের পৃথক পৃথক আয়াতগুলো হতে পাঞ্জেগানা ওয়াক্তসমূহের প্রমাণ উপস্থাপন করতে চাই, তাহলে এটাও সম্ভব। যেমন :
১। সূর্য ঢলে পড়ার সময় নামাজ কায়েম কর (সূরা আসরা : রুকু-৯) এটা হলো যোহরের নামাজের ওয়াক্ত।
২। সূর্যাস্তের পূর্বে আল্লাহর তাসবীহ পাঠ কর। (সূরা ক্কাফ : রুকু—৩) এবং সকালে এবং আসরের সময় স্বীয় প্রতিপালকের নাম স্মরণ কর। (সূরা দাহার : রুকু-২) এহলো আসরের নামাজের ওয়াক্ত। আর আসরকে মধ্যবর্তী নামাজ (সূরা বাকারাহ : রুকু-৩) এজন্য বলা হয়েছে যে, তা দিনের নামাজের মাঝে যোহর এবং মাগরিবের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত।
৩। এবং দিনের (শুরু এবং শেষ) উভয় প্রান্তে নামাজ কায়েম কর। (সূরা হুদ : রুকু-১০) দিনের প্রথম কিনারায় ফযর এবং শেষ দিনারায় মাগরিব।
৪। সূরা নূরে আছে, সকালের নামাজের পূর্বে ডাক দেয়া ছাড়া মহিলা গৃহে অথবা গৃহে প্রবেশ করোনা। (সূরা নূর : রুকু-৮) এর দ্বারা ফজরের নামাজের আমলী প্রমাণ পাওয়া যায়। তারপর একই সূরায় বলা হয়েছে, “এবং এশার নামাজের পর। এই নির্দেশের আলোকে এশার নামাজের পর যা শোয়া এবং গাত্রবস্ত্র খোলার সময়, তখন কাহারো গৃহে অনুমতি ছাড়া প্রবেশের অনুমতি নেই। এর দ্বারাও এশার নামাজের আমলী প্রমাণ পাওয়া যায়। এবং এর দ্বারা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের প্রমাণ লাভ করা যায়। (চলবে)
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন