১৭৫৭ সালের ২৩ শে জুন ও ৪ জুলাই আমাদের ও উপমহােেদশের ইতিহাসের দুটি স্মরণীয় দিন। দুটিই বেদনাবহ দিন। প্রথম উল্লেখিত দিনটিতে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার নবাব সিরাজউদ্দৌলা মুর্শিদাবাদের পলাশিতে ইংরেজ বাহিনীর সাথে যুদ্ধে পরাজিত হন। আর দ্বিতীয় দিনটিতে তিনি শাহাদত বরণ করেন (তার শাহাদত বরণের তারিখ কোনো সূত্রে ২ জুলাই , আবার কোনো সূত্রে ৩ জুলাইও বলা হয়েছে)। তার সেনাপতি মীর জাফর আলী খান , দেওয়ান রাজবল্লভ, রায় দুর্লভ, উমিচাঁদ, জগৎশেঠসহ নবাবের দরবারের আরো কয়েকজন প্রভাবশালী সেনা অধিনায়ক, আমীর-ওমরাহ, মুর্শিদাবাদের কয়েকজন ব্যবসায়ী, নদীয়ার জমিদার মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র, নাটোরের জমিদার রানী ভবানী প্রমুখের সম্মিলিত চক্রান্তে ও বিশ্বাসঘাতকতায় তিনি করুণ পরাজয়ের শিকার হন। এ চক্রান্তকারী গোষ্ঠীর বিপরীতে নবাব সিরাজের কোনো অনুগত বা শুভাকাক্সক্ষী গোষ্ঠীর কথা জানা যায় না। যতদূর মনে হয়, সিংহাসনে আরোহণের পর তিনি হয়ে পড়েছিলেন আপনজনহীন ও একা। অন্যভাবে বললে, নিয়তি নবাবকে দুর্ভাগ্যের তিমিরাবরণে জড়িয়ে দিয়েছিল। তার মাতামহ আলিবর্দি খান যে অসীম বীরত্ব, সাহস, কৌশল ও অক্লান্ত পরিশ্রমে অভ্যন্তরীণ কোন্দল নিয়ন্ত্রণ করে নিজের সিংহাসন রক্ষা এবং ভয়ংকর মারাঠা বর্গিদের নিকট থেকে পরিত্রাণ লাভ করেছিলেন, তার দৌহিত্র সিরাজের মধ্যে সে সব ততটা দেখা যায়নি । আলিবর্দির নবাবী কাল ছিল তুলনামূলক ভাবে অনেক নিরাপদ ও ঝুঁকিমুক্ত। শক্তি ও ক্ষমতাধর শাসক হিসেবে তাকে অগ্রাহ্য করার সাহস বাংলা-বিহার-উড়িষ্যায় কারো বা কোনো মহলের ছিল না। কিন্তু তার স্নেহ ও আাশির্বাদ ধন্য হলেও নবাব সিরাজের ক্ষেত্রে পরিস্থিতি সে রকম হয়নি। তার বেলায় শুরু থেকেই পরিস্থিতি ছিল প্রতিক‚ল। তার স্বজনের মধ্যেই ছিল ঘোর শত্রæ, শত্রæ ছিল নবাবের নিজ দরবারে এবং দরবারের বাইরে। এক কথায় বলা যায়, তাকে ঘিরে রচিত হয়েছিল যড়যন্ত্রের বিরাট ও নোংরা ঘন বেড়াজাল। এই কুচক্রী মহল নিজেদের প্রয়োজনেই খুঁজে নিয়েছিল ইংরেজদের যারা ছিল আরো অনেক বেশি ধূর্ত, কৌশলী এবং সাহসীও। অভ্যন্তরীণ ও বাইরের শক্তির সম্মিলিত স্বার্থের নিবন্ধনে এ ষড়যন্ত্র হয়ে উঠেছিল সর্বপ্লাবী। সিরাজউদ্দৌলা নিজ নেতৃত্ব, বুদ্ধি ও কৌশল দিয়ে ঘরের ও বাইরের এ সব শত্রæর মোকাবেলা করতে ব্যর্থ হন। দেখা যায়, নিজের অলক্ষ্য নিয়তি এবং নবাব দরবারে বিশ^স্ত, দক্ষ, নির্ভরযোগ্য মানুষের অভাব তাকে অনিবার্য পরাজয় ও করুণ পরিণতির দিকে ঠেলে দিয়েছিল। এই পরাজয়ের সমস্ত পথটাই সুকৌশলে রচনা, মসৃণ ও নিশ্চিত করে অভ্যন্তরীণ শত্রুরা।
এখানে উল্লেখ করা দরকার যে বাদশাহ-নবাবদের কেউই প্রচলিত রেওয়াজ মোতাবেক নিজে সৈন্য পরিচালনা করতেন না। তাই তাদের কারোরই নিজস্ব কোনো সৈন্যবাহিনী থাকত না। সেনাবাহিনীতে নিয়ম অনুযায়ী একজন সেনাপতি থাকতেন। তার অধীনে থাকতেন এক থেকে দশ হাজার সৈন্যের অধিনায়ক অনেক মনসবদার। তারাই যুদ্ধক্ষেত্রে নিজে অধীনস্থ অফিসারসহযোগে যুদ্ধ পরিচালনা করতেন। সে হিসেবে নবাব সিরাজেরও নিজস্ব কোনো বাহিনী ছিল না। তিনি ছিলেন সেনাপতি মীর জাফরের উপর নির্ভরশীল। তার সাথে ছিলেন প্রভাবশালী সেনা অধিনায়কগণ- যেমন ইয়ার লুৎফ খান, রায়দুর্লভ, নন্দকুমার, মানিকচাঁদ প্রমুখ।
প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, নবাবকে সিংহাসনচ্যুত করার পক্ষে কলকাতা পরিষদ ১৭৫৭ সালের ২৩ এপ্রিল প্রস্তাব গ্রহণ করে। ইংরেজ সেনাপতি কর্নেল লর্ড ক্লাইভ এ প্রস্তাব কার্যকর করতে নবাবের দরবারের অভিজাত সদস্য উমিচাঁদকে এজেন্ট নিযুক্ত করেন। বলা হয়েছে, এ ষড়যন্ত্রের নেপথ্য নায়ক ছিলেন মীর জাফর।
ঐতিহাসিকদের কেউ কেউ বলেছেন, নবাব সিরাজ তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের কিছু টের পেয়েছিলেন। সেনাপতি মীর জাফর আলি খানের বিষয়ও তিনি জেনে গিয়েছিলেন। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার বলেন, নবাব ষড়যন্ত্রকারীদের গোপন ষড়যন্ত্রের কথা জানার পর যদি মীর জাফরকে বন্দি করতেন, তবে অন্যান্য ষড়যন্ত্রকারী ভয় পেয়ে যেত এবং ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হলে পলাশীর যুদ্ধ হতো না। কিন্তু নবাব সিরাজ শক্ত কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেননি।
ইংরেজদের ব্যাপারে নবাব আলিবর্দি সতর্ক ছিলেন। তিনি ছিলেন চৌকস, দূরদর্শী। তিনি তাদের বাণিজ্য নিষিদ্ধ করেননি, কিন্তু বাড়তেও দেননি। ইংরেজরা ভারতে নিজেদের প্রধান ঘাঁটি মাদ্রাজ থেকে পূর্বমুখী বাণিজ্যে কলকাতাকে আশ্রয় করে। সুতানুটি, গোবিন্দপুর ও ডিহি কলকাতা গ্রামকে ঘিরে ১৬৯০ সালে জব চার্নকের স্থাপিত কলকাতা নামক ব্যবসা কেন্দ্রটি বিকশিত দ্রæত হচ্ছিল। তারা গোপনে তা আলিবর্দির দৃষ্টি এড়িয়েই কলকাতাতে ক্রমশ শক্তি সাঞ্চত করছিল। অচিরেই এখানে গড়ে ওঠে দুর্গ। সিরাজের পতন ঘটাতে কলকাতাই হয়ে ওঠে ইংরেজদের শক্তি বলয়, পরবর্তীতে ভারতে ইংরেজ শক্তি ও সাম্রাজ্য বিস্তারের প্রাণকেন্দ্র। ১৯১১ সালে দিল্লিতে রাজধানী স্থানান্তরের আগে কলকাতা ছিল ইংরেজ দখলাধীন ভারতের রাজধানী। যাহোক, বসতি হিসেবে সবে দৃশ্যমান কলকাতা ইংরেজদের ক্ষমতার কেন্দ্রে পরিণত হওয়ার পর্বেই নবাব সিরাজ ইংরেজদের ক্ষমতা চ‚র্ণ করতে অভিযান চালান। তিনি কলকাতা জয় করেন, নাম পাল্টে করেন আলীনগর। তবে দেশীয় ষড়যন্ত্রকারীদের সাথে ইংরেজদের গোপন নিবিড় সম্পর্কের কারণে ইংরেজ দমন ও তাদের শক্তি খর্ব করার নবাবের ইচ্ছা কার্যকর হতে পারেনি। তার পদস্থ কর্মকর্তারা ও হিন্দু ব্যবসায়ীরা প্রকাশ্যেই ইংরেজদের সাহায্য করে তাদের অবস্থানকে শক্তিশালী করে। নবাব তাদের এ ইংরেজ সংযোগ-সহযোগিতা রোধ করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হন।
কিন্তু পরাজয়েই নবাবের দুর্ভাগ্যের শেষ হয়নি। পলাশি যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত ৫০ হাজার সৈন্যের বিরাট বাহিনীর মধ্যে নবাব তার অনুগত হিসেবে পেয়েছিলেন ৫ হাজার সৈন্যকে যারা ছিল মোহনলাল ও মীর মদনের নেতৃত্বে। মীরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতার বিষয়টি স্পষ্ট হওয়ার পর নবাব হতাশ হয়ে পলাশি ত্যাগ করে পুনঃ শক্তি সঞ্চয়ের উদ্দেশ্যে মুর্শিদাবাদ ফিরে আসেন। আশ্চর্য যে সেদিন নবাব নিজের রাজধানীতে তার ক্ষমতা ও অস্তিত্ব রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় সহায়তা লাভে ব্যর্থ হন। সেখানে পরিস্থিতি অনুক‚ল নয় বোঝার পর তিনি রাজধানী ত্যাগ করেন। এক পর্যায়ে ৩ জুলাই তাকে বাইরের এক স্থান থেকে আটক করা হয়। তুলে দেয়া হয় মীর জাফর পুত্র মীরনের হাতে।
নবাব সিরাজউদ্দৌলা বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন ১৭৫৬ সালের ১০ই এপ্রিল। ১৭৫৭ সালে পলাশির তথাকথিত যুদ্ধে পরাজিত হলেও কার্যত তখনো তিনি নবাব ছিলেন। জুলাই দিবাগত রাতে ৪ জুলাই ভোরে তাকে মীরনের নির্দেশে কারাগারে আটক অবস্থায় হত্যা করে মোহাম্মদী বেগ। এর মধ্য দিয়ে ইতি ঘটে এ স্বাধীন নবাবী শাসনের। তারপর মীর জাফর, তাকে সরিয়ে মীর কাশিম ও পুনরায় মীর জাফরকে নবাব করার ঘটনা ঘটে। দু জনই ছিলেন ইংরেজদের ক্রীড়নক। মীর জাফর তো ছিলেন ইংরেজদের স্বীকৃত দাস। মীর কাশিম ইংরেজদের সাথে স্বার্থ নিয়ে দু বার লড়াইতে লিপ্ত হলেও শেষবার শোচনীয় ভাবে পরাজিত হয়ে নিরুদ্দেশ হন। ১৭৬৫ সালে মীর জাফরের মত্যুর পর তার পুত্র নাজিমউদ্দৌলাকে নবাব নিযুক্ত করে ইংরেজরা। এ বছরের ১২ই আগস্ট ইংরেজরা দিল্লিতে মোগল বাদশাহর কাছ থেকে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার দেওয়ানী লাভ করে। ১৭৬৫ সালে ক্লাইভ শাসনক্ষমতা নিজেদের হাতে তুলে নেন।
পলাশি সম্পর্কে জানা যায় যে ঐ স্থানে সে সময় আমবাগানের পাশাপাশি শত শত পলাশ গাছ ছিল। সে জন্যই স্থানটিকে পলাশি বলা হত। আর আমবাগানের নাম ছিল লক্কাবাগ। কথিত আছে, ঐ জায়গাতে তখন লক্ষাধিক আমগাছ ছিল বলে লক্কাবাগ নাম হয়। অন্যদিকে আঠারো শতকের পলাশির ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে । ১৮০১ সালে পলাশি নদীগর্ভে বিলীন হয়। বিশেষ করে সেই আমবাগানের শেষ আমগাছটিও শুকিয়ে মরে যায়। ১৮৭৯ সালে ইংরেজরা পলাশি যুদ্ধের বিজয়ের স্মৃতি হিসেবে সে গাছটির শিকড়সহ তুলে লন্ডনে পাঠায়। অন্যদিকে ১৮৮৩ সালে সেখানে একটি ছোট বিজয়স্তম্ভ নির্মাণ করে ইংরেজরা। আরো পরে লর্ড কার্জন বড় আকারের বিজয়স্তম্ভ নির্মাণ করেন (সূত্র ‘নদীয়া-কাহিনী’, কুমুদনাথ মল্লিক, কলকাতা, ১৩১৭)। প্রসঙ্গত, এ তথ্য উনিশ শতকের। বিশ শতকে পলাশির আরো কিছু পরিবর্তন ঘটেছে। এর মধ্যে বিশেষ উল্লেখ্য হচ্ছে ২০০৭ সালে পলাশিতে নবাব সিরাজের একটি আবক্ষ ভাস্কর্য স্থাপন।
১৭৫৭-র ৪ঠা জুলাইয়ের পর ২৬২টি বছর হারিয়ে গেছে কালের বুকে। সময়ের পরিবর্তন, ঘটেছে। এসেছে নতুন যুগ, রচিত হয়েছে নতুন ইতিহাস। ইংরেজরা নবাব সিরাজের নামটি ইতিহাস থেকে মুছে ফেলতে, তাকে কলংকিত করতে বহু চেষ্টা করেছে, নিজেদের তাবেদারদের দিয়ে অসত্য ইতিহাস রচনা করিয়েছে। এমনকি তথাকথিত ইংরেজ হত্যার জন্য নবাব সিরাজকে দায়ী করে তারা ‘অন্ধক‚প হত্যা’ কাহিনীর অবতারণা করে। নিহতদের ভুয়া স্মৃতি রক্ষায় কলকাতায় নির্মাণ করে হলওয়েল মনুমেন্ট। কিন্তু সে কুখ্যাত মনুমেন্ট সিরাজ উদ্দৌলা অনুরাগীদের প্রতিরোধ সংগ্রামের মুখে বিলুপ্ত হয়।
পলাশি যুদ্ধের মধ্য দিয়ে উপমহাদেশে ইংরেজ শাসন বিস্তারের সূচনা ঘটেছিল। তারা প্রায় দুশ’ বছরের জন্য হয়ে ওঠে দখলদার। ভারত হয় তাদের উপনিবেশ, তারা হয় ঔপনিবেশিক শাসক। শেষ পর্যন্ত প্রায় পৌণে একশ’ বছর আগে তাদের এই উপমহাদেশ ছেড়ে বিদায় নিতে হয়। তারা আজ ছেঁড়া কাগজের মত পরিত্যক্ত। কিন্তু ইতিহাস থেকে, উপমহাদেশের মানুষের মন থেকে নবাব সিরাজউদ্দৌলার নামটি হারায়নি। সময় অতিক্রান্ত হয়েছে, কিন্তু কালের বুকে মানুষের অপরিসীম প্রীতি ও ভালোবাসায় জ¦লজ¦ল করছে তার নাম। এই উপমহাদেশে ইংরেজ দখল প্রতিরোধের প্রথম নায়ক নবাব সিরাজউদ্দৌলা। ইংরেজ বিরোধী লড়াইয়ের প্রথম শহীদ তিনি। তিনি গোটা উপমহাদেশবাসী এবং বিশেষ করে বাঙালিদের কাছে আজো পরম আপন, সুগভীর শ্রদ্ধা ও সম্মানের আসনে অধিষ্ঠিত।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন