(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
২৯. রমাদান মক্কা বিজয়ের মাস
অষ্টম হিজরীর ২০ বা ২১ রমাদান জুমাবার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরাম মক্কা বিজয় করেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মক্কায় প্রবেশ করে কোনো প্রতিশোধ গ্রহণের কথা বলেননি। তিনি এ মর্মে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন এক. যারা আপন ঘরের দরজা বন্ধ করে থাকবে তারা নিরাপদ। দুই. যারা আবু সুফিয়ানের ঘরে থাকবে তারাও নিরাপদ। তিন. যারা কাবাগৃহে আশ্রয় নেবে তারাও নিরাপদ।
মক্কা বিজয়ের এই ঘটনার সঙ্গে আধুনিককালের কোনো রাজ্যজয়ের ঘটনা তুলনা করলেই ইসলাম ও জাহিলিয়াতের পার্থক্যটা স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে। জাহিলিয়াতের ঝাÐাবাহীরা বিজয়কে মনে করে নিজেদেরই কৃতিত্বের ফসল। তাই বিজয় উৎসবের নামে তারা প্রকাশ করে দানবীয় উল্লাস। আর সে উল্লাসের শিকার হয় অসহায় ও নিরস্ত্র মানুষ।
৩০. রমাদান তাবুক যুদ্ধের মাস
নবম হিজরীর রজব মাসে তাবুক যুদ্ধ সংঘটিত হয়। কিন্তু তাবুক যুদ্ধের কিছু ঘটনা সংঘটিত হয় নবম হিজরীর রমাদান মাসে। [আলফিকহুল ইসলামী ওয়া আদিণল্লাতুহু : ৩/১৬২৭]
তাবুক মদিনা ও সিরিয়ার মধ্যবর্তী একটি স্থানের নাম। মদিনা থেকে এটি ৬৯০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এ যুদ্ধ ছিল ইসলামের বিরুদ্ধে আরবের কাফির ও মুনাফিকদের শেষ চেষ্টা। মুসলমানদের বিরুদ্ধে তৎকালীন বিশ্বের অন্যতম সা¤্রাজ্যবাদী শক্তি রোমান ও আরবের কাফিরদের সমন্বয়ে ঘটিত যৌথ বাহিনীর রণপ্রস্তুতিই এ যুদ্ধের মূল কারণ। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মক্কা বিজয় ও হুনায়েনের যুদ্ধ শেষে যখন মদিনায় ফিরে এলেন, এর কিছুদিন পর সিরিয়া থেকে ফিরে আসা কিছু বণিকদলের কাছ থেকে খবর পেলেন, রোম স¤্রাট হিরাক্লিয়াস মদিনা আক্রমণ করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। এ লক্ষ্যে সিরিয়া ও আরব সীমান্তে তারা এক বিশাল বাহিনী মোতায়েন করছে। রোম ছিল তৎকালীন দুনিয়ার বৃহৎ শক্তি। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ফয়সালা করেন, হিরাক্লিয়াসের আক্রমণের অপেক্ষা না করে মুসলমানরা নিজেরাই আগে তাদের ওপর আক্রমণ চালাবে। তিনি মদিনার সব মুসলিমকে এ যুদ্ধে শরিক হওয়ার নির্দেশ দিলেন। পরে রোমানরা মুসলমানদের ভয়ে যুদ্ধ না করেই পলায়ন করেছে।
৩১. রমাদান কাদেসিয়া যুদ্ধের মাস
কাদেসিয়া যুদ্ধ ১৫ হিজরী সনের রমাদান মাসে সংঘটিত হয়। সাদ বিন আবি ওয়াক্কাছ রাদিআল্লাহু আনহুর নেতৃত্বে মুসলমান ও রস্তুম ফাররাখজাদের নেতৃত্বে পারসিকদের মধ্যে এ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। তবে ইবনে কাছির রহমাতুল্লাহ আলাইহি তারিখ উল্লেখ ছাড়াই বলেছেন, এটি ১৪ হিজরী সনে হয়েছিল। [আলবিদায়াহ ওয়াননিহায়াহ : ৯/৬১৩]
এ যুদ্ধে মুসলিম সৈন্য ছিল সর্বসাকল্যে ৩৬ হাজার বা তার চেয়ে কিছু বেশি। আর কাফিরদের সৈন্য ছিল দুই লাখ। চার দিন ও তিন রাত প্রচন্ড যুদ্ধ চলার পর কাদেসিয়া যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে। মাত্র ৩৬ হাজার মুসলিম সৈন্য দুই লাখ সুসজ্জিত পারসিক বাহিনীকে পরাজিত করে। এ যুদ্ধের ফলে ওই অঞ্চল ইরাকের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায় এবং সেখানে ইসলামের প্রচার-প্রসারের সব বাধা দূরীভূত হয়। যুদ্ধের পর চার হাজার পারসিক সৈন্য সরাসরি ইসলাম গ্রহণ করে। এ ছাড়া বিভিন্ন গোত্র ও ইরাকে বসবাসরত ধর্মযাজক দলে দলে সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাছ রাদিআল্লাহু আনহুর কাছে এসে ইসলাম গ্রহণের ঘোষণা দেয়।
৩২. রমাদান মূর্তি অপসারণের মাস
রমাদান মাসে মক্কা বিজয় হয়। আর মক্কা বিজয়ের পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কাবাঘরে প্রবেশ করে সর্বপ্রথম সেখানে রাখা মূর্তি বাইরে ছুড়ে ফেলার নির্দেশ দেন। তখন কাবাগৃহে ৩৬০টি মূর্তি ছিল।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অষ্টম হিজরীর ২৫ রমাদান খালেদ ইবনে ওয়ালিদ রাদিআল্লাহু আনহুর নেতৃত্বে একদল সৈন্যবাহিনী প্রেরণ করেন নাখলা নামক জায়গার একটি বৃহদাকার মূর্তি অপসারণের জন্য, কাফিররা এর পূজা করত, যার নাম ছিল উজ্জা। খালেদ ইবনে ওয়ালিদ রাদিআল্লাহু আনহু নিজ হাতে ওই মূর্তি অপসারণ করেন। এরপর তিনি বলেন, আর কখনো এখানে উজ্জার উপাসনা হবে না। [আলবিদায়াহ ওয়াননিহায়াহ : ৪/৩১৬]
নবম হিজরীর রমাদান মাসে তায়েফের সাকিফ গোত্র স্বেচ্ছায় ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে এবং তারা নিজেরাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজেদের উপাস্য ‘লাত’ নামক মূর্তি অপসারণ করে। [আলবিদায়াহ ওয়াননিহায়াহ : ৫/৩১৬]
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘আমার উম্মত যদি মাহে রমাদানের গুরুত্ব বুঝত, তাহলে সারা বছর রমাদান কামনা করত।’ [মাজমাউজ যাওয়ায়েদ-৩য় খÐ পৃষ্ঠা ১৪১] রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আগে থেকেই রমাদান মাসের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিতেন এবং রজব মাসের চাঁদ দেখে মাহে রমাদান প্রাপ্তির আশায় বিভোর থাকতেন। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আবেগভরে পরম করুণাময়ের দরবারে প্রার্থনা করতেন, ‘হে আল্লাহ! আপনি রজব ও শাবানের মধ্যে আমাদের জন্য বরকত দান করুন এবং আমাদের রমাদান পর্যন্ত পৌঁছে দিন।’ [মুসনাদে আহমাদ : ২৩৪৬]
প্রকৃতপক্ষে মাহে রমাদান মুসলমানদের জন্য একটি বার্ষিক প্রশিক্ষণ কোর্স, যার মাধ্যমে সিয়ামপালনকারীর জীবন প্রভাবিত হয়। মাহে রমাদানের অসীম কল্যাণ ও বরকত লাভের প্রত্যাশার জন্য আগে থেকে সবার দৈহিক ও মানসিকভাবে ইবাদাতের প্রস্তুতি গ্রহণ করা বাঞ্ছনীয়। মাহে রমাদানের পবিত্রতা রক্ষার্থে মাসব্যাপী ইবাদাত-বন্দেগি তথা সেহরি, ইফতার, তারাবি, পবিত্র কুরআন তিলাওয়াত, ইতিকাফ, তাহাজ্জুদ, দান-সাদকা, তওবা-ইস্তেগফার প্রভৃতি আদায়ের সামগ্রিক প্রস্তুতি নেওয়া উচিত। (সমাপ্ত)
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন