সোমবার, ০৬ মে ২০২৪, ২৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ধর্ম দর্শন

নামাজের অভ্যন্তরীণ আদবসমূহ

এ. কে. এম. ফজলুর রহমান মুন্শী | প্রকাশের সময় : ১১ জুলাই, ২০১৯, ১২:০৭ এএম

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

খুশু : তৃতীয় জিনিস হচ্ছে খুশু। সুতরাং কুরআনুল কারীমে নামাজীদের গুণাবলী উল্লেখ করে ইরশাদ হচ্ছে :

অর্থাৎ-“(ঐ মুমিনই সফলকাম) যিনি স্বীয় নামাজে বিনয় ও দৈন্যতা প্রকাশ করে।” (সূরা মুমিনুন: রুকু-১)

খুশু শব্দটির আভিধানি অর্থ হচ্ছে এই যে, (১) দেহ অবনমিত হওয়া, (২) আওয়াজ স্তিমিত হওয়া, (৩) দৃষ্টি নিম্নমুখী হওয়া। অর্থাৎ প্রতিটি অভিব্যক্তি দ্বারা দৈন্যতা, নম্রতা এবং বিনয়ভাব প্রকাশ পাওয়া। (লিসানুল আদব) এজন্য নামাজ হচ্ছে আল্লাহর সামনে স্বীয় দৈন্যতা, অপারগতা ও একান্ত আনুগত্যের প্রকাশ। যদি এই অবস্থার সৃষ্টি না হয়, তাহলে বস্তুুত : নামাজের আসল উদ্দেশ্যই ব্যাহত হয়ে যাবে।

তাবাত্তুল : তাবাত্তুল শব্দের মূল অর্থ হচ্ছে, কেটে যাওয়া ও সংস্রবহীনতা। এর ব্যবহারিক অর্থ হচ্ছে, আল্লাহ ছাড়া প্রত্যেক বস্তুু হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে শুধু আল্লাহরই নিমিত্ত হওয়া। এটা অত্যন্ত সুস্পষ্ট যে, এ অবস্থাটি একজন মুসলমানের জীবনের আসল মানদন্ড। কিন্তু কুরআনুল কারীমে যেখানে এর হুকুম এসেছে এর পূর্বাপর সম্পর্ক হতে বুঝা যায় যে, তাবাত্তুল মূলত : নামাজের অবস্থার সাথেই সম্পৃক্ত। সুতরাং সূরা মুয্যাম্মিলে এরশাদ হয়েছে, “ হে বস্ত্রাবৃত ব্যক্তি! সামান্য সময় ছাড়া দীর্ঘরাত পর্যন্ত নামাজ আদায় কর, অর্ধরাত অথবা এর চেয়ে কম ও বেশী এবং এতে কুরআন থেমে থেমে পাঠ কর, আমি তোমার উপর একটি ভারী বাণী অবতীর্ণ করব। অবশ্যই রাতে উঠে নামাজ আদায় করা নফসকে খুবই অবদমিত করে এবং তখন কথাও খুব সঠিক ও প্রাণস্পর্শী হয়। তোমার জন্য দিনে বিশেষ অবসর রয়েছে, সুতরাং স্বীয় পরওয়ারদিগারের নাম স্মরণ কর, এবং সকল বস্তুতু হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে আল্লাহর দিকেই অনুপ্রাণিত হও। (সূরা মুয্যাম্মিল, রুকু-১) অর্থাৎ নামাজের হালতে আল্লাহর জিকির করার সময় তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব ও নিজের দৈন্যতা ছাড়া মনের যাবতীয় খেয়াল দূর হওয়া চাই। সহীহ মুসলিমে হযরত আমর ইবনে আবসা সালামী (রা:) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেছেন, রাসূলুল্লাহ (সা:) আমাকে যে নামাজ শিক্ষা দিয়েছেন এতে একথাও বলেছেন যে, অজু করে যে কেউ নামাজের জন্য দাঁড়াবে তারপর আল্লাহর হামদ ও সানা পাঠ করবে, তবে সে আল্লাহরই ঐ শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশ করল, যার তিনি উপযুক্ত এবং সে যেন নিজের অন্তরকে অন্যান্য সকল বস্তুু হতে খালি ও মুক্ত করে নিল। এতে করে নামাজের পর সে এমন হয়ে যায়, যেন তার মা তাকে সে সময়ই প্রসব করেছে। এই হাদীসটি মূলত : সূরা মুয্যাম্মিলে বর্ণিত আয়াতেরই বিশ্লেষণ মাত্র।

তাদাররু : তাদাররু শব্দের অর্থ হচ্ছে রোনাজারী করা, দৈন্যতা প্রকাশ করা এবং খুবই বিনীতভাবে দরখাস্ত পেশ করা। (লিসানুল আরব) নামাজে বান্দাহর আজিজী প্রকাশ করা, বিনয় আনুগত্য ও কান্নার ভাব প্রকাশ করা, এবং অধোবদনে প্রার্থনা করার প্রবণতা দেখা দিতে হবে। অন্যথায় এই হুকুমের উপর আমল পুরোপুরী পালিত হবে না। আল-কুরআনে এরশাদ হচ্ছে, “তোমরা স্বীয় পরওয়ারদিগারকে দৈন্যতা এবং রোনাজারীর মাধ্যমে অনুচ্ছস্বরে ডাক।” (সূরা আ’রাফ: রুকু-৭)

ইখলাস : নামাজের আভ্যন্তরীণ ও বাতেনী সুনান ও আদব হচ্ছে ইখলাস। অর্থাৎ এই নামাজের দ্বারা আল্লাহর উদ্দেশ্য ছাড়া আর কিছুই যেন না হয়। কেননা উদ্দেশ্য যদি এরূপ না হয়, তাহলে নামাজ আর নামাজ থাকে না। বরং রিয়া এবং লোক দেখানো কর্মকান্ড হয়ে যায়। কোন কোন আহলে হক বলেছেন, রিয়া এবং নোমায়েশ দেখা দিলে শেরেক পরিস্ফুট হবে। আল-কুরআনে ঘোষণা করা হয়েছে, “এবং তোমরা প্রত্যেক নামাজে নিজেদের মুখ কিবলার দিকে ঠিক রাখো এবং আল্লাহকে ইখলাসের সাথে ডাকো।” (সূরা আরাফ: রুকু-৩) এর দ্বারা বুঝা যায় যে, নামাজে ইখলাস পয়দা করা তার পরিপূর্ণতার জন্য একান্ত অপরিহার্য।

জিকির : নামাজ হচ্ছে আল্লাহর স্মরণের জন্য। যদি অন্তরে কিছু এবং মুখে কিছু থাকে, তাহলে আল্লাহর সত্যিকার স্মরণ হবে না। এ জন্য আল-কুরআনে ইরশাদ হচ্ছে-অর্থাৎ-আমার স্মরণের জন্য নামাজ কায়েম কর। একথা সুস্পষ্ট যে, শুধু মুখে শব্দাবলী উচ্চারণ করার নাম স্মরণ নয়। এর সাথে অন্তরের একনিষ্ঠতা, নিবিড়তা ও মনোযোগ দরকার। যাকে ‘হুযুরে কলব’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। এবং হুযুরে কবলই নামাজের বড় উদ্দেশ্য।

ফাহ্ম ও তাদাব্ধুর : নামাজে যা কিছু পাঠ করা হয়, তা’ বুঝার ও অনুধাবন করার জন্য চেষ্টা করতে হবে। যদি অন্যমনস্কতার দরুন পঠিত আয়াত ও দোয়া-কালামের অর্থের দিকে অন্তর অনুরক্ত না হয়, তাহলে বাহ্যিক পাঠের দ্বারা অন্তরে কোন প্রকার প্রভাব প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হবে না। এজন্য নেশার হালতে নামাজ পাঠ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কেননা এ সময়ে অনুভূতিশীল অন্তর শরাবীর মাঝে পাওয়া যায় না। আল-কুরআনের ইরশাদ হয়েছে, “ তোমরা নেশাগ্রস্ত অবস্থায় নামাজের নিকটেও গমন করো না। যতক্ষণ না তোমরা যা বলো, তা বুঝতে পার। (সূরা নিসা: রুকু-৭) এই আয়াতে পাকে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা দেয়া হয়েছে যে, নামাজে যা কিছু পাঠ করা হোক তা’ বুঝারও দরকার আছে। একারণে রাসূলুল্লাহ (সা:) প্রবল নিদ্রার আগমনকালে নামাজ আদায় করতে নিষেধ করেছেন। কেননা, এ সময়েও মানুষ বুঝ এবং উপলব্ধির ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। হাদীস শরীফে আছে, রাসূলুল্লাহ (সা:) এরশাদ করেছেন, “নামাজে যখন তোমাদের প্রবল নিদ্রার উদ্রেক হবে, তখন ঘুমিয়ে পড়, কেননা, নিদ্রার অবস্থায় নামাজ পাঠ করলে দোয়ার স্থলে নিজেকে ভালো-মন্দ ও বলে ফেলতে পার।” (সহীহ মুসলিম : কিতাবুস সালাত) অপর এক বর্ণনায় আছে, রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেছেন, “নামাজে যদি নিদ্রার ভাব প্রবল হয়, তাহলে ঘুমিয়ে পড়া দরকার। যেন সে যা বলে, তা বুঝতে পারে।” (সহীহ বুখারী, আবু দাউদ ও মুসনাদে আহমদ) মুস্তাদরেকে হাকেমে আছে, রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেছেন, “ যে ব্যক্তি উত্তমরূপে অজু করে এবং তারপর এভাবে নামাজ পড়বে যা কিছু সে পাঠ করছে, তা যেন বুঝতে পারে। এভাবে যদি নামাজ সম্পন্ন করে, তাহলে সে এমন হয়ে যাবে যেন সেদিনই সে মায়ের পেট হতে ভূমিষ্ট হয়েছে।” [মুস্তাদরেক (তারগীব ও তারহীব হাফেজ মুনজেরী, ১ম খ: ৭৩ পৃ: মিশর) এই হাদীসের মর্মানুসারে যারা আরবী ভাষা জানে না, তাদেরকে সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। কেননা নামাজে যে সকল দোয়া-কালাম পাঠ করতে হয় এগুলোর অর্থ জানাও দরকার। আর এ কাজটা মুসলমানদের জন্য খুবই সহজ। যদি তারা একটুখানি সতর্ক হয়।]

এগুলো হচ্ছে নামাজের ঐ সকল বাতেনী আদব যেগুলো ছাড়া নামাজ পরিপূর্ণতা লাভ করে না। যেভাবে নামাজের জাহেরী শর্তাবলী হতে গাফেল থাকা মূলত: নামাজের প্রতি অন্যমনস্কতা বুঝায়, অনুরূপভাবে নামাজের বাতেনী আদবসমূহের প্রতি সচেতন না হলে নামাজের প্রতি অমনোযোগীতাই বুঝায়। আর এজন্যই নিন্মোক্ত আয়াতের মর্ম এই দুটো দিককেই নির্দেশ করে। এরশাদ হচ্ছে, ‘অভিসম্পাত ঐ সকল নামাজীর জন্য যারা স্বীয় নামাজে অমনোযোগী এবং যারা লোক দেখানোর জন্য নামাজ পাঠ করে।” (সূরা মাউন : রুকু-১)

এখানে এই শব্দাবলীর প্রতি লক্ষ্য করুন, “অভিশম্পাত ঐ সকল নামাজীদের জন্য যারা নিজেদের নামাজে অমনোযোগীতা প্রকাশ করে।” স্বয়ং নামাজী হওয়া সত্তে¡ও নামাজ হতে গাফেল হওয়ার অর্থ এই যে, নামাজের জন্য যে সকল জাহেরী আদব যেমন সময়ের প্রতি লক্ষ্য রাখা, আরকান পালনে সচেতনতা ইত্যাদি এবং যে সকল বাতেনী আদব যেমন খুশু-খুজু, তাদাররু ও রোনাজারী এবং বুঝ ও চিন্তা-গবেষণা ইত্যাদির প্রতিও মনোযোগী হওয়া একান্ত দরকার। এগুলোর দ্বারাও নামাজে অমনোযোগীতা প্রকাশ পায়।

নামাজের উপরোল্লিখিত আদব মোতাবেক রাসূলুল্লাহ (সা:)-এর হেদায়েত তালীমাত এবং ব্যবহারিক দৃষ্টান্তসমূহও রয়েছে। যেগুলোর মাঝে তিনি নামাজের মূল হাকীকতকে বিকশিত করে তুলেছেন। একবার মসজিদে নববীতে একব্যক্তি আগমন করে অতি দ্রুত নামাজ আদায় করলো। রাসূলুল্লাহ (সা:) বললেন, হে ব্যক্তি! তোমার নামাজ পুনর্বার পাঠ কর। কেকনা, তুমি নামাজ আদায় করনি। লোকটি দ্বিতীয়বারও একই রকম নামাজ আদায় করলো। রাসূলুল্লাহ (সা:) দ্বিতীয়বারও একই নির্দেশ দিলেন। তখন তৃতীয়বারও একই অবস্থার পুনরাবৃত্তি ঘটল, তখন লোকটি আরজ করল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! কিভাবে নামাজ আদায় করবো? এরশাদ হলো, “এভাবে দাঁড়াবে, এভাবে কেরাআত পাঠ করবে, এভাবে শান্তি ও এত্মিনানের সাথে রুকু এবং সেজদা করবে।” (সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম, আবু দাউদ, কিতাবুস সালাত) নামাজে চোখ তুলে এদিক- সেদিক তাকানো খুশু বা বিনীতভাবের খেলাপ। এর দ্বারা মানুষের মনোনিবেশ দূর হয়ে যায় এবং হুযুরে কলবের মাঝে ব্যতিক্রম দেখা দেয়। এজন্য রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেছেন, নামাজে এদিক-সেদিক তাকিও না। তোমাদের কি ভয় নেই যে, তোমাদের দৃষ্টি ফিরে আসতে পারবে না? মোসনাদে আহমাদ) (চলবে)

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন