চলতি আগস্টের দ্বিতীয় সপ্তাহে বিশে^র ১৮০ কোটি মুসলমান পবিত্র ঈদুল আযহা উদযাপন করলেন। মুসলমানরা সারা বছরই নিজের কষ্টার্জিত টাকা থেকে অন্যদের দান করে থাকেন। কারণ দাতব্য ও জনহিতকর প্রেক্ষাপট বিবেচনা করলে মুসলমানরা হচ্ছেন বিশ্বের সর্বাধিক দানকারী ধর্মীয় সম্প্রদায়। এটা বিশেষ করে যুক্তরাজ্য ও উত্তর আমেরিকার মুসলমান সম্প্রদায়ের জন্য সত্য।
মুসলমানদের অর্থ দানের ভিত্তি হচ্ছে যাকাত যা বিদ্যমান ধন-সম্পদের ২.৫% সম্পদ কর। আশ্চর্য ব্যাপার যে বিভিন্ন মার্কিন বিলিওনেয়ার এবং ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশগ্রহণের আশাবাদীদের প্রস্তাবিত সম্পদ করও এমনটাই। ইসলামি দানশীলতা কি লুণ্ঠনমূলক পুঁজিবাদ সংস্কারের একটি সর্বোত্তম বøুপ্রিন্ট প্রদান এবং আমাদের বেদনাদায়ক অসম সমাজকে স্থিত করতে পারবে?
উদাহরণ স্বরূপ যুক্তরাজ্যের মুসলমানরা গড়ে প্রতি বছর প্রতিজনকে ৩৭১ পাউন্ড দান করে থাকেন। যার পরিমাণ ইহুদি সম্প্রদায় থেকে বেশি এবং খ্রিস্টানদের গড় দানের চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি। এ দানের পরিমান ঈদ ও রমজানের মত উপলক্ষগুলোতে অনেক বৃদ্ধি পায় এবং এটাই মুসলমান সম্প্রদায়ের চলমান ধারা।
এ ব্যাপারটি কিছু লোককে মুসলমান সম্প্রদায়ের সদস্যদের ‘চতুর্থ জরুরি সেবা’ হিসেবে উল্লেখ করার সুযোগ দিয়েছে। আর তার কারণ হচ্ছে দেশে ও বিদেশে প্রাকৃতিক বিপর্যয় মোকাবেলায় পেনি অ্যাপিল-এর মত মুসলমান নেতৃত্বাধীন দাতব্য সংস্থাগুলোর অবিশ্বাস্য কর্মকান্ড।
এই দাতব্য সংস্থা মুসলমরি ও অমুসলমান উভয়ের জন্য। যদিও ইসলামি দাতব্যগুলোর কিছু কিছু প্রধানত মুসলমানদের জন্যই। অন্যরা বৃহত্তর সমাজের জন্য। দানগ্রহীতার পশ্চাৎপট তাদের বিষয় নয়। শুরু থেকেই দান ইসলামের মর্মমূলে প্রোথিত। তবে এ দানকে সামাজিক পরিবর্তন সৃষ্টিতে ব্যবহার করার বিষয়ে সচেতন হয়ে ওঠার বিষয়টি সাম্প্রতিক কালের। বিশেষ করে যুক্তরাজ্য, ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার মুসলমান সম্প্রদায় ক্রমবর্ধমান ভাবে সম্পদশালী ও সমাজ বিষয়ে মনোযোগী হয়ে ওঠার সময় থেকে। যেখানে প্রথম প্রজন্মের অভিবাসীরা শুধু অস্তিত্ব রক্ষার জন্য ব্যাকুল ছিল। সেখানে তাদের সন্তান ও নাতি-পুতিরাও এখন প্রায়শই পেশাদার অথবা সম্পন্ন ব্যবসায়ী ব্যক্তিত্ব। তারা সামাজিক মঙ্গলে তাদের আয়ের অংশ ব্যয় করতে পছন্দ করে।
এটা বিশ্বব্যাপী এবং যুক্তরাজ্যে ক্রমবর্ধমান অসমতার প্রেক্ষাপটের বিরুদ্ধে। খাদ্য ব্যাংকের ব্যবহার সকল সময়ের চেয়ে সর্বোচ্চে। কল্যাণ ব্যবস্থা নিয়ে লড়াই চলছে এবং সমাজ ক্রমেই অধিক থেকে অধিকতর বিভক্ত হয়ে পড়ছে। এ ধরনের পরিস্থিতি যে কোনো স্থানেই অগ্রহণযোগ্য। তবে তা বিশেষভাবে অগ্রহণযোগ্য বিশে^র ধনী দেশগুলোর একটিতে।
সম্ভবত এর সমাধান খুঁজে পাওয়া যেতে পারে মুসলিম দানশীলতার ঐতিহ্যে। আমি ইতোমধ্যেই যা উল্লেখ করেছি, যাকাত সম্পদ কর হচ্ছে বিদ্যমান সম্পদের উপর হিসেবে বছরে মাত্র ২.৫% (তুলনামূলক ভাবে কম) অর্থ প্রদান।
‘যাকাত’ শব্দটি আরবি যার অর্থ বিশুদ্ধ করা এবং এটা হচ্ছে সেই ধরনের দাতব্য যার রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক ও অন্যায্য অসমতা থেকে সম্পদকে বিশুদ্ধ করার শক্তি।
যাকাতের মত সম্পদ করকে বিবেচনার দিক থেকে প্রচলিত নিয়ম বহির্ভূত মনে হতে পারে। কিন্তু ইতোমধ্যেই তা বহু মুসলিম দেশে বাস্তবায়িত হয়েছে। যাদের অর্থনীতি ইউরোপ বা উত্তর আমেরিকার দেশগুলোর সাথে সম্পূর্ণরূপে বেমানান নয়।
যাকাতের ন্যায় সম্পদ কর যা বৃহত্তর সমাজে মুসলমান দানশীলতার সমপর্যায়ের। তার প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সমর্থন গড়ে উঠছে। এটা বোঝা যায় যে নেতৃত্বের এক নতুন ঢেউ কঠোর পরিবর্তনের পক্ষে। অসমতার বিরুদ্ধে বাম ও ডানপন্থী দলগুলোর বহু দশকের নীতি ব্যর্থ মূলত ব্যর্থ হয়েছে।
মধ্য-ডান দলগুলো প্রবৃত্তিগত ভাবে বিশ্বাস করে যে অধিক পরিমাণ ব্যবসা-অনুক‚ল প্রণোদনা (যেমন কম কর) সমাজকে আরো সমতাপূর্ণ করবে। কারণ এসব থেকে ক্রমবর্ধমান বাণিজ্য কর রাজস্ব যোগাবে। যাহোক, বৃহত্তম ব্যবসাগুলো উচ্চ সম্পদশালী ব্যক্তিদের মত প্রায়ই কম কর দেয় বা কোনো করই প্রদান করে না।
এটা উচ্চ কর শুধু অকার্যকরই নয়, উল্টো ফলদায়ক বলে বামপন্থী দলগুলোর সমাধানকে এ রকম করেছে। ধনীরা যখন এত কম কর দিচ্ছে, তারা দরিদ্রদের আরো বেশি করে কর প্রদানে বাধ্য করছে। তখন আরো কর রশিদ প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে। এই দুষ্ট চক্র বহু বছর ধরে অসমতা বাড়িয়ে চলেছে। তাই কিছু পরিবর্তন প্রয়োজন। বিশেষ করে যখন স্থানীয় অসমতা অর্থনৈতিক বিড়ম্বনার পরিস্থিতি সৃষ্টি করে সামাজিক ও মতাদর্শগত বিভক্তি ছড়িয়ে দেয় যা চরম ডানপন্থীদের উত্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে।
বহু ব্যবসায়ী নেতা ও মধ্য-বাম রাজনীতিকরা একটি সম্পদ করের আহŸান জানিয়েছেন যা বস্তুগত ভাবে না হলেও ভাবার্থে তা যাকাতই। এ বছরের জুনে সম্ভাব্য প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীদের কাছে ১৮ জন ধনী আমেরিকান এক চিঠিতে এ ধরনের নীতি গ্রহণের আবেদন জানিয়েছেন। মনে হয়, এলিজাবেথ ওয়ারেন তার ডেমোক্র্যাটিক মনোনয়ন লাভের প্রচারণায় সম্পদ কর অন্তর্ভুক্ত করে তাদের আহŸানের ব্যাপারে মনোযোগ দিয়েছেন।
কৌত‚হলজনক বিষয় যে ক্ল্যাসিকাল ইসলামি আইনে আয়করকে নিপীড়ন বলে বিবেচনা করা হয়। আমরা যদি এক বছর যাবত আমাদের মালিকানায় থাকা সম্পদের উপর ২.৫% সম্পদ কর প্রদান করি, চরম ধনী ছাড়া বাকিরা দেখতে পাবেন যে তারা অনেক কম কর দিচ্ছেন।
এসব নীতি কোনোদিন আলোর মুখ দেখতে পাবে কিনা তা স্পষ্ট নয়। ততক্ষণ পর্যন্ত আমাদের সমাজকে মুসলমানদের নেতৃত্বাধীন, কিন্তু সকলের সমর্থিত দানশীলতার উপর নির্ভর করতে হবে।
(নিবন্ধকার আদীম ইউনিস, ব্রিটিশ ভিত্তিক যুক্তরাজ্যসহ বিশে^র ৩০টি দেশে কর্মরত মুসলিম দাতব্য প্রতিষ্ঠান পেনি আপিল-এর চেয়ারম্যান।)
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন