(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
প্রথমত : কিয়াম, তারপর রুকু এবং তারপর সেজদাহ এই পর্যায়ক্রমিক সুরতের নামই হচ্ছে এক রাকায়াত। নামাজে কম সে কম দু’রাকায়াত এবং বেশীর ভাগ চার রাকায়াত নির্ধারণ করা হয়েছে। ফজরের নামাজ দু’রাকায়াত, যোহর, আসর ও এশার ওয়াক্তে চার রাকায়াত এবং মাগরিবে তিন রাকায়াত। এক রাকায়াতে পরিপূর্ণ কোন নামাজই রাখা হয়নি। এমনকি চার রাকায়াতের অধিকও রাখা হয়নি। মূলত: মুসলিহাত হচ্ছে এই যে, নামাজ যেন এত সংক্ষপ্তি না হয়, যার দুরুন অন্তরে নিষ্ঠা ও আন্তরিকতা পয়দা হতে পারে না। কেননা কয়েক সেকেন্ডে নামাজ শেষ হয়ে গেলে একান্ত মনোনিবেশের সুযোগই আসে না। আর এক সঙ্গে চার রাকায়াতের অধিক নামাজে মনের একাগ্রতা টুটে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কারণ দীর্ঘ সময়ের দরুন মনের নিবিড়তায় ফাটল ধরে যায়। এজন্য ফরজ নামাজসমূহের রাকায়াত সংখ্য দু’ থেকে কম এবং চার থেকেও বেশী রাখা হয়নি। মক্কায় অবস্থানাকালে মুসলমানদের মাঝে ছিল অশান্তি ও দারিদ্র্যতার প্রবল চাপ। যেভাবে তারা কাফেরদের ভয়ে চুপে নামাজ আদায় করতেন, সে কারণে সে সময় দু’রাকায়াতের অধিক নামাজ আদায় করাও ছিল অসম্ভব ব্যাপার। একারণে মক্কা মোয়াজ্জামায় প্রত্যেক নামাজ শুধু দু’রাকায়াতই ছিল। তারপর মদীনায় আগমন করে যখন মুসলমানদের মাঝে শান্তির বাতাস বইতে লাগলো, তখন যোহর, আসর এবং এশার নামাজ চার চার রাকায়াত করা হলো। কিন্তু মুসাফিরদের জন্য সেই দু’রাকায়াতই কায়েম রাখা হলো। কেননা, ভ্রমণের সময় তার বাহ্যিক পেরেশানী হাল বাকী থাকে। যে কারণে এই সংক্ষিপ্ততার পথ উন্মুক্ত রাখা হয়েছে। হযরত ইবনে আব্বাস (রা:)-এর বণনার সারকথা হচ্ছে এই যে, মুকীমের জন্য চার রাকায়াতই আদায় করতে হবে এবং মুসাফিরের জন্য দু’রাকায়াত এবং ভয়ের সময় এক এক রাকায়াত করে আদায় করবে।” এর দ্বারা বুঝা যায় যে, শান্তির ব্যাপ্তি ও সংকীণতার কারণে রাকায়াতের সংখ্যাও কম-বেশী করা হত। (সহীহ বুখারী : হিজরত পরিচ্ছেদ; সহীহ মুসলিম : সালাতুল মুসাফির; মুসনাদে ইবনে হাম্বল : ৬খ : ২৪১ পৃ:; ইবনে খুযায়মা ও ইবেন হাব্বান ও বায়হাকী; ফতহুল বারী ১ খ: ৩৯৩ পৃ:)
মাগরিব এবং ফজরের নামাজ কিয়াম এবং সফর উভয় অবস্থায় একই রাখা হয়েছে। মাগরিবের তিন রাকায়াতকেও অর্ধেক করা সম্ভব নয়। তাছাড়া ফজরে মাত্র দু’রাকায়াতই আছে। এর মাঝে আর কি কমানো যায়? কিন্তু মাগরিব এবং ফজরে তিন এবং দু’রাকাআত কেন রাখা হলো? এর বিশদ বিশ্লেষণ উম্মুল মু’মেনীন হযরত আয়েশা (রা:) নিজেই করেছেন। তিনি বলেছেন, মাগরিবে তিন রাকায়াত এজন্য যে, সে সময়টি দিনের বেজোড় সময়। আর দুরাকায়াত এজন্য যে, এরমাঝে দু’রাকায়াতের অধিক বাড়ানো পরিবর্তে লম্বা ও দীঘ কেরাআত পাঠকে আবশ্যক করা হয়েছে। (মোসনাদে ইবনে হাম্বল, ৬খ : ২৪১ পৃ:)
হযরত আয়েশা (রা:)-এর বর্ণনার সামান্য বিশ্লেষণ প্রয়োজন। একথা পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, সূর্য উদয়ের সময় এবং সূর্যাস্তের সময় নামাজ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এ সময় কাফেররা, সূর্য পূজারীরা এবাদত করে থাকে। (সহীহ মুসলিম : নামাজের নিষিদ্ধ সময় অধ্যায়) মাগরিবের নামাজ সূর্যাস্তের পর সঙ্গে সঙ্গেই আদায় করতে হয়। এজন্য তৌহিদে বিশ্বাসীদের উচিত, সূর্য পূজারীদের থেকে নিজেদের পৃথক সত্তা ও ব্যবস্থাকে বহাল রাখা। এজন্য এ সময়ের নামাজে রাকায়াত সংখ্যা ঐ পরিমাণকেই বহাল রাখা হয়েছে যার দ্বারা এক আল্লাহ এবং বেজোড় হওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়। (এশার পরবর্তী বেতের নামাজকেও বেতের এজন্য বলা হয় যে, তাও বেজোড়, অর্থাৎ তিন রাকায়াত) এই সংখ্যাও পরিমাণ এক রাকায়াত হতেই পারে না। কারণ এতে খুশু-খুজু বা নিষ্ঠা ও আন্তরিকতা শেষ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। দু’রাকায়াতও হতে পারে না। কারণ দু’সংখ্যাটি জোড়, বেজোড় নয়। একারণে তাওহীদের গোপন রহস্য উদঘাটন করার সবচেয়ে নিকটতম বেজোড়-সংখ্যাকে বহাল রাখা হয়েছে। যার দরুন আল্লাহর একত্ব, বেজোড় হওয়ার উভয় কথার প্রমাণই উপস্থাপিত হয়। তাছাড়া এর দ্বারা নামাজে নিষ্ঠা ও একাগ্রতার মাঝেও ছেদ পড়ে না। যা এক রাকায়াত হওয়ার কারণে অবশ্যই ছেদ পড়তে বাধ্য। এজন্যই মাগরিবের তিন রাকায়অতকে তিনই বহাল রাখা হয়েছে। এবং সূর্যের পরিপূর্ণ ঢলে পড়া যাকে ঘুরুব বা সূর্যাস্ত বলা হয়, এ সময়েই ঘটে থাকে। এজন্য তাওহীদের মূল রহস্য এ সময়ে বিকশিত হওয়া দরকার। এই বিশ্লেষণের মর্ম এই হাদীসের বাণীতেও সমুজ্জ্বল হয়ে উঠে, যেখানে রাসূলুল্লাহ (সা:) বেতের নামাযের তাকিদ করেছেন। এরশাদ হচ্ছে-
অর্থাৎ হে আহলে কুরআন! বেতের পাঠ কর, কেননা আল্লাহপাক বেজোড়, তিনি বেজোড়কে ভালবাসেন।” (আবু দাউদ)
ফজরের সময় হচ্ছে ঐ চিত্তাকর্ষক সময় যখন মানুষ পরিপূর্ণ শান্তি ও বিশ্রাম লাভের পর জাগ্রত হয়। এ সময়টি খুবই প্রাণবন্ত। এর সময়ে মান-মেজাজও থাকে শান্ত ও নির্মল। অন্তর থাকে প্রশান্ত ও বিমুক্ত। সারা পৃথিবী তখন শান্ত, সমাহিত ও নিথর-নিস্তব্ধ মনে হয়। এজন্য সে সময়টি নামাজ এবং দোয়া কালামের জন্য খুবই উপযুক্ত। আর আল-কুরআনে সেই সময়টির নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যের কথা এভাবে ব্যক্ত করা হয়েছে।
অর্থাৎ ফজরের নামাজের সময় কিরায়াত পাঠে পূর্ণ আন্তরিকতা পাওয়া যায়। একারণে শরীয়তে মোহাম্মদী সে সময়ের নামাজের রাকায়াতের সংখ্যার প্রতি নয়; বরং মৌলিক অবস্থা ও বৈশিষ্টের প্রতি বিশেষ দৃষ্টি নিবব্ধ করা হয়েছে। অর্থাৎ নামাজের রাকায়াত সংখ্যা তো দূই রয়েগেছে, কিন্তু হুকুম দেয়া হয়েছে যেন লম্বা ও দীর্ঘ কেরাআত পাঠ করা হয়। স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (সা:) অন্যান্য নামাজের এক রাকায়াতে মোটামুটি পনর আয়াত তেলাওয়াত করতেন। অনুরূপভাবে রুকু এবং সেজদাহও দীর্ঘায়িত করতেন। (সহীহ মুসলিম : কিতাবুস সালাত, কিরাআত পরিচ্ছেদ এবং আরকানে সালাতের সমতা বিধান পরিচ্ছেদ)
রাকায়াতগুলোর সংখ্যা যদিও রাসূলুল্লাহ (সা:) ও সাহাবায়ে কেরামের অবিচ্ছিন্ন সুন্নাত দ্বারা প্রতিপাদিত এবং সকল মুসলমান নির্দ্বিধায় তার উপর আমলও করে চলেছেন, তবুও নামাজের ব্যবহারিক দিকদর্শন কুরআনুল কারীমের সালাতুল খাওফ-এর মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে। যার মাঝে এই হুকুম দেয়া হয়েছে যে, ইসলামী ফৌজ দু’ভাগ হয়ে যাবে। প্রথম অগ্রবর্তী দল ইমামের পেছনে এক রাকায়াত আদায় করবে এবং দ্বিতীয় দল দুশমনের সামনে দাঁড়িয়ে যাবে। তারপর প্রথম দল দুশমনের সামনে দাঁড়িয়ে যাবে এবং দ্বিতীয় দল ইমামের পেছনে এক রাকায়াত আদায় করবে। এভাবে ইমামের দু’রাকায়াত হয়ে যায় এবং মুক্তাদীদের জমাআতের সাথে এক এক রাকায়াত। এবং যদি দ্বিতীয় রাকায়াতের সুযোগ পাওয়া যায় তাহলে একই আরকান পালনসহ আদায় করবে। আর যদি সম্ভব না হয়, তাহলে ইশারার দ্বারা পৃথক পৃথকভাবে আদায় করবে। যখন ভয়ের নামাজে কসর দু’রাকায়াত পাঠের প্রতিপাদ্যতা নিষ্পন্ন হয়, তখন আসল রাকায়াত সংখ্যা চারই হবে। এর দ্বারা এটাও সুষ্পষ্ট হয়ে উঠে যে, কসর চার রাকায়াত সম্পন্ন নামাজের মাঝেই সিদ্ধ। কসর নামাজের প্রমাণ সূরা নিসার পঞ্চদশ আয়াতে বিধৃত আছে।
নামাজের আভ্যন্তরীণ আদব :
কুরআনুল কারীমে এবং আহাদীসের নবুবীতে নামাজের জন্য বিভিন্ন শব্দাবলী ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন সালাত, দোয়া, তাসবীহ এবং জিকরে ইলাহী। এসকল শব্দাবলীর দ্বারা নামাজের রূহানী বৈশিষ্ট্যাবলী ও আদবসমূহ প্রকাশ পায়। নামাজ দেহ এবং রূহ উভয়টিরই এবাদত। যদি এর মাঝে দেহের অঙ্গ সঞ্চালনের সাথে অন্তরের অনুপ্রেরণা ও অনুভূতি এবং অনুকম্পন শামিল না হয় এবং রূহের মাঝে চূড়ান্ত সান্নিধ্য ও একান্নবর্তিতার ভাব পয়দা না হয়, তাহলে এমন শ্রেণীর নামাজ হবে রং হীন ফুল ও অতৃপ্তিদায়ক পানীয় সদৃশ। এর বেশী কিছুই নয়।
একামাতে সালাত : নামাজ পাঠ করার জন্য কুরআনুল কারীমের বিভিন্ন স্থানে একামাতে সালাত শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। অর্থাৎ নামাজ কায়েম করা, প্রতিষ্ঠিত করা। এর অর্থ শুধু নামাজ পাঠ করাই নয়; বরং নামাজকে এর আদব, আরকান ও সুনানসহ আদায় করা। সুতরাং ভয়ের নামাজে যখন নামাজের কিছু আদব, আরকান ও শর্তাবলী মাফ করে দেয়া হয়েছে ঠিক তার পরই বলা হয়েছে-
অর্থাৎ-পূনরায় যখন তোমরা নিশ্চিন্ত হয়ে যাবে তখন নামাজ কায়েম কর। এর দ্বারা বুঝা যায় যে, একামাতে সালাত অর্থাৎ নামাজকে কায়েম করার অর্থ হচ্ছে এই যে, নামাজকে এর সকল আদব, আরকান ও শর্তাবলীসহ আদায় করা। একারণে নামাযে পূর্ণ প্রশান্তি, সুষ্ঠুভাবে আরকান আদায় করা, আভ্যন্তরীণ খুশু-খুজু ও বিনয় এবং আত্মনিষ্ঠার প্রয়োজন। তাছাড়া নামাজ অপূর্ণ ও নাকেস থেকে যায়।
কুনূত : নামাজের বাতেনী ও আভ্যন্তরীণ আদবগুলোর মাঝে দ্বিতীয় জিনিস হচ্ছে কুনূত। আল্লাহপাক ইরশাদ করছেন :
অর্থাৎ-আল্লাহর সামনে আদবসহ দন্ডায়মান হও। (সূরা বাকারাহ : রুকু-৩১) সাহাবাগণ বলেছেন, আমরা প্রথমে নামাজে কথাবার্তা বলতাম। কিন্তু যখন এই আয়াত অবতীর্ণ হয়, তখন রাসূলুল্লাহ (সা:) আমাদেরকে কথাবার্তা বলতে নিষেধ করেন। কেননা কথা বলা দৃঢ়চিত্ততা ও নামাজের বাতেনী আদবসমূহের খেলাফ ছিল। কুরআনুল কারীমে যে কুনূতের হুকুম দেয়া হয়েছে তা এক আশ্চর্যকর সামগ্রিক শব্দ। (দেখুন, লিসানুল আরব) এর অর্থ হচ্ছে : (১) চুপ থাকা, (২) বন্দেগী করা, (৩) প্রার্থনা করা, (৪) এবাদত করা, (৫) দাঁড়িয়ে থাকা, (৬) দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থাকা। (৭) দৈন্যতা প্রকাশ করা। নামাজে যে কুনূতের কথা এই আয়াতে বলা হয়েছে এর বিভিন্ন অর্থের মধ্য হতে প্রত্যেকটি অর্থই নামাজের উদ্দেশ্য হতে পারে। কেননা, নামাজে জিকির, কেরাআত, তাসবীহ এস্তেগফার, সালাম, তাশাহহুদ ছাড়া মানবিক যাবতীয় প্রয়োজনীয় কথাবার্তা এবং ভাষা হতে নিশ্চুপ থাকতে হয় এতে আল্লাহর বন্দেগী এবং প্রার্থনাও রয়েছে। এবাদতও রয়েছে এবং এর মাঝে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়ানোর অনুশীলন ও আছে এবং দৈন্যতা প্রকাশের সুযোগও রয়েছে। যদি এগুলোর কোন একটিও নামাজের মাঝে কম থাকে, তাহলে নামাজের সমপরিমাণ গুণাবলীর মাঝেও স্বল্পতার সৃষ্টি হবে। (চলবে)
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন