বাংলাদেশের বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ ৩৭ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে এসেছে, যা ২৬ মাসের মধ্যে সবচেয়ে কম। গতকাল বৃহস্পতিবার অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর এই সূচকের পরিমাণ ছিল ৩৬ দশমিক ৮৫ বিলিয়ন ডলার। এর একদিন আগে গত বুধবার এর পরিমাণ ছিল ৩৬ দশমিক ৯৭ বিলিয়ন ডলার। এর আগে গত মঙ্গলবার রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৩৭ বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি।
রফতানি আয়ের বিপরীতে উচ্চ আমদানি ব্যয় পরিশোধের পর দেশের রিজার্ভ ৩৭ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে এসেছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ কর্মকর্তারা। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলেন, আমদানি ব্যয় কমছে। যে রিজার্ভ আছে, তা দিয়ে ছয় মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব। উদ্বেগের কিছু নেই। অন্যদিকে রফতানি আয় ও রেমিট্যান্স বাড়ছে। ডলারের বাজার স্বাভাবিক হয়ে আসছে। অল্প কিছুদিনের মধ্যে রিজার্ভ ৪০ বিলিয়ন ডলারের ওপরে উঠে যাবে।
গত বছরের ১৫ সেপ্টেম্বর রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৪৬ দশমিক ৬৩ বিলিয়ন ডলার। আর গত বছরের আগস্টে এই সূচক অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে ৪৮ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক অতিক্রম করেছিল। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্র জানায়, আমদানি বিল পরিশোধের সুবিধার্থে কেন্দ্রীয় ব্যাংক গত বুধবার বেশ কয়েকটি ব্যাংকের কাছে রিজার্ভ থেকে ৭ কোটি ডলার বিক্রি করেছে। সে কারণেই রিজার্ভ ৩৭ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে এসেছে।
গত ৮ সেপ্টেম্বর এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) জুলাই-আগস্ট মেয়াদের ১ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার আমদানির বিল পরিশোধের পর রিজার্ভ ৩৭ দশমিক শূন্য ছয় বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। ২৬ মাস (দুই বছর দুই মাস) পর রিজার্ভ ৩৭ বিলিয়ন ডলারের ঘরে নামে।
এর আগে ২০২০ সালের ২৯ জুলাই রিজার্ভ ৩৭ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে ৩৭ দশমিক ১১ বিলিয়ন ডলারে উঠেছিল। এরপর গত কয়েক দিন তা ৩৭ বিলিয়ন ডলারের ওপরেই অবস্থান করছিল। আমদানি অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় এই রিজার্ভ কমতে কমতে গত ১২ জুলাই ৪০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে আসে। গত দুই মাসে তা আরও কমে ৩৭ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে।
ডলারের বাজারে ‘স্থিতিশীলতা’ আনতে গত অর্থবছরের ধারাবাহিকতায় রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করেই চলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সেই ধারাবাহিকতায় বুধবারও কয়েকটি ব্যাংকের কাছে সরকারি কেনাকাটার জন্য রাষ্ট্রায়ত্ত দুটি ব্যাংকের কাছে ৭ কোটি ডলার বিক্রি করা হয়েছে।
সব মিলিয়ে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের দুই মাস ২১ দিনে (১ জুলাই থেকে ২১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত) রিজার্ভ থেকে ২৮০ কোটি (২ দশমিক ৮০ বিলিয়ন) ডলারের মতো বিক্রি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। অব্যাহতভাবে ডলার বিক্রির কারণেই প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স ও রফতানি আয় বাড়ার পরও রিজার্ভ কমছে বলে জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা।
মুদ্রাবাজার স্বাভাবিক রাখতে ৩০ জুন শেষ হওয়া ২০২১-২২ অর্থবছরে রিজার্ভ থেকে ৭৬৭ কোটি (৭ দশমিক ৬৭ বিলিয়ন) ডলার বিক্রি করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে কখনই রিজার্ভ থেকে এক অর্থবছরে এত ডলার বিক্রি করা হয়নি।
অথচ তার আগের অর্থবছরে (২০২০-২১) বাজারে ডলারের সরবরাহ বাড়ায় দর ধরে রাখতে রেকর্ড প্রায় ৮ বিলিয়ন (৮০০ কোটি) ডলার কিনেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
গত ১২ জুলাই আকু মে-জুন মেয়াদের ১ দশমিক ৯৬ বিলিয়ন ডলার আমদানি বিল পরিশোধের পর রিজার্ভ ৪০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে আসে। এরপর ২০ জুলাই পর্যন্ত রিজার্ভ ৩৯ দশমিক ৮০ থেকে ৪০ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে ওঠানামা করে। জুলাইয়ের শেষে তা কমে ৩৯ দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে আসে।
রেমিট্যান্স বাড়ায় জুলাইয়ের শেষের দিকে রিজার্ভ বেড়ে ৩৯ দশমিক ৭০ বিলিয়ন ডলারে ওঠে। ডলার বিক্রির কারণে তা ফের নিম্নমুখী হয়। ১ সেপ্টেম্বর রিজার্ভ ৩৮ দশমিক ৯১ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে।
অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গত বছরের আগস্টে রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলারের যে মাইলফলক অতিক্রম করেছিল, তাতে বাজার থেকে ডলার কেনার অবদান ছিল।
করোনা মহামারির কারণে ২০২০-২১ অর্থবছর জুড়ে আমদানি বেশ কমে গিয়েছিল। কিন্তু প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স ও রফতানি আয়ে উল্লম্ফন দেখা যায়। সে কারণে বাজারে ডলারের সরবরাহ বেড়ে যায়। সে পরিস্থিতিতে ডলারের দর ধরে রাখতে ওই অর্থবছরে প্রায় ৮ বিলিয়ন ডলার কিনেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
কিন্তু আগস্ট থেকে দেখা যায় উল্টো চিত্র। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করায় লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে আমদানি ব্যয়। রফতানি বাড়লেও কমতে থাকে রেমিট্যান্স। রিজার্ভও কমতে থাকে। বাজারে ডলারের চাহিদা বেড়ে যায়; বাড়তে থাকে দাম। বাজার স্থিতিশীল রাখতে আগস্ট থেকে ডলার বিক্রি শুরু করে বাংলাদেশ ব্যাংক, চলে পুরো অর্থবছর।
সেই ধারাবাহিকতায় চাহিদা মেটাতে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরেও ডলার বিক্রি অব্যাহত রেখেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন