উন্নয়নশীল দেশে আমদানি-রফতানির জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। রিজার্ভ তলানিতে নেমে যাওয়ায় একশ ভাগ শিক্ষিতের আমদানিনির্ভর দেশ শ্রীলংকাকে ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখে পড়তে হয়েছিল। বাংলাদেশও আমদানিনির্ভর। গত এক থেকে দেড় বছর ধরে রিজার্ভের ঊর্ধ্বগতির সুখবর নিয়মিত প্রচার করা হচ্ছে গণমাধ্যমে। প্রবাসী শ্রমিকের পাঠানো রেমিট্যান্স আর পোশাক রফতারিতে আসা ডলারের হিসেবে প্রতিদিন ফলাও করে প্রচার করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। অর্থমন্ত্রণালয় ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দায়িত্বশীলদের হাবভাব দেশের রিজার্ভের পরিমাণ পাহাড়ের চ‚ড়া স্পর্শ করতে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকে রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলার এবং তা ৫০ বিলিয়ন ছুঁতে যাচ্ছে প্রচার করা হয়। দায়িত্বশীল মন্ত্রী, আমলাদের রিজার্ভ নিয়ে আহ্লাদের শেষ নেই। কিন্তু আইএমএফের ঋণের আবেদন করার পর রিজার্ভের বিষয়টি কাজীর গরু কেতাবের হিসেবের বদলে গোয়ালে দেখা শুরু হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের ওয়েবসাইটে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দেখানো হয় ৩৪ দশমিক ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। কিন্তু আইএমএফের প্রতিনিধিরা ঢাকা এসে নেট রিজার্ভের পরিমাণ জানতে চান। গত বুধবার বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার জানান, গ্রস রিজার্ভ ৩৪ দশমিক ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। আমাদের কয়েকটি ফান্ডে প্রায় ৮ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ আছে। সেখান থেকে ৮ বিলিয়ন ডলার বাদ দিলে নেট রিজার্ভ চলে আসবে ২৬ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার। প্রশ্ন হচ্ছেÑ দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে প্রকৃত রিজার্ভের পরিমাণ কত?
জানতে চাইলে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এবং বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডির বোর্ড অব ট্রাস্টির সদস্য ড. দেবপ্রিয় ভট্টচার্য সম্প্রতি বলেন, রিজার্ভের পরিমাণ যা বলা হচ্ছে, তা দেশের অর্থনীতির জন্য বিপদ সঙ্কেত। রিজার্ভ কমে যাওয়ায় প্রয়োজন বা চাহিদা অনুযায়ী পণ্য আমদানি প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়ছে। আরো পড়বে। একইসঙ্গে এটি টাকার বিনিময় মূল্যকে আরো দুর্বল করে দিচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকৃত রিজার্ভ কত তা এখনো পরিষ্কার নয়। কারণ দেশের কিছু প্রতিষ্ঠানের ভুল তথ্য দেয়ার বাতিক রয়েছে। ফলে তাদের দেয়া সব তথ্য বিশ্বাস যোগ্যতা পায় না। পরিসংখ্যান ব্যুরোর বিভিন্ন হিসেবে এমনকি আদমশুমারীর দেয়া জনসংখ্যার হিসেবে মানুষ বিশ্বাস রাখতে পারে না। প্রতিষ্ঠান প্রকৃত তথ্য লুকিয়ে রেখে মনগড়া তথ্য দেয়ার নজির রয়েছে। এদিকে এতোদিন মানুষ কেন্দ্রীয় ব্যাংকে দেয়া তথ্যে ৪৮ বিলিয়ন, ৫০ বিলিয়ন রিজার্ভের গল্প শুনেছে। কিন্তু এখন শুনছে ২৬ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলারের গল্প। কেউ কেউ বলছেন, আইএমএফের চাপে যে হিসেব দেখানো হচ্ছে প্রকৃতপক্ষে সে পরিমাণ ডলার জমা রয়েছে কিনা সন্দেহ রয়েছে। অথচ কোনো কিছুর পরিকল্পনা করতে গেলে প্রকৃত তথ্য জানা অপরিহার্য। প্রকৃত তথ্য, পরিসংখ্যান লুকিয়ে রেখে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে তা বুমেরাং হয়ে যেতে পারে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, রিজার্ভের প্রকৃত চিত্র জানানো উচিত।
বছর খানেক ধরে ধারাবাহিকভাবে কমছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসেবে এখন সাড়ে ৩ হাজার কোটি ডলার। আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের (আইএমএফ) মানদÐ বিবেচনায় এ অঙ্ক দাঁড়াবে ২ হাজার ৬০০ কোটি ডলার (২৬ বিলিয়ন ডলার)। অন্তত ৩ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর রিজার্ভ জমা রাখতে হয়। গত অর্থবছরের ডিসেম্বর মাসে আমদানিতে খরচ হয়েছে ৮৪৩ কোটি ৬৭ লাখ ডলার (৮ দশমিক ৪৪ বিলিয়ন)। আর গত নভেম্বরে পণ্য আমদানিতে খরচ হয়েছে ৭৮৫ কোটি ৪৬ লাখ (৭ দশমিক ৮৫ বিলিয়ন) ডলার। নভেম্বরের হিসেবে আগামী তিন মাসে ব্যয় হবে প্রায় ২৩ দশমিক ৫৫ বিলিয়ন ডলার। যদিও সরকার এখন বিলাসবহুল পণ্য আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। আরো বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমদানিতে লাগাম টেনেছে। এমনকি সরকারি কর্মকর্তাদের সরকারি খরচে বিদেশভ্রমণেও নিষেধাজ্ঞা প্রদান করা হয়েছে। আশা করা যাচ্ছে, বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম বাড়লেও আমদানিতে লাগাম টেনে সরকার প্রতিমাসে ৭ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে ব্যয় রাখতে পারবে।
সে হিসেবে আইএমএফের শর্ত মেনে মাত্র সাড়ে ৩ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর রিজার্ভ আছে। একদিকে কমছে রিজার্ভ অন্যদিকে ব্যাংকগুলোতে ডলার সঙ্কট বদলে দিচ্ছে সব হিসাব-নিকাশ। অবশ্য রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব, বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম ওঠানামা করা, আমদানির তুলনায় রফতানি ও রেমিট্যান্স কমে যাওয়া, ডলারের অস্থির বাজারসহ বিভিন্ন কারণে বাংলাদেশের রিজার্ভে চাপ পড়েছে। তবে দেশের রিজার্ভ বর্তমানে কত, এ নিয়ে বিভ্রান্তি দেখা দিয়েছে। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার গত বুধবার বলেছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার নেট রিজার্ভ ২৬ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংকের ওয়েবসাইটে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দেখানো হচ্ছে ৩৪ দশমিক ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এখান থেকে ৭০০ কোটি ডলার দিয়ে গঠন করা হয়েছে রফতানি উন্নয়ন তহবিল বা ইডিএফ। আবার রিজার্ভের অর্থ দিয়ে গঠন করা হয়েছে লং টার্ম ফান্ড (এলটিএফ), গ্রিন ট্রান্সফরমেশন ফান্ড (জিটিএফ)। বাংলাদেশ বিমানকে উড়োজাহাজ কিনতেও রিজার্ভ থেকে সোনালী ব্যাংককে অর্থ দেয়া হয়েছে। আবার পায়রা বন্দরের রাবনাবাদ চ্যানেলের খনন কর্মসূচিতেও রিজার্ভ থেকে অর্থ দেয়া হয়েছে। এসব খাতে সব মিলিয়ে ব্যবহৃত হয়েছে ৮০০ কোটি ডলার। ফলে প্রকৃত রিজার্ভের পরিমাণ ২৬ বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি। এদিকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের হিসাবায়ন পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনতে বলেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) প্রতিনিধিদল। আইএমএফ বলেছে, রিজার্ভ থেকে যেসব বিনিয়োগ করা হয়েছে, তা বাদ দিয়ে রিজার্ভের প্রকৃত হিসেব করতে হবে। কারণ, রিজার্ভের এসব অর্থ চাইলেই ফেরত পাওয়া যাবে না। জরুরি প্রয়োজনে ব্যবহার করা যাবে না। এ ছাড়া বাংলাদেশ অবকাঠামো উন্নয়ন তহবিলের (বিআইডিএফ) কোনো প্রকল্পে রিজার্ভ থেকে অর্থায়ন না করতে বলেছে সংস্থাটি। এদিকে দেশে আসলে কত রিজার্ভ আছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা বলেন, রিজার্ভের অঙ্ক যা বলা হচ্ছে তার পুরোটা নেই। এর মধ্যে বিভিন্ন হিসেবে আছে। তবে মূল কত বিলিয়ন ডলার আছে সেটি ওই কর্মকর্তা জানাতে রাজি হননি।
এদিকে প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদবিষয়ক উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী সম্প্রতি ব্যবসায়ীদের এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, আগামী ৬ মাসেও রিজার্ভ বাড়ার সম্ভাবনা নেই। আমাদের হাতে টাকা নেই। সামনে কি হবে জানি না।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ডলার সঙ্কট আর রিজার্ভ কমে যাওয়ায় শঙ্কা বাড়ছে অর্থনীতিতে। এখন যে রিজার্ভ আছে তা কোনোভাবেই পর্যাপ্ত বলা যাবে না। এখনো সময় আছে। চেষ্টা করলে সঙ্কট সমাধান হবে। রিজার্ভ সঙ্কট বা অন্তরায়গুলো ধরে ধরে কাজ করে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে হবে। একই সঙ্গে রিজার্ভ বাড়ানোর জন্য সবধরণের অর্থ পাচার ঠেকাতে হবে। যেসব অর্থ দেশ থেকে চলে গেছে তা ফিরিয়ে আনার কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। পাশাপাশি এমন পরিস্থিতি থেকে ঘুরে দাঁড়াতে ভরসার জায়গা রেমিট্যান্স ও রফতানি। তবে ঋণপত্র খুলতে না পারায় বিপাকে আছেন আমদানিকারকরা। সঙ্কট সামনে রেখে যেন কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান অবৈধ সুযোগ নিতে না পারে সেদিকে নজর রাখার পরামর্শ বিশ্লেষকদের। একই সঙ্গে রেমিট্যান্স যোদ্ধারা যেন বৈধ উপায়ে দেশে টাকা পাঠায় সেদিকে আরো নজর দিতে হবে।
সূত্র মতে, রেকর্ড আমদানি দায় ও বিদেশি ঋণ পরিশোধের জন্য প্রায় প্রতিদিনই রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আর তাই পরিস্থিতি সামলাতে সরকার আইএমএফের কাছে ঋণ চেয়েছে। আগামী বছরের ফেব্রæয়ারিতে ঋণের প্রথম কিস্তি পাওয়ার খবর দিয়েছে সংস্থাটি।
বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ আবাসিক মিশনের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, বর্তমান রিজার্ভ আমাদের মত আমদানিনির্ভর এবং রেমিট্যান্সের ওপর নির্ভরশীল অর্থনীতির জন্য পর্যাপ্ত নয়। এমনকি দেশে রিজার্ভ আসলে কত আছে তাও সঠিকভাবে বলা যাচ্ছে না। কারণ রফতানি উন্নয়ন তহবিল বা এক্সপোর্ট ডেভেলপমেন্ট ফান্ডে দেয়া ডলারও এই হিসেবের মধ্যে। ইডিএফ ফান্ডে দেয়া রিজার্ভ ডলার আকারে ফেরত আসার সম্ভাবনা কম। এই ডলার টাকা হিসেবে আসার সম্ভাবনাই বেশি। আর টাকা এলেও রিজার্ভ হিসেবে কাউন্ট হবে না।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ফেলো প্রফেসর ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, এখন ডলারের সঙ্গে টাকার যে মান সেটা বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করতে হবে। দেখা গেছে, বাজারে ডলারের কয়েকটি রেট চলছে। এগুলো সমন্বয় করতে হবে। যদি ডলারের বিপরীতে টাকার দাম কমে যায় আর পণ্য আমদানি করতে গিয়ে পণ্য মূল্য বেড়ে যায় তাহলে প্রয়োজনে ভ্যাট-ট্যাক্স কমিয়ে দিতে হবে। প্রয়োজনে কিছু জায়গায় ভর্তুকি দিতে হবে। তাহলে কিছুটা সঙ্কট কাটতে পারে। ইনফরমাল চ্যানেলের ডলার তখন ফরমাল চ্যানেলে চানানোর জন্য সবাই আগ্রহী হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও অর্থনীতিবিদ প্রফেসর আবু আহমেদ বলেন, বাজারে ডলার নেই বলে বাংলাদেশ ব্যাংক বাংলাদেশি মুদ্রার মান ধরে রাখতে ডলার বিক্রি করছে। তবে রিজার্ভ কিন্তু দিন দিন কমে যাচ্ছে। আমাদের ডলারের প্রধান উৎস হচ্ছে রেমিট্যান্স আর রফতানি আয়। এগুলো কমছে। এছাড়া অতি ধনী লোকরা বিদেশে কার্ব মার্কেটের (খোলাবাজার) মাধ্যমে ডলার নিয়ে নিচ্ছে। এদেশ থেকেও পাচার হচ্ছে। হুন্ডির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় গিয়ে হলেও রেমিট্যান্স বৈধ উপায়ে আনতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক জিএম আবুল কালাম আজাদ বলেন, সঙ্কট কাটাতে আমাদের একটি দক্ষ টিম কাজ করছে। তারা সার্বক্ষণিক সব কিছুর ওপর নজর রাখছে। আশা করি, সঙ্কট কাটিয়ে উঠতে পারব। ইতোমধ্যে নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে রেমিট্যান্সের গতি ভালো। মুখপাত্র বলেন, রিজার্ভ কমেছে ঠিক। তবে ভবিষ্যতে আবার বাড়বে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন