সকল প্রশংসা একমাত্র আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের জন্য এবং তার সর্বশ্রেষ্ঠ রাসূল (স.) এর উপর অগণিত দরূদ ও সালাম। মুমিনদের সম্পদ মাত্র দুইটি জিনিস। আল ক্বোরআন আর নবীজীবন। এসব নিয়েই ইসলাম। যার সবটুকু জুড়ে রয়েছে ইক্কামতে দ্বীনের জন্য কঠোর সংগ্রাম। এ ধূলার ধরণীতে নবীজীবনের দু’টি অধ্যায়-মক্কী জীবন ও মদনী জীবন। যথাক্রমে ১৩ বছর ও ১০ বছর। মক্কী যুগ হচ্ছে ঈমানের যুগ। মক্কী সূরাগুলোতে তাই তাওহীদ এবং রেসালতের দিকে আহ্বান। তাই মক্কী যুগ হচ্ছে দাওয়াত ও তাবলীগের যুগ। আর মদনী সূরাগুলো এবং মদনী যুগ হচ্ছে হুকুম আহকাম, আদেশ নিষেধ, স্বদেশ বিদেশ, ঘর-সংসার মোয়ামালাত, মোয়াশারাত, আচার বিচার, ব্যবসা-বানিজ্য এবং ক্বোরআন ভিত্তিক শাসন ব্যবস্থা এবং রাষ্ট্রীয় কাঠামোর তৈরির যুগ। মদনী যুগ তাই অনিবার্যভাবেই জুলুমের উৎখাত, শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা এবং ইনসাফ কায়েমের যুগ। জালিমের মোকাবিলার জন্য মজলুমের রুখে দাঁড়াবার যুগ। সুতরাং মদনী যুগ হচ্ছে পবিত্র ক্বোরআন ভিত্তিক জিহাদ ও ক্বিতালের যুগ। মদনী যুগের দশটি বছরে ইসলামের নবীকে তাই ২৭টি জিহাদ করতে হয়েছে কাফের, মুশরিকদের সাথে।
যে ক্বোরআন পড়েছে এবং সার্বিকভাবে পরিপূর্ণভাবে বুঝেছে, সে কখনও জিহাদ ও ক্বিতালকে ত্যাগ করতে পারে না, জিহাদ সম্পর্কে নিরুৎসাহিত হতে পারে না। তবে যে ক্বোরআনের দাবি প্রত্যাখান করে দুভার্গ্যরে তিলক কপালে এঁটেছে সে জিহাদের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা কিভাবে বুঝবে? বস্তুত ক্বোরআনকে বুঝতে হলে, ক্বোরআন যাঁর ওপর নাযিল হয়েছিল সেই পবিত্রতম এবং শুদ্ধতম মানুষটিকে সার্বিকভাবে এবং সামগ্রিকভাবে পরিপূর্ণভাবে বুঝতে হবে। শুধু তাই নয়, তিনি কিভাবে তাঁর প্রাণপ্রিয় সাহাবীদেরকে পবিত্র ক্বোরআন শিক্ষা দিয়েছেন এবং সাহাবায়ে কেরাম কিভাবে নবীজীর সেই শিক্ষার ওপর দীক্ষা নিয়ে কলিজার খুন দিয়ে নিজেদের জীবনে তা পরিপূর্নভাবে বাস্তবায়িত করেছেন তা বুঝতে হবে। তারাতো আমাদের মতো সাধারণ মানুষ ছিলেন। কিন্তু আল্লাহপাকের কাছে তাঁদের দারাজাত এত বুলন্দ হওয়ার একটিই মাত্র কারণ, তাঁরা আল্লাহর রাসূল (স.)- এর প্রতিটি কথা এবং প্রতিটি কাজকে নিজেদের প্রাণের চেয়েও বেশী ভালবাসতেন।
সাহাবায়ে কেরাম একদা বারগাহে নবুয়তে দরখাস্ত করলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ (সা:), আইয়্যুল আমালি আফযালু? বান্দাহর কোন আমলটি সর্বশ্রেষ্ঠ? নবীজী ইরশাদ করলেন, আল ঈমানু বিল্লাহি ওয়া রাসূলিহী। আল্লাহ এবং আল্লাহর রাসূলের ওপর ঈমান আনা। অত:পর প্রশ্ন করা হল- তারপর কোন আমলটি শ্রেষ্ঠ? হুজুর ইরশাদ করলেন, আল জিহাদু ফি সাবিলিল্লাহ। আল্লাহর জন্য আল্লাহর পথে জিহাদ করা। তারপর কোন আমলটি শ্রেষ্ঠ? নবীজি ফরমান, আলহাজ্জুম মাবরুব। সেই হজ যা আল্লাহর দরবারে কবুল হয় (বুখারি মুসলিম)। সুতরাং ঈমান আনার পরবর্তী কাজটি হচ্ছে জিহাদ। মহান আল্লাহ এই জিহাদ মোমেনদের জন্য ফরজ করে দিয়েছেন। আল্লাহ সোবহানাহু তায়ালা এবং তাঁর রাসূল (স.) যে ইবাদাতকে যে নামে অভিহিত করেছেন তাকে সে নামে অভিহিত করাই বাঞ্ছনীয়। ক্বোরআন মজীদ এবং হাদীস শরীফে প্রতিটি ইবাদতের সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা, প্রক্রিয়া এবং পদ্ধতি আলোচনা করা হয়েছে।
যেমন-ক্বোরআন মজীদ এবং হাদীস শরীফে যাকে জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ এবং ক্বিতাল ফী সাবিলিল্লাহ বলা হয়েছে, তা একটি মহিমান্বিত ইবাদত, যার বিনিময় জান্নাত ছাড়া আর কিছুই নয়। আল্লাহপাক যে ইবাদতকে জিহাদ ফী সাবিলিল্লাহ করে অভিহিত করেছেন, সে ইবাদত পালনে তীর ধনুক, তরবারি, ঘোড়া, বন্দুক, গোলাবারুদ, কামান, জঙ্গীবিমান, রকেট, মিসাইল ইত্যাদি যুগোপযোগী সাজ-সরঞ্জামের প্রয়োজন হয় এবং ইসলাম-বিরোধী কাফের শক্তির সঙ্গে মুসলমানদের যুদ্ধে মোকাবিলা হয়। এই যুদ্ধের পর যদি মুসলিম বাহিনীর কোন সদস্য জীবিত থাকে তবে তাকে গাজী আর মৃত্যুবরণ করলে তাকে শহীদ বলা হয়। এই নিয়মে যারা জিহাদ করবে, জিহাদের সকল ফজিলত শুধু তাদেরই ভাগ্যে জুটবে, এর ব্যতিক্রম নয়। অতএব কেউ যদি বলে, আরবী অভিধানে আমি দেখেছি, জিহাদ অর্থ কষ্ট বরণ করা ও চেষ্টা করা। সে কষ্ট ও সে চেষ্টা যে ধরনেরই হোক না কেন। যথা সত্য কথা বলার চেষ্টা করা ও হালাল রুজি কামাইয়ের কষ্ট করা। মহিলাদের গর্ভধারণ ও বাচ্চা প্রতিপালনের কষ্ট, ভাত পাকান ও কাপড় ধোয়ার কষ্ট, অসুখ-বিসুখের কষ্ট সহ্য করা ইত্যাদি সবই জিহাদ। যে কারণে বক্তা তার বক্তব্যকে জিহাদ বলে চালিয়ে দিচ্ছে, তার লেখাকে জিহাদ বলছে, শ্রমিক তার মেহনতকে জিহাদ বলে অভিহিত করেছে।
তবে হ্যাঁ, হাদীস শরীফে রূপক অর্থে একটি ইবাদাতের ‘সমতুল্য’ সওয়াব প্রদানের কথা বলা হয়েছে। যেমন-জালেম বাদশাহ’র সামনে হক কথা বলাটা জিহাদের সমতুল্য। বৃদ্ধা মায়ের খেদমত আঞ্জাম দেওয়া জিহাদের সমপরিমাণ সওয়াব। নাফসের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যুদ্ধ করা সবোত্তম জিহাদের সমতুল্য। বৃদ্ধ পিতার দিকে মহব্বতের সঙ্গে একবার দেখলে সন্তানের আমলনামায় একটা কবুল হজ্জ্বের সওয়াব লেখা হবে। এ ধরনের আরও অনেক উদাহরণ আছে। এগুলো হচ্ছে শুভ সংবাদ। উৎসাহ প্রদানের জন্য। এর দ্বারা শরীয়তের মূল হুকুম যেমন-উপরোল্লিখিত হজ্জ্বের ফরজ রহিত হয়ে যায় না। চার মাযহাবের প্রাত:স্মরণীয় সকল ইমামরা জিহাদের অর্থ ও ব্যাখায় সর্বসম্মতিক্রমে লিখেছেন-বাযলুল জুহদি ফী ক্বিতালিল কুফফারি। নিজের সবটুকু শক্তি কাফেরের মোকাবিলায় যুদ্ধে ব্যয় করাকেই জিহাদ বলে। (ফতহুল বারী-খ : ৬, পৃ.-২)। হাম্বলী, মালেকী, শাফেয়ী, হানাফী মাযহাবের ফকীহদের কিতাব খুলে দেখুন। যার সারকথা হচ্ছে, সর্বাত্মকভাবে মুমিনদের সকল শক্তি কাফেরের মুকাবিলায় যুদ্ধে নিয়োজিত করা, জিহাদের সৈনিকদের জান ও মাল, অস্ত্র ও রসদ দ্বারা সার্বিক সহযোগিতা করা। একেই জিহাদ বলে, একেই ক্বিতাল বলে (কানজুল উম্মাল)। কেননা মদীনায় সাহাবীদেরকে যখন বলা হত, এস জিহাদে চল, তখন তারা তীর-ধনুক, নেজা, বল্লম, তরবারী ও ঘোড়া নিয়ে আল্লাহর পথে শাহাদাত লাভের দুর্নিবার আকাংক্ষায় কাফেরদের মোকাবিলায় জিহাদের ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়তেন। প্রিয়তম নবী (স.) জীবিত থাকাকালীন সময় পর্যন্ত জিহাদ সম্পর্কে এর ব্যতিক্রম কোন ধারণা কেউ পোষণ করত না, চিন্তাও করত না। সুতরাং জিহাদ দ্বারা নবীজী এবং তাঁর সাহাবীরা যে অর্থ বুঝতেন এবং আমল করতেন, সে অর্থ, বোধগম্যতা, আমল আজো অপরিবর্তনীয়। কিয়ামত পর্যন্ত তাই থাকবে ইনশাল্লাহ।
(চলবে)
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন