মহামারি করোনার বিপর্যস্ততা কাটিয়ে যখন ঘুরে দাঁড়ানোর পথে বৈশ্বিক অর্থনীতি, ঠিক তখনই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের শুরু। আবারও সঙ্কটে পড়ে বিশ্ব। এর আঁচ এসে পড়ে বাংলাদেশেও। ডলার সঙ্কট ও মূল্যবৃদ্ধি, রেমিট্যান্স প্রবাহে ঘাটতি, জ্বালানি তেল ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি- সব মিলিয়ে কঠিন পরিস্থিরি মধ্যে পড়তে হয়। এ অবস্থায় ডলার সঙ্কট দেখা দেয় দেশে। আমদানি ঠিক রাখতে সরকারকে হাত দিতে হয় রিজার্ভে। এখনো জরুরি পণ্য আমদানিতে রিজার্ভ থেকে ডলার সরবরাহ করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতেই টান পড়ছে রিজার্ভে। একই সঙ্গে রেমিট্যান্স প্রবাহ না বাড়ায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমছে প্রতিনিয়ত। বাংলাদেশ ব্যাংকের সবশেষ হিসাব বলছে, গত বুধবার দিন শেষে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার মজুত (রিজার্ভ) কমে দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৩৮৩ কোটি ৮৯ লাখ ডলার বা ৩৩ দশমিক ৮৪ বিলিয়ন ডলার। এক বছর আগের একই দিনে (২০২১ সালের ডিসেম্বর) ছিল ৪ হাজার ৫৮০ কোটি ২২ লাখ ডলার। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে দেশের রিজার্ভ কমেছে ১ হাজার ১৯৬ কোটি ৩৩ লাখ ডলার। আর এক মাসের ব্যবধানে কমেছে প্রায় দুই বিলিয়ন (১ দশমিক ৯৬) ডলার।
তবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এর মানদণ্ড অনুযায়ী রিজার্ভ গণনা করলে বর্তমান রিজার্ভ থেকে আরও ৮ দশমিক ৪০ বিলিয়ন ডলার বাদ যাবে, এতে ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ দাঁড়াবে ২৫ দশমিক ৪৪ বিলিয়ন ডলারে। আইএমএফ’র মানদণ্ড অনুসারে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে মজুতকৃত রিজার্ভ থেকে রফতানি উন্নয়ন তহবিল (ইডিএফ) থেকে শ্রীলঙ্কাকে দেয়া ঋণ এবং রিজার্ভ থেকে দেশীয় প্রকল্পে অর্থায়নের ব্যয় বাদ যাবে। যদিও সরকার এখন আইএমএফ এবং নিজস্ব অর্থাৎ দুই ধরনের হিসাবই রাখছে।
রিজার্ভ কমার বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক বলেন, আমরাতো মনে করি গ্লোবাল ডিসিশনের ইমপ্যাক্ট আমাদের এখানে এসেছে। শ্রম মন্ত্রণালয়ের যে হিসাব তাতে অনেক লোক দেশের বাইরে গেছেন। তারা যখন বৈধ চ্যানেলের মাধ্যমে টাকা পাঠানো শুরু করবেন তখন রেমিট্যান্স বাড়বে। সামনে রফতানির একটা চ্যালেঞ্জ আছে, আবার ইমপোর্টও কিছু থাকে। সবমিলে হুন্ডিকে যদি কেয়ারফুলি প্রতিহত করা যায় তাহলে রিজার্ভ আবারও ইতিবাচক ধারায় ফিরবে।
রেমিট্যান্স কমায় রিজার্ভে খুব বেশি ডলার বাড়েনি- এ বিষয়ে তিনি বলেন, আমাদের তেল-কয়লা আমদানি করতে হচ্ছে। এসব কারণে ইমপোর্ট একটু বেড়েছে, যেটা মাঝখানে কমেছিল। এতে জরুরি প্রয়োজনে পেমেন্ট বেশি হচ্ছে, রিজার্ভও একটু কমছে। এটা সাময়িক কমা। ৩৪ বিলিয়নের মধ্যেই আমরা তিন-চার মাস ধরে আছি। সামনে ঈদ আছে, উৎসব আছে। রেমিট্যান্স বাড়বে, রিজার্ভও ইতিবাচক অবস্থানে যাবে। ব্যাংকগুলোও এলসি পরিশোধ করতে পারবে, তখন রিজার্ভ থেকে কোনো ডলার খরচ করতে হবে না উল্লেখ করেন মেজবাউল হক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হালনাগাদ প্রতিবেদন বলছে, চলতি বছরের জুন শেষে দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৪ হাজার ১৮২ কোটি ৬৭ লাখ ডলার বা ৪১ দশমিক ৮৩ বিলিয়ন ডলার। যেটা বুধবার (২৮ ডিসেম্বর) দিন শেষে দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৩৮৩ কোটি ৮৯ লাখ ডলার বা ৩৩ দশমিক ৮৪ বিলিয়ন ডলারে। আর চলতি বছরের নভেম্বর অর্থাৎ এক মাস আগে রিজার্ভ ছিল ৩ হাজার ৫৮০ কোটি ৮৭ লাখ ডলার বা ৩৫ দশমিক ৮১ বিলিয়ন ডলার। হিসাব বলছে, চলতি ২০২২-২০২৩ অর্থবছরের ছয় মাসে রিজার্ভ কমেছে ৬০১ কোটি ৮০ লাখ ডলার। ২০২০-২০২১ অর্থবছরের ডিসেম্বর রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ছিল ৪ হাজার ৫৮০ কোটি ২২ লাখ ডলার বা ৪৫ দশমিক ৮০ বিলিয়ন ডলার।
এদিকে চলতি বছরের শুরু থেকেই দেশে ব্যাপকহারে ডলার সঙ্কট দেখা দেয়। চাপ সামাল দিতে বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকার বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করে। এমন পরিস্থিতিতে সরকারের আমদানি দায় পরিশোধে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ২০২২-২০২৩ অর্থবছরের ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করা হয় ৬০৫ কোটি মার্কিন ডলার। যেটা ২০২১-২০২২ অর্থবছরের পুরো সময়ে রেকর্ড ৭৬২ কোটি ১৭ লাখ ডলার বিক্রি করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। এদিকে ডলার সঙ্কট কাটাতে আমদানিতে লাগাম টানে বাংলাদেশ ব্যাংক। বিলাসী পণ্য আমদানিতে এলসি খোলা বন্ধ করে দেয়া হয়। মোটরকার, হোম অ্যাপ্লায়েন্স হিসেবে ব্যবহৃত ইলেকট্রিক্যাল এবং ইলেকট্রনিক্স সামগ্রীর আমদানি ঋণপত্র (এলসি) খোলার ক্ষেত্রে ন্যূনতম ৭৫ শতাংশ নগদ মার্জিন সংরক্ষণ করার কথা বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। একই সঙ্গে অতি জরুরি পণ্য ছাড়া সব পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে কমপক্ষে ৫০ শতাংশ নগদ মার্জিন সংরক্ষণের কথা বলা হয়।
অন্যদিকে কড়াকড়ি আরোপের পরও আমদানির চেয়ে রফতানি বাড়ানো যাচ্ছে না। তবে আমদানি-রফতানির ব্যবধান ধীরে ধীরে কমে আসছে। চলতি ২০২২-২০২৩ অর্থবছরের শুরু থেকে বড় অঙ্কের বাণিজ্য ঘাটতিতে পড়ে দেশ। গত জুলাই থেকে অক্টোবর-টানা চার মাস বাণিজ্য ঘাটতি দেখা দেয়। অর্থবছরের প্রথম চার মাসে মোট বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯৫৮ কোটি ৭০ লাখ মার্কিন ডলারে।
রিজার্ভের অন্যতম উৎস এবং অর্তনীতির গুরুত্ববহ রেমিট্যান্সও কমছে। ২০২২-২০২৩ অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে (জুলাই ও আগস্ট) টানা ২ বিলিয়ন ডলার করে রেমিট্যান্স এসেছিল দেশে। এর পরের মাস সেপ্টেম্বর থেকে টানা তিন মাস দেড় বিলিয়ন ডলারের ঘরে আসে রেমিট্যান্স। সবশেষ নভেম্বর মাসে রেমিট্যান্স এসেছে ১৫৯ কোটি ৪৭ লাখ ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় (প্রতি ডলার ১০৭ টাকা হিসাবে) ১৭ হাজার ৬৩ কোটি টাকার বেশি। এদিকে চলতি মাস ডিসেম্বরের প্রথম ২৩ দিনে রেমিট্যান্স এসেছে ১২৮ কোটি ৪১ লাখ ডলার। আর এসব কারণে চাপ বাড়ছে বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বা রিজার্ভের ওপর।
গত ২০২১-২০২২ অর্থবছরে ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে দেশে মোট ২ হাজার ১০৩ কোটি ১৭ লাখ (২১ দশমিক ৩ বিলিয়ন) মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স এসেছিল। তার আগের অর্থবছরের চেয়ে ১৫ দশমিক ১১ শতাংশ কম ছিল এটি। ২০২০-২০২১ অর্থবছরে দুই হাজার ৪৭৭ কোটি ৭৭ লাখ (২৪ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন) ডলারের রেমিট্যান্স পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা বাংলাদেশি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন