উদাস চোখে একটু অসহায় ভঙ্গিতে বসে আছে দবির উদ্দিন। একটু দূরেই খাটিয়ার উপর সোয়ানো রয়েছে শরিফার লাশ। একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলল দবির উদ্দিন। কত বছরের সংসার জীবন ওর ? তা তিরিশ বছরতো হবেই। যখন দরিরের সাথে বিয়ে হয় শরিফার তখন দবিরের বয়স এই বছর ঊনিশ হবে। আর শরিফার বয়স পনের। দবির তখন রিকশা চালায়। আয়ও করে ভালই। নিজের রিক্শা, তাই কাউকে টাকার ভাগ দিতে হয় না। বাঁধের মাটি টানার কাজ করে টাকা জমিয়ে রিক্শা কিনে ছিল ও । তখন ও টকবগে তরুণ। মায়ের আদরের একমাত্র সন্তান। বাপ মরে গিয়েছে দবির ছোট থাকতে, মা মানুষের বাড়িতে কাজ করে অনেক বড় করেছে ওকে। ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত পড়িয়েছে দবির উদ্দিনকে। পরের বাড়িতে কাজ করতে করতেই অকালে বুড়ো হয়ে গেল মা’টা। এখন ভাল চোখেও দেখেনা।
যখন থেকে দবির আয় করতে শিখল তখন থেকেই ও নিজের কর্তা নিজেই। মা কোন রকমে সংসারের কাজ চালাত। পঞ্চাশ-বায়ান্ন বছর বয়সেই মা একদম বুড়িয়ে গেল। ঐ ঊনিশ বছর বয়সেই দবিরের মনে হচ্ছিল বিয়ে করা দরকার। গ্রামের সবুজ মোল্যার বিয়েতে বরযাত্রী হয়ে গেল দবির। সেখানেই দেখল শরিফাকে। শ্যামলা রঙ্গের এক হারা ছিপছিপে গড়ন। ঠিক যেন কচি লাউয়ের ডগা। একটু চাপা নাক,বড় বড় দুটি চোখ আর লম্বা চুলে ভীষণ সুন্দর দেখাচ্ছিল শরিফাকে। চোখ ফেরাতে পারছিলনা দবির। চোখা চোখি হতেই লজ্জায় চোখ সরিয়ে নিল শরিফা। আর লজ্জা শরম ভুলে আর একটু কাছে এগিয়ে গেল দবির, জিজ্ঞাসা করেই ফেলল ’ নামকি তোমার ?’ চমকে তাকাল মেয়েটি তারপর ফিক করে হেসে দিয়ে বলল ‘শরিফা’ , তারপর ঐ ছুটে পালাল ও। এর পর যতক্ষণ ঐ বাড়িতে থাকল ওরা ততক্ষনই ওর চোখ খুঁজে বেড়াল শরিফাকে। মাঝে মাঝে দেখাও মিলল। দবির ততক্ষণে খোঁজ নিয়ে ফেলেছে শরিফা সবুজ মোল্যার বৌ এর চাচাত বোন, আরো অনেক কিছু।
বিয়ে বাড়ি থেকে ফিরে এসে পরদিনই ধরল যেয়ে সবুজ মোল্লাকে। সে যেন ফিরানী ভাঙ্গতে যেয়েই বিয়ের প্রস্তাব দেয়। কোথাও কোন আপত্তি হল না। হয়ে গেল বিয়ে। প্রথম এক বছর ভালই কাটলো। তারপরই সমস্যা শুরু হল। বদলে যেতে থাকলো শরিফা। প্রায় অন্ধ হয়ে যাওয়া মাকে সহ্যই করতে পারেনা ও। মাকে দেখলেই যেন ওর শরীরে জ্বলুনী শুরু হয়ে যায়। মা ছেলের বউ এর মুখ ঝামটা খেতে খেতে একদিন মরেই গেল। এর মধ্যে একটা মেয়ে ও হল ওদের। নাম রাখল মরিয়ম। যত দিন যেতে লাগলো শরিফার অতৃপ্তি ও বাড়তে লাগলো। বেড়ার ঘর কেন। ইটের ঘর দিতে হবে। নিজে প্রানান্ত পরিশ্রম করে, ধার দেনা করে একটা পাকা ঘর উপরে টিনের ছাউনি দিয়ে করল দবির। এর পর শুরু হল বিদ্যুৎ নিতে হবে। ফ্যান কিনতে হবে। টেলিভিশন চাই। এমনি সব নিত্য নতুন বায়না। এর মধ্যে আরো একটি মেয়ে হয়েছে ওদের। খাওয়ার মুখ বেড়েছে। মেয়েরা বড় হচ্ছে। তাদের লেখাপড়া, খাওয়া পরা সব মিলিয়ে অনেক খরচ। হিমসিম খায় দবির। মাঝে মাঝে রাগের জ্বালায় শরিফার গায়ে পর্যন্ত হাত তোলে ও। কিন্তু তারপর ও শরিফার চাহিদা কমেনা। মেয়েদের বিয়ে দিতে ঋণে আকন্ঠ নিমর্জিত হয় দবির। কিন্তু তাতেও দমেনা শরিফা। নতুন আবদার শুরু হল একটা গরু কিনে দিতে হবে। সেই গরু পুষে নাকি সব ঋণ শোধ করবে শরিফা। কিছুতেই রাজি হয় না দবির। গরু পোষার অনেক খরচ। এত পারবে না দবির। তখন শরিফা আবদার ধরল নিজের বাপের কাছে। শরিফার বাপ মেয়ের ইচ্ছে পূরণ করলেন। একটা বাছুর কিনে দিলেন তিনি। বাধ্য হয়েই দবিরকে গরুর খাদ্য কিনতে হল। এক সময় রিক্শা চালানোর কাজ ও করতে চাইলনা। রিক্শা বিক্রি করে দিয়ে দিন মজুরের কাজ নিল দবির উদ্দিন। সখের গরুই কাল হল শরিফার। গরুটা বেশ বড় আর মার কুটে হয়ে উঠল। একদিন সকালে গরুকে খেতে দিতে গোয়ালে ঢুকলো শরিফা। আর পেছন দিকে একটা গুতো মেরে দিল গরুটা। পড়ে গেল শরিফা। ঐ যে পড়ল আর কোন দিন ঠিক মত দাড়াতে পারলোনা ও। বেশ কবছর হল ডায়াবেটিস ধরা পড়েছে শরিফার। কোন নিয়মই মানতে চাইত না ও। ইনসুলিন নিতে হত দুবেলা। পড়ে যাওয়াতে একে বারেই সয্যাসায়ী হয়ে গেল শরিফা। অনেক চেয়ে চিন্তে, ধার করে শরিফার কোমর অপারেশন করায় দবির। কিন্তু শরিফা আর সম্পূর্ণ উঠে দাড়াতে পারলো না। যদি দশদিন সোজা থাকে তো বিছানায় থাকে দুই মাস। মেয়েদের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। ওরা যার যার শশুর বাড়িতে। ঘরে বাইরে সমানে খাটতে হয় দবির উদ্দিনকে। বৌ এর যত্ন,রান্না বান্না, ঘর বাড়ি পরিস্কার করা থেকে নিজের দিন মুজুরের কাজ সবই করতে হয় একা দবিরকে। কিন্তু তারপরও কেমন একটা মায়া অনুভব করতে থাকে দবির শরিফার জন্যে। এতদিনের জীবন সঙ্গী। একা হয়ে যাওয়ার কথা ভাবতে পারেনা ও। বৌ এর পেছনে গত ছয় বছরে প্রায় তিন চার লক্ষ টাকা খরচ করেছে দবির। পরদিনই হাটে নিয়ে গরুটা বিক্রি করে দিয়েছিল ও। একনিষ্ঠ ভাবে এই কয় বছর সেবা করেছে শরিফার। নিজেও ঋণ আর পরিশ্রমের ভারে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। বুড়িয়ে গিয়েছে। গত চার পাঁচ দিন কোন সাড়া ছিলনা শরিফার। তারপর গত রাতেই ---------। মেয়েদের চিৎকার করে কান্নার শব্দে হঠাৎ যেন চেতনা ফিরল দবিরের। তাইতো, কতক্ষন বসে আছে ও ? ঘাড় থেকে বোঝা নামিয়ে ফেললে যেমন হালকা লাগে নিজেকে। শুকনো চোখে চারদিকে চোখ বুলাল দবির উদ্দিন। সমস্ত চাওয়া পাওয়ার বেড়া ডিঙ্গিয়ে অনেক দূরে শরিফা। হঠাৎ প্লাবন নামে দুচোখে দবির উদ্দিনের। সামনের সব কিছু অস্পষ্ট হয়ে যায় ওর কাছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন