মুহাম্মদ বশির উল্লাহ : সময়ের আবর্তে আরবি সনের ১১টি মাস অতিক্রম করে আমাদের কাছে হাজির হয়েছে মাহে রমজান। বহু প্রতীক্ষিত বস্তু যখন সুন্দর উপস্থাপনায় কারো দ্বারে উপস্থিত হয় তখন আর আনন্দের কোনো সীমা থাকে না। তেমনি চাতক পাখির ন্যায় ১১ মাস প্রতীক্ষার পর মুসলমানদের কাছে যখন মাহে রমজানুল মুবারক উপস্থিত হয়। প্রবাহিত হতে থাকে রহমতের ঝর্ণাধারা। খুলে দেয়া হয় ক্ষমার দুয়ার। বন্ধ করে দেয়া হয় জাহান্নামের দরজা। খুলে দেয়া হয় জান্নাত। খুলে দেয়া হয় আকাশের দরজা। মানুষকে করে তোলে পবিত্র। পাপ থেকে করে মুক্ত। ধনীরা গরীবের হক আদায় করতে থাকে। পাপীরা তওবার মাধ্যমে ফিরে আসে সত্যের দুয়ারে। ধনী-গরীব, শত্রæ-মিত্র, দাঁড়িয়ে যায় একই কাতারে। শুরু হয় শান্তি, সৌহার্দ্যরে অপরূপ লীলা ও রহমতের ঝর্ণাধারা। এ প্রসঙ্গে ফরমান হচ্ছে। সায়্যিদুনা আবু সাঈদ খুদবী রাদি-আল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত, প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম বলেন, যখন রমজান মাসের প্রথম রাত আসে তখন আসমানগুলো ও জান্নাতের দরজাগুলো খুলে দেয়া হয়। আর সেগুলো সর্বশেষ রাত পর্যন্ত বন্ধ হয় না। যে কোন বান্দা এ বরকতময় মাসের যে কোন রাতে নামাজ পড়ে তবে আল্লাহ তা’আলা তার প্রতিটি সেজদার পরিবর্তে তার জন্য পনের শত নেকী লিপিবদ্ধ করেন। আর তার জন্য জান্নাতে লাল পদ্মারাগের মহল তৈরি করেন, যার ষাট হাজার দরজা থাকবে, প্রতিটি দরজার কপাট স্বর্ণের তৈরি হবে, সুতরাং যে কেউ রমজানের প্রথম রোজা রাখে তার জন্য আল্লাহ এর সত্তর হাজার ফিরিশতা মাগফিরাতের দু’আ করতে থাকে। রাত ও দিনে যখনই সে সেজদা করে তার এই প্রতিটি সেজদার পরিবর্তে তাকে (জান্নাতে) এক একটা এমন গাছ দান করা হবে, সেটার ছায়া অতিক্রম করতে অশ্বারোহীকে পাঁচশ বছর দৌড়াতে হবে। (শু’আবুল ঈমান, খÐ-৩য়, পৃ-৩১৪ হাদিস নং-৩৬৩৫) মহান আল্লাহ তা’আলা এর কতোই মহান করুনা যে, তিনি প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম এর ওসীলায় এমন মাহে রমজান দান করেছেন যে, এ সম্মানিত মাসে জান্নাতের সমস্ত দরজা খুলে দেয়া হয়। নেকিগুলোর প্রতিদান এতো বেশি বেড়ে যায় যে, বর্ণিত হাদীস অনুসারে রমজানুল মুবারক এর রাতগুলোতে নামাজ সম্পন্নকারীকে প্রতিটি সেজদার বিনিময়ে পনের শত নেকি দান করা হয়। এ বরকতময় হাদীসে রোজাদারদের জন্য এ মহা সুসংবাদও মওজুদ রয়েছে যে, সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সত্তর হাজার ফিরিশতা তাদের জন্য মাগফিরাতের দু’আ করতে থাকেন।
পবিত্র রমজানের বরকতময় সংজ্ঞা ঃ
রমজান মাসের ব্যাখ্যায় প্রসিদ্ধ মুফাসসির হযরত মুফতী আহমদ ইয়ার খান নঈমী রহ. তাফসীরে নঈমীতে লিখেছেন, রমজান শব্দটি হয়তো রহমান শব্দটির মতো আল্লাহ তা’আলার নাম। যেহেতু এ মাসে দিনরাত আল্লাহ তা’আলা এর ইবাদত করা হয়, সেহেতু সেটাকে রমজান মাস অর্থাৎ আল্লাহ তা’আলার মাস বলা হয়। যেমন, মসজিদ ও কা’বাকে আল্লাহ তা’আলার ঘর বলা হয়। কারণ, সেখানে আল্লাহ তা’আলা এর কাজ সম্পন্ন হয়। তেমনিভাবে রমজান আল্লাহ তা’আলার মাস। কারণ, এ মাসেও মহান আল্লাহ তা’আলার কাজ হয়ে থাকে। রোজা ও তারাবীহ ইত্যাদিতো আল্লাহ তা’আলা এরই। কিন্তু রোজা রাখাবস্থায় যেই বৈধ চাকরি, বৈধ ব্যবসা ইত্যাদি করা হয়, তাও আল্লাহর কাজ বলে সাব্যস্থ হয়। এ কারণেই এ মাসের নাম রমজান তথা আল্লাহর মাস। অথবা এটা ‘রমদ্বাউ’ থেকে উদ্ভূত। রমদ্বাউ বলে হেমন্ত কালের বৃষ্টিকে। যা দ্বারা ভূপৃষ্ঠ ধুয়ে যায়, আর রবিশস্য খুব বেশি পরিমাণে উৎপন্ন হয়। সুতরাং এ মাসও হৃদয়ের ময়লা-আবর্জনা ধুয়ে পরিষ্কার করে দেয়। এর ফলে কর্মসমূহের শষ্যক্ষেত্র সবুজ ও সজীব থাকে, এ কারণে এটাকে রমজান মাস বলে। শ্রাবণে প্রত্যেহ বৃষ্টি চাই, ভাদ্র মাসে চাই ‘চারদিন’ আর আশ্বিনে চাই একদিন। এ এক দিনের বৃষ্টিতে ক্ষেতের ফসল পেকে যায়। সুতরাং অনুরূপভাবে, এগার মাস নিয়মিতভাবে নেক কার্যাদি অব্যাহত রাখা হয়, তারপর রমজানের রোজাগুলো এই নেক কাজগুলোর শস্যক্ষেতের ফসল পাকিয়ে দেয়। অথবা এটা ‘রামদ্বুন’ থেকে গঠিত। এর অর্থ ‘ঊষ্ণতা’ কিংবা ‘জ্বলে যাওয়া’। যেহেতু এ মাসে মুসলমানগণ ক্ষুধা ও পিপাসার তাপসহ্য করে, কিংবা এটা গুনাহগুলো জ্বালিয়ে দেয় সেহেতু এটাকে রমজান বলা হয়। ‘কানযুল উম্মাল’-এর ৮ম খন্ডের ২১৭ পৃষ্ঠায় হযরত আনাস রাদি-আল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণনা উদ্ধৃত করা হয়েছে, প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম এরশাদ করেছেন, এ মাসের নাম ‘রমদ্বান’ রাখা হয়েছে কেননা, এটা গুনাহ গুলোকে জ্বালিয়ে দেয়।
ফযিলতে রমজানুল মুবারক :
হযরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ রাদি-আল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম এর ফরমান হচ্ছে, আমার উম্মতদেরকে রমজান মাসে পাঁচটি জিনিস এমনি দান করা হবে, যেগুলো আমার পূর্বে অন্য কোনো নবী পাননি।
(এক) যখন রমজানুল মুবারক এর প্রথম রাত আসে, তখন আল্লাহ তা’আলা তাদের দিকে রহমতের দৃষ্টি ফেরান। আর যার দিকে আল্লাহ রহমতের দৃষ্টি ফেরান তাকে কখনও আযাব দেবন না। (দুই) সন্ধ্যায় তাদের মুখের দুর্গন্ধ (যা ক্ষুধার কারণে সৃষ্টি হয়) আল্লাহ তা’আলা এর নিকট মেশকের চেয়েও বেশি খুশবুদার হয়। (তিন) ফিরিশতাগণ প্রতিটি দিনে ও রাতে তার জন্য মাগফিরাতের দু’আ করতে থাকে। (চার) আল্লাহ তা’আলা জান্নাতকে নির্দেশ দিয়ে ইরশাদ ফরমান, আমার নেক বান্দাদের জন্য সুসজ্জিত হয়ে যাও! অবিলম্বে তারা দুনিয়ার কষ্টের বিনিময়ে আমার ঘর ও দয়ার মধ্যে শান্তি পাবে। (পাঁচ) যখন রমজান মাসের সর্ব শেষ রাত আসে তখন আল্লাহ তা’আলা সবাইকে ক্ষমা করে দেন। তখন এক ব্যক্তি কিয়াম করে আরজ করলেন, হে আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম এটা কি লাইলাতুল কদর? ইরশাদ ফরমালেন, না! তোমরা কি দেখছ না যে মজদুরগণ যখন নিজের কাজ সম্পন্ন করে নেয়, তখন তাদেরকে পারিশ্রামিক দেয়া হয়। (আত্তারগীব, ওয়াত্তারহীব ২য় খÐ, ৫৬ পৃষ্ঠা, হাদীস নং-৭) হযরত আবু হুরায়রা রাদি-আল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত, প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম এর আনন্দদায়ক ফরমান, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ, জুমা পরবর্তী জুমা পর্যন্ত, রমজান মাস পরবর্তী রমজান মাস পর্যন্ত গুনাহসমূহের কাফফারা, যতক্ষণ কবীরা গুনাহ থেকে বিরত থাকা হয়। (মুসলিম ১ম খÐ, ১৪৪ পৃ: হাদীস নং ২৩৩) (চলবে)
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন