বুধবার, ০১ মে ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১, ২১ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ধর্ম দর্শন

নামাজের অভ্যন্তরীণ আদবসমূহ

এ. কে. এম. ফজলুর রহমান মুন্শী | প্রকাশের সময় : ১৮ জুলাই, ২০১৯, ১২:০৫ এএম

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

রাসূলুল্লাহ (সা:) একথাও বলেছেন যে, “যতক্ষণ পর্যন্ত বান্দাহ নামাযে এদিক-সেদিক না তাকাবে, ততক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহ পাক তার প্রতি দৃষ্টি রাখেন, এবং যখন সে আল্লাহর দিক হতে মুখ ফিরিয়ে নেয়, তখন আল্লাহ পাকও তার দিক হতে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেন।” (মোসনাদে আহমাদ) ৫ খ: ২৭৩ পৃ: ; আবু দাউদ)

রাসূলুল্লাহ (সা:) একথাও বলেছেন যে, “যখন তোমাদের মাঝে কোন ব্যক্তি নামাজের জন্য দাঁড়ায় তবে সে যেন সর্বাত্মকভাবে আল্লাহর দিকে অনুপ্রাণিত থাকে, নিবিষ্ট থাকে, এমনিভাবেই যেন নামাজ শেষ করে এবং নামাজে মুখ ফিরিয়ে এদিক-সেদিক তাকিয়ো না। কেননা, যতক্ষণ তোমরা নামাজে রত থাক, ততক্ষণ তোমরা আল্লাহর সঙ্গে কথাবার্তা বলছ।” (কানজুল উম্মাল : ৪ খ: ১০৮ পৃ: ততক্ষণ তোমরা আল্লাহর সঙ্গে কথাবার্তা বলছ।” (কানজুল উম্মাল : ৪খ: ১০৮ পৃ: তিবরানী ফিল আওসাত) মোসনাদে বাজ্জারে আছে, যখন বান্দাহ নামাজে এদিক-সেদিক তাকায় তখন আল্লাহ বলেন, তুমি কোন দিকে তাকাচ্ছ? তবে কি তোমার কাছে আমার অপেক্ষা উত্তম বস্তু রয়েছে। তোমার উচিত আমার দিকে দেখা। দ্বিতীয়তবারও আল্লাহ একথাই বলেন। তারপর তৃতীয় বারও যখন সেই ব্যক্তির নিকট হতে একই আচরণ প্রকাশ পায়, তখন আল্লাহ পাক তার দিক হতে মুখ ফিরিয়ে নেন। (কানজুল উম্মাল : ৪ খ: ১০৮ পৃ:)

একবার রাসূলুল্লাহ (সা:) এরশাদ করলেন, “সবচেয়ে বড় চোর ঐ ব্যক্তি যে নামাজে চুরী করে।” সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ ! নামাজের চুরী কি জিনিস? এরশাদ হলো, “রুকু এবং সেজদাহ ভালোভাবে না করা, খুশু বা বিনয়ভাব না হওয়া।” ( মোসনাদে আহমাদ, দারমী, ইবনু আবি শায়বা, ইবনে খুজায়মা, ইবনে হাব্বান, তিবরানীতে শেষ শব্দটি নেই) অন্য একবার রাসূলুল্লাহ (সা:) নামাজ হতে ফারেগ হয়ে শেষ কাতারের একজন লোককে ডাক দিয়ে বললেন, “হে অমুক! তুমি আল্লাহকে ভয় কর না। হে অমুক ব্যক্তি! তুমি আল্লাহকে ভয় কর না। কিভাবে নামাজ পড়ছ? যখন কোন ব্যক্তি নামাজ পড়তে দাঁড়ায় তখন সে আল্লাহর সাথে কথাবার্তা বলে। সুতরাং চিন্তা করা উচিত কি সব কথাবার্তা বলছো।” (মোস্তাদরেকে হাকেম : ১খ : ২৪৬ পৃ:) সহীহ মুসলিম শরীফে আছে, রাসূলুল্লাহ (সা:) এরশাদ করেছেন, তুমি কি ভালোভাবে নামাজ আদায় করছ না? তবে কি নামাজ আদায়কারী ব্যক্তি যখন নামাজ পাঠ করে তখন সে কি বুঝে না কিভাবে নামাজ পড়ছে? তুমি তো নিজের উপকারের জন্যই নামাজ পাঠ করছো।”

নামাজের অবস্থায় থুথু ফেলা বিশেষ করে সামনের দিকে থুথু ফেলা আদবের খেলাপ। রাসূলুল্লাহ (সা:) সাহাবীদের লক্ষ্য করে বলেছেন, নামাজের হালতে আল্লাহ পাক তোমাদের সামনে থাকেন। তবে কি তোমরা পছন্দ কর যে, তার সামনে থুথু নিক্ষেপ কর?” (সহীহ মুসলিম, হাকেম, আবু দাউদ) অপর এক বর্ণনায় আছে, রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেছেন, “নামাজে কোনও ব্যক্তি যেন সামনের দিকে থুথু নিক্ষেপ না করে। কেননা সে তখন আল্লাহর সাথে কথা বলে।” (সহী বুখারী ও মুসলিম) অপর এক বর্ণনায় আছে, রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেছেন, “নামাজের হালতে আল্লাহপাক তোমাদের মুখের সামনে থাকেন।” রাসূলুল্লাহ (সা:) নামাজে শান্তি ও নিরাপত্তা পয়দা করার প্রতিও হেদায়েত করেছেন। এরশাদ হয়েছে, “নামাজ হচ্ছে (তোমরা বাহির থেকে আসছ) তখন দৌড়ে এসো না, বরং এভাবে আস, যেন তোমাদের মাঝে শান্তি ও গাম্ভীর্য বলবৎ থাকে।” (সহীহ মুসলিম) এর দ্বারা প্রথম উদ্দেশ্য হচ্ছে এই যে, স্বয়ং ঐ ব্যক্তির উপর যেন শান্তি ও এত্মিনান বলবৎ থাকে। দ্বিতীয়ত : তার দৌড়-ঝাপের ফলে অন্যান্য নামাজীদের মাঝেও যেন শান্তি ও নিরাপত্তা বিঘি্নত না হয়। এমনিভাবে অশান্তি ও অস্বস্তিকর স্বাভাবিক কারণসমূহ যদি দেখা দেয়, তাহলে নামাজের পূর্বেই এগুলো থেকে বিমুক্ত হতে হবে। যেমন ক্ষুধার্ত অবস্থায় যদি আহার্য প্রস্তুুত থাকে, অপরদিকে জামায়াতও দাঁড়িয়ে যায়, তখন প্রথমে আহার্য গ্রহণ করা চাই। যেন নামাজ এতমিনানসহ আদায় হয়। (সহীহ মুসলিম) অনুরূপভাবে এস্তেঞ্জা বা কাজায়ে হাজতের প্রয়োজন হলে, এর থেকে বিমুক্ত হওয়ার পর নামাজ আদায় করতে যেহে হবে। (সহীহ মুসলিম, আবু দাউদ, মোয়াত্তা ইমাম মালেক, তিরমিজী ও হাকেম)
ইসলামের শুরুতে মানুষ নামাজের হালতে হাত উঠিয়ে সালামের জওয়াব দিত। কিন্তুু মদীনা আগমন করার পর এই হুকুম রহিত হয়ে যায়। একজন সাহাবী যিনি এ ব্যাপারটি জানতেন না, তিনি নামাজের হালতে কয়েকবার রাসূলুল্লাহ (সা:)-কে সালাম দিলেন। কিন্তুু যখন রাসূলুল্লাহ (সা:)-এর উত্তর দিলেন না, তখন নামাজ শেষে তিনি তার উল্লেখ করলেন। এরশাদ হলো, “নামাজে অন্যরকম মনোনিবেশ আছে।” (সহীহ মুসলিম)

নামাজ পাঠ করার সময় এমন কাপড় পরিধান করা অথবা সামনে নকশাদার এমন কাপড় টাঙ্গিয়ে রাখা যদ্বারা অন্তর আপ্লুত হয় এবং মনোনিবেশ দূরীভূত হয়, তা শরীয়তের মাকরূহ। একবার রাসূলুল্লাহ (সা:) ফুল বোটা সম্বলিত একটি চাদর গায়ে জড়িয়ে নামাজ আদায় করলেন। তারপর বললেন, এর ফুল- বোটা আমার মন আকর্ষণ করেছে। এই চাদরটি আবু জাহীম (এক ব্যবসায়ী)-এর নিকট নিয়ে যাও। এবং একটি ডোরাহীন সাদা চাদর নিয়ে আস। (সহীহ মুসলিম) অনুরূপভাবে হযরত আয়েশা (রা:) একবার দেয়ালে রঙিন চাদর টাঙ্গিয়ে দিলেন, রাসূলুল্লাহ (সা:) নামাজ আদায় করলেন, কিন্তুু একাগ্রচিত্ততা অনুভব করলেন না। সঙ্গে সঙ্গে তা তিনি খুলে ফেলার নির্দেশ দিলেন। (সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিম) নামাজের সময়সমূহ নির্ধারণেও এই নিয়ম বহাল হয়েছে যে, তা এমন হওয়া চাই, যার মাঝে অন্তত : শান্তি ও এতমিনান হাসিল হয়। এজন্য যোহরের ওয়াক্ত যদিও সূর্য ঢলে পড়ার পর পরই শুরু হয় তবু সে সময় যেহেতু উত্তাপ খুব বেশী থাকে। এ কারণে সামান্য বিরতি দেয়ার হুকুম দেয়া হয়েছে। গরমের দিনে যেহেতু আরো বেশী উত্তাপ থাকে; এজন্য বলা হয়েছে যে, দ্বিপ্রহরের এই গরম যেন জাহান্নামের আগুনের ফুলকি। একারণে সামান্য ঠাণ্ডা হওয়ার পর যোহর আদায় করার হুকুম দেয়া হয়েছে। এরশা হয়েছে :

অর্থাৎ-নামাজে একান্ত মনোনিবেশ পাওয়া যায়। (সহীহ মুসলিম) নামাজের রূহানী বৈশিষ্ট্যের সবচেয়ে উত্তম দৃশ্য হচ্ছে এই যে, মানুষের মাঝে এমন অবস্থা প্রকাশ পায় যেন, সে বুঝতে পারে এ সময়ে সে আল্লাহর সামনে দাঁড়িয়ে আছে। উপরে বর্ণিত হয়েছে যে, এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (সা:)-কে জিজ্ঞেস করেছিল, এহসান কি জিনিস? তিনি বললেন, “যখন তুমি এবাদত করবে তখন মনে করবে যে তুমি আল্লাহকে প্রত্যক্ষভাবে দেখছ। কিন্তুু তুমি যদি আল্লাহকে দেখতে নাও পার, তবু তিনি তোমাকে দেখছেন।” (সহীহ বুখারী : কিতাবুল ঈমান)

কখনো কখনো রাসূলুল্লাহ (সা:)-এর মাঝে নামাজে এমন কোমল ও বিনয়ভাবে প্রকাশ পেত যে, চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরে পড়ত। একজন প্রত্যক্ষদর্শী সাহাবী যিনি রাসূলুল্লাহ (সা:)-এর

এই অবস্থাকে দেখেছিলেন, তিনি বলেন, আমি দেখলাম, রাসূলুল্লাহ (সা:)-নামাজ পড়ছেন। চোখ বেয়ে দর দর বেগে অশ্রু ঝরে পড়ছে। কাঁদতে কাঁদতে জোরে জোরে নি:শ্বাস নিচ্ছেন। দূর হতে মনে হচ্ছিল যেন, (গড়গড় শব্দে) যাতা ঘুরার শব্দ হচ্ছে। কিংবা হাঁড়ির পানি উথলে উঠছে। (জামে তিরমিজী, আবু দাউদ)

রাতের নামাজে রাসূলুল্লাহ (সা:)-খুবই অনুরাগ ও আকর্ষণ অনুভব করতেন। কুরআন তিলাওয়াতের সময় যখন আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ও কিবরিয়া-এর প্রসঙ্গ আসত, তখন তিনি অনুকম্পা ও দয়া কামনা করতেন। আর যখন দয়া ও অনুকম্পার আয়াতসমূহ আসত, তখন দোয়া করতেন। (মোসনাদে আহমদ : ৬ খ: ৯৩ পৃ:) তিনি বলেছেন, নামাজ দু’ দু’ রাকায়াত করে হয় এবং প্রত্যেক দ্বিতীয় রাকায়াতে তাশাহহুদ আছে এবং বিনয় ও রোনাজারী আছে এবং আনুগত্য ও একনিষ্ঠতা আছে। দৈন্যতা ও অভিনিবেশ আছে এবং হাত উত্তোলন করে হে আল্লাহ! হে আল্লাহ! বলার অবকাশ আছে। যে এরূপ করবে না, তার নামাজ হবে অসম্পূর্ণ (আবু দাউদ, তিরমিজী) একবার রাসূলুল্লাহ (সা:) এতেকাফে ছিলেন। লোকজন মসজিদে জোরে জোরে কেরাআত পাঠ করছিল। তিনি বললেন, হে লোকসকল! তোমাদের মাঝে সকলেই আল্লাহর সাথে মোনাজাতে নিমগ্ন। তার বুঝা উচিত কি সে বলছে। একজনের মোনাজাত যেন অন্যজনের মোনাজাতে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি না করে। (আবু দাউদ)

একবার একজন সাহাবী আরজ করলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমাকে কিছু নসীহত করুন। ইরশাদ হলো, যখন তোমরা নামাজের জন্য দাঁড়াবে, তখন তোমাদের নামাজ এমন হওয়া চাই যেন তোমরা তখন মৃত্যুর মুখোমুখী দাঁড়িয়েছ এবং এই পৃথিবীকে পরিত্যাগ করছ। (মোসনাদে আহমদ, ৫খ, ৪১২ পৃ:) নামাজের এই পূর্ণ বৈশিষ্ট্যের কথা কোনও ব্যক্তি আন্দাজ করতে পারে কি?

এই বিস্তৃত আলোচনার দ্বারা বুঝা যাবে যে, ইসলামে নামাজ কি? কুরআন কোন্ নামাজের আহকামসহ অবতীর্ণ হয়েছে এবং মোহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা) কোন্ নামাজের শিক্ষা দিয়েছেন এবং এই নামাজের আসল বৈশিষ্ট্য কি কি? আর প্রকৃতই যদি এই নামাজ এমনই হয়, তবে তা মানুষের রূহানী এবং আখলাকী সংস্কার ও সংশোধনের কতটুকু উপকারী উপকরণ তা বলার অবকাশ রাখে না। এজন্য কুরআনুল কারীমে নামাজের হেফাজত ও পাবন্দি ও আদবসহ আদায় করাকে ঈমানের প্রতিফল বলা হয়েছে। ইরশাদ হচ্ছে, “যারা আখেরাতের উপর ঈমান রাখে, তারা কুরআনকে মান্য করে এবং তারা নিজেদের নামাজকে হেফাজত করে।” (সূরা আনয়াম : রুকু-১১) নামাজের এই হেফাজত ও লক্ষ্য রাখার দু’টো অর্থ আছে এবং উভয় অর্থই এখানে প্রযোজ্য। একটি হচ্ছে এর জাহেরী শর্তাবলী পরিপূর্ণ করা, এবং দ্বিতীয়টি হচ্ছে বাতেনী আদবসমূহের প্রতি সতর্কতা অবলম্বন করা। (চলবে)

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন