বুধবার, ০১ মে ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১, ২১ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

রিজার্ভ বাড়াতে রেমিট্যান্সে প্রণোদনা বাড়াতে হবে

কাজী কামরুল হাসান শামীম | প্রকাশের সময় : ১৯ নভেম্বর, ২০২২, ১২:০৫ এএম

রিজার্ভ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা সমালোচনা চলছে। রিজার্ভের নিম্নমুখী গতি ভাবিয়ে তুলেছে সবাইকে। কী হতে যাচ্ছে অর্থনীতির অবস্থা? সাথে রিজার্ভের অবস্থান কেমন হবে? যা রিজার্ভ আছে তা দিয়ে দেশ এগিয়ে যেতে পারবে কিনা? বর্তমান রিজার্ভ দিয়ে কত মাস আমদানি ব্যয় মেটাতে পারবে? তারপর কী হবে? এই সব প্রশ্ন মানুষের মনে। বর্তমানে যা রিজার্ভ মজুদ আছে, তা দিয়ে ৫-৬ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব। তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর মতো সক্ষমতার রিজার্ভকে আর্দশ রিজার্ভ বা ঝুঁকিমুক্ত হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বর্তমানের রিজার্ভকে আইএমএফও ঝুঁকিপূর্ণ মনে করছে না। তবে রিজার্ভের যে পতনগতি তা রুখতে না পারলে উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।

এখন কথা হলো, আমদানি ব্যয় না মিটিয়ে রিজার্ভের ধস রোধ করা সম্ভব নয়। আমদানি দেনা অবশ্যই পরিশোধ করতে হবে। আইএমএফের কাছে ঋণ গ্রহণের আবেদনও শেষ কথা নয়। আইএমএফ ঋণ প্রদান করলেই যে সমস্যার সমাধান হবে তাও নয়। রিজার্ভের স্থিতিশীলতা রক্ষা করার জন্য রেমিট্যান্স আহরণ বৃদ্ধি করা ছাড়া কোনো উপায় নেই। দেশের অর্থনীতিকে মজবুত করার জন্য রিজার্ভ মজবুত রাখতে হবে। শক্তিশালী রিজার্ভ ছাড়া উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা হতে মুক্তি পাওয়াও সম্ভব না। বর্তমানে বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক সংকট চলছে। বিভিন্ন দেশের মুদ্রার ব্যাপক দরপতন হচ্ছে। মুদ্রাস্ফীতিও ঘটছে দেশে দেশে। বৈশ্বিক এই মহাসংকটের মুহূর্তে নিজের দেশকে সংকট মুক্ত রাখতে দেশের অর্থনীতি সুরক্ষায় রিজার্ভ গড়ে তোলার কার্যকর পদক্ষেপ জরুরি। নতুবা সমস্যা যত ঘনীভূত হবে সমাধানের পথ ততই কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। তাই রিজার্ভের স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য অধিক হারে রেমিট্যান্স আহরণ করতে হবে। সাথে রপ্তানি আয়ও বাড়ানোর দিকে মনোযোগ দিতে হবে।

রিজার্ভের ধস ঠেকাতে ও রেমিট্যান্স আহরণ বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে গত ৬ নভেম্বর এসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) ও ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস এসোসিয়েশনের (বাফেদা) যৌথ বৈঠকের পর ঘোষণা দেয় এখন হতে প্রবাসীরা বিনাচার্জে রেমিট্যান্স প্রেরণ করতে পারবে। রিজার্ভধসের এই মুহূর্তে এই ঘোষণাটাও ধন্যবাদ পাবার দাবি রাখে। অন্তত কিছু সংখ্যক মানুষ বিনাচার্জে রেমিট্যান্স প্রেরণ করতে পারবে এবং অনেকে বৈধ চ্যানেলমুখী হবে। আপাতত নাই মামার চেয়ে কানা মামাই ভালো। আসল কথা হলো, বিনা চার্জে যে রেমিট্যান্স প্রেরণের ঘোষণা দেয়া হলো সেটার সুবিধা ভোগ করতে পারবে কিছু সংখ্যক প্রবাসী। কারণ, বিদেশে যে সমস্ত দেশে জনতা ব্যাংকের শাখা আছে, শুধুমাত্র সেখানে কার্যকর হবে এই সুবিধা। মধ্যপ্রাচ্যের মধ্যে সংযুক্ত আরব আমিরাতে জনতা ব্যাংকের হাতে গোনা কয়েকটি শাখা রয়েছে। বেশিরভাগ দেশে জনতা ব্যাংকের কোনো শাখাই নেই। তাই ইচ্ছে করলেও অনেকে এই সুবিধা ভোগ করতে পারবে না। শুধুমাত্র ব্যাংকে বিনাচার্জে রেমিট্যান্স পাঠাতে পারবে প্রবাসীরা এই ঘোষণা দিয়ে বসে থাকলে হবে না। দেখতে হবে সব দেশে, সবখানে জনতা ব্যাংক বা বাংলাদেশ ব্যাংক অনুমোদিত কোনো ব্যাংক আছে কিনা? বিকল্প কোনো উপায় আছে কিনা? যদি না থাকে, এটা হবে আইওয়াশ বা প্রবাসীদের সাথে প্রতারণা বা দেশের রিজার্ভকে ধ্বংস করার একপ্রকার তালবহানা। বাংলাদেশ সরকার বা বাংলাদেশ ব্যাংক অনুমোদিত ব্যাংক বা ব্যাংকের শাখা না থাকার কারণে রেমিট্যান্সের বৈধ পথের গতি তেমন একটা বাড়বে না। আর দূর দূরান্ত হতে মানুষ গিয়ে যেখানে শাখা আছে সেখানে রেমিট্যান্স প্রেরণ করতে আগ্রহী হবে না। অনাগ্রহ প্রকাশ করবে নি¤œ আয়ের মানুষ। কারণ, তারা বিনাচার্জে রেমিট্যান্স প্রেরণ করতে গিয়ে যাতায়াত বাবদ যেই খরচ হবে তার হিসাব অবশ্যই করবে। তাই রাষ্ট্রের উচিত হবে, প্রতিটি দেশের মধ্যে অবস্থিত মানি এক্সচেঞ্জগুলোর সাথে চুক্তি করা, যাতে প্রতিটি দেশের প্রবাসীরা বিনাচার্জে রেমিট্যান্স প্রেরণের সুবিধা ভোগ করতে পারে। মানি এক্সচেঞ্জ এবং ব্যাংকগুলোর সাথে যদি রাষ্ট্র চুক্তি করতে পারে তাহলে রেমিট্যান্স প্রবাহও দ্রæত বৃদ্ধি পাবে এবং অবৈধ চ্যানেল বিমুখ হবে প্রবাসীরা। সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ায় অগ্রণী ব্যাংকের দুইটি এক্সচেঞ্জ হাউজ, যুক্তরাষ্ট্রে সোনালী ব্যাংকের সোনালী এক্সচেঞ্জ ইনকরপোরেটেড, যুক্তরাজ্য সোনালী ব্যাংকের ফরেন সাবসিডিয়ারি কোম্পানি এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতে জনতা ব্যাংকের শাখাগুলো রেমিট্যান্স আহরণে ভালো ভূমিকা পালন করছে। তাই যত দ্রæত সম্ভব প্রতিটি দেশে অবস্থিত মানি এক্সচেঞ্জগুলোর সাথে চুক্তি সম্পাদন করে বিনাচার্জে রেমিট্যান্স প্রেরণের নিশ্চয়তা প্রদান করতে পারলে এবং সোনালী, জনতা, অগ্রণী ব্যাংক বা বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদিত ব্যাংকের শাখা চালু করতে পারলে বিপুল রেমিট্যান্স আহরণ করতে পারবে দেশ। রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়াতে প্রণোদনা বাড়িয়ে দিতে হবে। প্রণোদনা যদি ৪-৫% এ নিয়ে যাওয়া যায় তবে অধিকহারে প্রবাসীরা বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রেরণ করবে। অবৈধ চ্যানেল বন্ধ করার জন্য শুধুমাত্র লোক দেখানো পদক্ষেপ না নিয়ে কার্যকর ব্যবস্থা নিয়ে কাজ করতে হবে। দেখতে হবে, বৈধ চ্যানেলের টাকার রেট এবং অবৈধ চ্যানেলের টাকার রেটের তারতম্য। প্রণোদনাসহ যদি বৈধ চ্যানেলের টাকার রেট পার্থক্য না থাকে তাইলে প্রবাসীদের মধ্যে যারা অবৈধ চ্যানেল ব্যবহার করে তারাও বৈধ চ্যানেলমুখী হবে। আর যারা বৈধ চ্যানেল ব্যবহার করে রেমিট্যান্স প্রেরণ করে দেশে তারা যদি প্রবাস ফেরত হবার পর রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা পাবার নিশ্চয়তা পায়, তাহলে প্রবাসীরা তাদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে অবৈধ চ্যানেল পরিত্যাগ করে বৈধ চ্যানেলমুখী হবে। বৈশ্বিক অর্থনীতির সংকটের এই মুহূর্তে যদি বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রেরণকারীদের বিশেষ পেনশনের আওতায় আনার ঘোষণা দেয়া যায় এবং শতভাগ কার্যকর করার নিশ্চয়তা প্রদান করা যায় তাহলে অবৈধ চ্যানেল ব্যবহারী সকল প্রবাসী তাদের নিশ্চিত এবং সোনালী ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখে বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রেরণ করবে এবং দেশের রিজার্ভের মাত্রাকে গতিশীল করে তুলবে। ধসে পড়া এই রিজার্ভ ৫০+ বিলিয়ন ডলারে নিয়ে যেতে প্রবাসীদের বেশি সময় লাগবে না। দেশের অর্থনীতির আকাশ হতে সংকটের কালো মেঘ সরে যেতে বাধ্য হবে।

বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স আহরণ করে রিজার্ভ বাড়ানোর জন্য নি¤েœর কয়েকটি পরামর্শকে যদি রাষ্ট্র গুরুত্বের সাথে আমলে নিয়ে শতভাগ কার্যকর করে, তাহলে রিজার্ভ নিয়ে হতাশায় ভুগতে হবে না আমাদের দেশকে। প্রথমত, বিনাচার্জে রেমিট্যান্স আহরণের জন্য সকল দেশে অবস্থিত মানি এক্সচেঞ্জগুলোর সাথে চুক্তি করা বা বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদিত শাখা চালু করা। দ্বিতীয়ত, প্রণোদনা বাড়িয়ে ৪-৫% এ উন্নীত করা। তৃতীয়ত, বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রেরণকারীদের জন্য পেনশন চালু করা। এই কয়েকটি পরামর্শ কার্যকর করা হলে রেমিট্যান্স প্রবাহে ঢেউ উঠবে।

লেখক: সাবেক কার্যনির্বাহী সদস্য, প্রবাসী সাংবাদিক সমিতি (প্রসাস), সংযুক্ত আরব আমিরাত।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন