রাজধানী ঢাকায় যারা বসবাস করেন তাদের নানান রং ও ঢঙের কষ্টের মধ্যে পড়তে হয় প্রতিনিয়ত। যানজট, ময়লা-আবর্জনা, জলাবদ্ধতা, বৃষ্টি হলেই স্যুয়ারেজ পানির লাইন একাকার, চলাচলে অযোগ্য খানাখন্দ রাস্তা, মশার কামড়, সুপেয় খাবার পানির অভাব, অপর্যাপ্ত গণপরিবহন, ফুটপাতে যত্রতত্র দোকান বসিয়ে পথ রোধ করা, গ্যাস-বিদ্যুৎ-ব্যবহারিক পানি নিরবচ্ছিন্ন না থাকা, কলকারখানার কালো ধোঁয়ায় বায়ুদূষণ, উন্নয়নের নামে প্রতি বছর ফুটপাত ভাঙা, রাস্তার মাঝখানে যেখানে সেখানে গর্তের কষ্টসহ বিভিন্ন রকমের কষ্ট হলো ঢাকায় বসবাসরত নগরবাসীর নিত্য সঙ্গী। তার উপর আছে মশা নামক কষ্টকর কীটের যন্ত্রণা, আছে ডেঙ্গু নামক কষ্টকর রোগও। হয়তো এসব কারনেই মার্কিন সাময়িকী ফোর্বস ম্যাগাজিনের এক জরিপে পৃথিবীর সবচেয়ে নোংরা শহরের মধ্যে দ্বিতীয় বলা হয়েছে ঢাকাকে। বাংলাদেশের রাজধানী শহর ঢাকা ক্রমেই বসবাসের জন্য অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। শহরের পরিবেশ মানুষের জীবনযাত্রাকে এমনভাবে ব্যাহত করছে যার ফলে এই শহরের বাসিন্দাদের মাঝে আর প্রাণের উচ্ছ¡াস খুঁজে পাওয়া যায় না। যে কারণে শহর প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল সেটি আর এই শহরে খুঁজে পাওয়া যায় না। এর অন্যতম প্রধান কারণ হলো, ‘অপরিকল্পিত নগরায়ন’। নগরবাসীর প্রথমে যে সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় তা হলো যাতায়াত সমস্যা। এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না যে এই সমস্যার জন্য বিরক্ত নয়! আমরা প্রতিদিনের কর্মঘণ্টা হতে একটা বড় অংশ ব্যয় করি ঢাকার রাজপথে। আমাদের গুরুত্বপূর্ণ কর্মঘণ্টাগুলো নষ্ট করার জন্য রাস্তা যেন ওতপেতে রয়েছে। মাঝে মাঝে অবস্থা এমন প্রকট আকার ধারণ করে যে, ৩০ মিনিট হাঁটলে যেখানে পৌঁছানো সম্ভব, সেখানে গাড়িতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতে হয়। যানজটে বসে থেকে শুধু কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে তা নয়, বরং জ্বালানির অপচয় হচ্ছে সঙ্গে পরিবেশ দূষণ। এর অর্থনৈতিক মূল্য অনেক। এসব সমস্যা থেকে উত্তরণে ভবিষ্যৎ চিন্তা করতে হলে সবার আগে আমাদের যে বিষয়টি ভাবতে হবে তা হলো ‘ঢাকার যানজট’। যানজট সমস্যার সমাধানের জন্য দেখতে হবে ৩৬০ ডিগ্রিতে। ঢাকা মূলত মধ্যবিত্তের নগর। এই মধ্যবিত্তের পরিবেশ নিয়ে ভাবনাগুলো কী, তা বুঝা প্রয়োজন। মধ্যবিত্তের গতানুগতিক ধারণায় ঘর বা অফিসের বাইরে যাওয়া মানেই বিভিন্ন ধরনের বাস্তব ও কল্পিত যন্ত্রণার সঙ্গে যুদ্ধ করা, দুর্ঘটনা যেখানে নিত্য সঙ্গী। যার ফলে এই শ্রেণির কাছে বাইরের জগৎটা প্রায় পুরোপুরি নেতিবাচক। নেতিবাচক এতটাই যে, সেটা যতটা সম্ভব এড়ানো যায়। এর ফলে নগরবাসীর মধ্যে যেটা হয় তা হলো, প্রয়োজন ছাড়া বাইরে না যাওয়া। আর এ কারণে নগর মানব আজ এক নিঃসঙ্গ। নিজের পরিবারের বাইরে কারো সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই। শহরে মানুষ অপরাধ এবং দুর্ঘটনার ভয়ে সংকুচিত থাকে। মানুষ যখন অন্য মানুষ বা প্রতিবেশীর সঙ্গে মেলামেশা করার সুযোগ কম পায়, শহরের রাস্তাগুলো যখন খালি থাকে, মানুষ যখন আত্মকেন্দ্রিক হয়, একে অন্যের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। দেখা যায়, তখন অপরাধ বৃদ্ধি পাচ্ছে। নগর বিশেষজ্ঞের দৃষ্টিতে গণপরিসরে নাগরিক চত্বর এবং রাস্তা হলো একটি বাসযোগ্য ও স্বাস্থ্যকর শহরের অন্যতম মৌলিক উপাদান। যা নগরবাসীর জন্য সামাজিকীকরণের অন্যতম উপাদান।
আর আমরা নগরবাসী বাইরে বের হওয়ার অনীহার কারণেই এক ধরনের নগরবিরোধী মানসিকতা পোষণ করি। যেহেতু আমরা এই শহরকে নিজের মনে করি না সেহেতু, শহরের মালিকানাবোধও আমাদের মধ্যে থাকে না। এর কারণে যেটা হয়, আমরা রাস্তায় যত্রতত্র থুতু ফেলি, রাস্তায় ঘরের আবর্জনা ছুড়ে ফেলি, ঘরের ময়লা জানালা দিয়ে ছুড়ে ফেলি, সর্বোপরি নিজের বাসার বাইরে পরিবেশের কী হচ্ছে তা নিয়ে ভাবার প্রয়োজন বোধ করি না! এই প্রয়োজন বোধ না করার কারণে যে সমস্যা তৈরি হয় তা হলো, রাজনৈতিক সরকার যখন একপাক্ষিকভাবে গবেষণা ছাড়াই চিন্তা করে, তখন তা হয় নগর সমস্যার সামাজিক অবস্থা না বোঝারই ফসল। হয়তো সে কারনেই মশা বাড়ছে, রোগ ছড়াচ্ছে প্রতিনিয়ত। তার উপর আবার রসাত্মক ঘটনাও আছে। তেমনই একটি ঘটনার শুরুটা দেখুন- ‘আমার স্ত্রী (নোটিশদাতার স্ত্রী) ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন এবং পাঁচ দিন হাসপাতালে থেকে আংশিক সুস্থতা লাভ করেন। যেহেতু এডিস মশা নিধনে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন পুরোপুরি ব্যর্থ, তাই এর দায়ভার তাদের নিতে হবে।’ এই মর্মে ৫০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ চেয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে একটি আইনি নোটিশ পাঠানো হয়েছে।
এখন কথা হলো- এক স্ত্রীর ডেঙ্গু হওয়ায় ৫০ লাখ টাকা গুণতে যদি হয় মেয়রকে, তাহলে ঢাকায় বর্তমানে শত শত নারী ডেঙ্গু আক্রান্ত, তাদের জন্য কত টাকা গুণতে হবে? হয়তো আইনী নোটিশকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে পার পাবেন মেয়র। কিন্তু তাতে করে রাজধানীবাসী কি পাবে বেপরোয়াা এই ডেঙ্গুর হাত থেকে মুক্তি? পাবে না। কেননা, নগর পিতা তেমন কোন উদ্যেগই নেননি নগরিকে ডেঙ্গুমুক্ত করার জন্য। বরং বিগত ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ঢাকা মহানগরীতে মশক নিধনের বাজেট ছিল ২১ কোটি টাকা। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে তা অর্ধশত কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। মশা নিধনের বাজেট বছর বছর এভাবে লাফিয়ে বাড়লেও নগরীতে মশা মোটেই কমেনি। বরং মশাবাহিত রোগে আক্রান্তের সংখ্যা দিন দিন আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। দুর্নীতির রাস্তায় গ্রসর হতে হতে দেশটা দুর্নীতির ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। যে কারনে বরাবরের মতোই নগর কর্তৃপক্ষের দাবি, কেবল মানুষ সচেতন হলেই মশা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। মশাবাহিত রোগের জন্য নগরবাসীর অসচেতনতাকেই দায়ী করছেন তারা। তবে নগর বিশেষজ্ঞদের অভিমত, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ভঙ্গুর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, অপরিকল্পিত উন্নয়ন কর্মযজ্ঞ ও জলাশয়গুলোর সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ না থাকাকে মশার বংশ বিস্তারের অন্যতম কারণ। এর আগে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে (ডিএসসিসি) মশা নিধনে বরাদ্দ ছিল ১২ কোটি ৫০ লাখ টাকা। ২০১৬-১৭ অর্থ বছরে ১১ কোটি ৫০ লক্ষ টাকা বরাদ্দ করা হলেও ২০১৭-১৮ অর্থ বছরে এ খাতে বরাদ্দ হয় ২৫ কোটি ৬০ লক্ষ টাকা। এর পরের বছর অর্থাৎ ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে মশক নিধন খাতে ২৬ কোটি টাকা বরাদ্দ করে সংস্থাটি। অপরদিকে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) ২০১৬-১৭ অর্থবছরে মশক নিধন খাতে বরাদ্দ করে ১১ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। ২০১৭-১৮ অর্থ বছরে ২০ কোটি। ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে ২১ কোটি টাকা। কিন্তু বছর বছর বাজেট বাড়লেও গত তিন বছরে মশাবাহিত রোগে আক্রান্তের সংখ্যা কমেনি। বেড়েছে কয়েকগুন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়ন্ত্রণকক্ষের হিসাব মতে, ২০১৫ সালে দেশে ৩ হাজার ১৬২ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন। ২০১৮ সালে এই সংখ্যা ছিল ১০ হাজার ১৪৮ জন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর মশাবাহিত রোগ বাড়ার দুটি কারণ চিহ্নিত করছে। প্রথম ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় অপরিকল্পিত নির্মাণযজ্ঞ। নগরীর বিভিন্ন এলাকায় ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে, চলছে রাস্তাঘাট নির্মাণ ও সংস্কার কাজ। রাস্তাঘাটসহ বিভিন্ন এলাকায় ও মাটি কেটে গর্ত করে রাখা হয়েছে। এসব জায়গায় ও চারপাশে সহজে পানি জমে থাকে। এছাড়া সার্বিকভাবে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে মশা বেড়ে গেছে। থেমে থেমে বৃষ্টি ও তাপমাত্রার পরিবর্তন এডিস মশা জন্মানোর অনুকূল পরিবেশ তৈরি করছে।
জাতীয় সুচিকিৎসা পরিষদ এক জরিপে ডিএনসিসি এলাকর তেজগাঁও, তুরাগ, পলস্নবী, মগবাজারে, উত্তরা, গুলশান, বনানী, কাফরুল, খিলগাঁও, রামপুরা, মিরপুর, পীরেরবাগ, মোহাম্মদপুর, শেওড়াপাড়া, কাজীপাড়া, বনানী, গুলশান, বারিধারায় সবচেয়ে বেশি এডিস মশার প্রজননক্ষেত্র হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের দয়াগঞ্জ, নারিন্দা, স্বামীবাগ, গেন্ডারিয়াসহ আশপাশের এলাকা, দক্ষিণ মুগদাপাড়া, বাসাবো, মানিকনগর বিশ্বরোড, শেরেবাংলা রোড, হাজারীবাগ, মগবাজার ও রমনা, সেগুনবাগিচা, শাহবাগ, হাজারীবাগ, ফরাশগঞ্জ, শ্যামপুর, উত্তর যাত্রাবাড়ীতে ডেঙ্গণর জন্য বেশি ঝুঁকিপূর্ণ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে।
আর রাজধানীর মশা নিয়ন্ত্রনে রাখতে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন ও ঢাকা মশক নিবারণী দপ্তরের ৯ শতাধিক কর্মী প্রতিদিন কাজ করছেন বললেও কার্যত কোন ফলাফল আসেেছ না। কেননা, এতে প্রতিটি ওয়ার্ডে অন্তত ৮ জন করে শ্রমিক কাজ করার কথা। এসব শ্রমিক সকালে নালা-নর্দমায় মশার লার্ভা ধ্বংস করার জন্য ওষুধ ছিটাবেন এবং বিকেলে স্প্রের মাধ্যেমে মশা প্রবণ এলাকাসহ প্রায় সব এলাকায় ঘুরে ঘুরে উড়ন্ত মশা নিধন করবেন। কিন্তু শ্রমিকরা সঠিকভাবে কাজ করছেন না বলে বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। সপ্তাহে এক বা দু’দিন নামকাওয়াস্তে ওষুধ ছিটাচ্ছেন তারা। বেশিরভাগ এলাকাতেই তাদের উপস্থিতি দেখতে পান না নগরবাসী। আর বরাদ্দকৃত ওষুধ সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেট বিক্রি করে দেয় বলেও অভিযোগ রয়েছে। ফলে প্রতি বছর বড় অঙ্কের অর্থ খরচ করেও কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। আমি মনে করি- সিটি করপোরেশনের মশক নিধনের দায়িত্বে থাকা কর্মীদের দেখা পান না নাগরিককরা। এসব এলাকায় করপোরেশনের মশা মারার জন্য ওষুধ ছিটানো বা ফগিংও দেখেননি। কোনো বড় প্রোগ্রাম না থাকলে মশক নিধনের কার্যক্রম সচরাচর চোখে পড়ে না। তবে সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা বলছেন, তাদের কর্মীরা নিয়মিত সকাল-বিকাল মাশার ওষুধ ছিটাচ্ছেন। মশার প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় এরই মধ্যে বিভিন্ন কর্মসূচি শুরু করেছে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। এ প্রসঙ্গে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেছেন, সবাই সচেতন হলে ডেঙ্গু চিকুনগুনিয়া দূর করা যাবে। বাড়ির আশপাশে জমে থাকা স্বচ্ছ পানিতে এসব রোগের বাহক এডিস মশা বংশ বিস্তার করে। তাই প্রতিটি নাগরিককে এ ব্যাপারে সচেতন হতে হবে। সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে মশক নিধনে নতুন ওষুধ আনা হয়েছে। যা আগের তুলনায় বেশি কার্যকর এবং এতে পরিবেশ ও স্বাস্থ্যের কোনো ক্ষতি হবে না বলে জানান তিনি।
মেয়রদ্বয় কথা বলেন বড় বড়, কাজ করেন ছোট থেকে ছোট। যে কারণে নির্মম ডেঙ্গুতে আক্রান্তর সংখ্য ক্রমশ বাড়ছে। অথচ তাারা কাজের চেয়ে বেশি কেবল কথাই বলছেন না, দুর্নীতিবাজদেরকে আশ্রয়-প্রশ্রয়ও দিচ্ছেন। তাঁর উদাহরণ- দক্ষিণ ঢাকার মেয়র বলেছেন, জনগণের সচেতনতাই ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া মোকাবেলার মূল হাতিয়ার। ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া হলে আতঙ্কিত না হয়ে সচেতন হতে হবে। তিনি সিটি করপোরেশনের ব্যর্থতার কথা বলেননি।
লেখক : চেয়ারম্যান, নতুনধারা বাংলাদেশ এনডিবি
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন