রোববার ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ইসলামী জীবন

আত্মহত্যা প্রতিরোধে ইসলাম

মুহা. জাকারিয়া শাহিন | প্রকাশের সময় : ২৩ আগস্ট, ২০১৯, ১২:০৩ এএম

ইসলাম সার্বজনীন বিশ্বমানবতার সংবেদনশীল একটি নীতি-আদর্শের রূপরেখা। এ ধর্মের সুশীতল ছায়ায় রয়েছে পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও বিশ্বমানব কল্যাণের সর্বোৎকৃষ্ট ব্যবস্থাপনা। নম্র-ভদ্র, শান্ত-শিষ্ট, আদর্শনিষ্ঠ ও আত্মপরিচর্চা এই ধর্মের গুণগত বৈশিষ্ট্য। গতিময় কর্মময় জীবনের স্রোত ধারায় ব্যাপক বাধা-বিপত্তি, কষ্ট-গøানি, ক্রোধ-ক্ষোভকে নিবারণ করতে না পারলে মানব জীবনে তৈরী করে দুঃখ বেদনার করুন ইতিহাস।সুশৃঙ্খল সাঝানো জীবনে ঘটে ব্যাপক ছন্দপতন। তখন দিক-দিগন্তে খুঁঁজে আশার বাণী-যা কলুষিত আত্মা কে নির্মল করবে শত যুগ ক্রমবিকাশের পর¤পরায় ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলেই ইসলাম ধর্মকে পেয়েছে পরশ পাথর সাদৃশ্য মুক্তা মানিক। তাইতো কবি নজরুল ইসলাম লিখে গেছেন,,,,

ইসলাম সে তো পরশ মানিক
তাকে কে পেয়েছে খুঁজি ,
পরশে তাহার সোনা হল যারা
তাদেরই মোরা বুঝি ।


মানুষ যখন নিজেকে রাগ-ক্ষোভ, দুঃখ-বেদনার কাল স্রোত থেকে সংযত, সংবরণ করতে ব্যর্থ হয়, তখনই তার মধ্যে বিরাজ করে মারামারি-কাটাকাটি, ফিতনা-ফাসাদ, অত্যাচার-অনাচার, হত্যা, রাহাজানিসহ নানান অপরাধের চিন্তা-চেতনা। এরূপ মুহূর্তে মানুষ নিজেকে হত্যা করার মত জঘন্য কাজটিও করে থাকে। তখন তার মধ্যে বিবেক-বুদ্ধি আত্মবোধ, মনুষত্ব বলতে কিছুই থাকে না। তার মধ্যে তখন থাকে মানবতাহীন আত্মঘাতিপূর্ণ চিন্তা-চেতনা। ভুলে যায় নিজেকে, সে বুঝতে পারেনা যে,আত্মহত্যা নামক জঘন্য কাজটি কেন করছে? কি লাভ হবে জীবনকে নিঃশেষ করে? এরূপ কঠিন রাগ-ক্ষোভের মুহূর্ত বয়ে আনে জীবনের মহা বিপর্যয়। পবিত্র কুরআন ও হাদীস শরীফ আত্মহত্যা থেকে পরিত্রাণের ব্যাপক পন্থা ও পথ নির্দশনা দিয়েছেন।হযরত আনাস রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, তোমাদের কারো কোন বিপদ বা কষ্ট হলে সে যেন মৃত্যু কামনা না করে। যদি কেউ এরূপ করতে চায, সে যেন বলে হে আল্লাহ তুমি আমাকে জীবিত রাখ যতক্ষণ পর্যন্ত জীবিত থাকা আমার জন্য কল্যাণকর এবং যখন আমার জন্য মৃত্যু কল্যাণকর তখন আমাকে মৃত্যু দাও।(বুখারী শরীফ-৫৮৭৪) আরও বর্ণিত আছে, হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু তা›য়ালা আনহু থেকে বর্ণিত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি লোককে কুস্তিতে হারিয়ে দেয় সে বাহাদুর নয়, বরং প্রকৃত বাহাদুর তো সেই যে রাগের মুহূর্তে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। (বুখারী শরীফ-৪৭২৩) আত্মহত্যা করার অন্যতম আরো একটি কারণ হলো নেশা করা। মানুষের বিবেক-বুদ্ধি রাগ, ক্ষোভ, ক্রোধের মধ্যে বিলীন হলে যেমন আত্মহত্যা সংঘটিত হয়, অনুরূপ নেশা করার ধরুণও মানুষ আত্মহত্যা করে। কারণ নেশাগ্রস্থ অবস্থায় মানুষের বিবেক বুদ্ধি লোপ পায়। ২০১৩ সালের ১৬ ই আগস্টের সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা, রাজধানীর চামেলীবাগে ঐশী রহমান নামে ১৯ বছরের কন্যা নিজেদের বাসায় আপন পিতা পুলিশ কর্মকর্তা মাহফুজুর রহমান ও মাতা স্বপ্না বেগমকে নেশাগ্রস্থ অবস্থায় হত্যা করে। নেশাগ্রস্থ অবস্থায় মানুষের থেকে এরূপ অসামাজিক ও আত্মঘাতী কর্মকান্ড প্রকাশিত হওয়াটা স্বাভাবিক। এ জন্য মহান আল্লাহ তায়ালা নেশাকে হারাম করেছেন। আল্লাহ তা›য়ালা বলেন “হে ঈমানদারগণ! মদ, জুয়া, প্রতিমা ও লটারী এ সব শয়তানের অপবিত্র কাজ। তোমরা তা হতে বিরত থাকো। আশা করা যায় যে, তোমরা সাফল্য লাভ করতে পারবে”। (সূরা মায়েদা-৯০)
মানুষ কেন আত্মহত্যা করে? এ প্রশ্নকে ব্যাপক বিশ্লেষণ ও গবেষণা করলে বহু কারণ আমাদের সামনে উপস্থাপিত হয়। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কারণ হলো-


স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মনোমালিন্য, যৌতুকের কারণে ঝগড়া বিবাদ
পিতা-মাতা ও ছেলে-মেয়ের মধ্যে মনোমালিন্য।
প্রেম-বিরহ, মিথ্যা অভিনয়ের ফাঁদে পড়া।
কারো কাছে পরাজয় বরণ করা।
ধন-দৌলত আত্মসাৎ হয়ে পুতুর হওয়া।
দীর্ঘস্থায়ী রোগ যন্ত্রণায় জীবন যাপন করা।
পরীক্ষায় ব্যর্থ হওয়া।
ব্যক্তি জীবনে লক্ষ-উদ্দেশ্য ও আত্মবোধ সম্পর্কে অবহিত না হওয়া।
ধর্মীয় রীতি-নীতি, আদর্শ সম্পর্কে অবগত না হওয়া।
জাতীয় পর্যায়ে ধর্মীয় ও নীতি-নৈতিকতাপূর্ণ শিক্ষা না থাকা।


বর্তমানে বিশ্বে মানুষের মৃত্যুর ২০ টি কারণের মধ্যে একটি অন্যতম কারণ হলো আত্মহত্যা। প্রতি ৪০ সেকেন্ডে বিশ্বের কোথাও না কোথাও কেউ না কেউ আত্মহত্যা করছে। মানবতার জন্য এ এক অপূরণীয় ক্ষতি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডঐঙ) এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, ২০১২ সালে বিশ্বে আত্মহত্যা করেছে ৮ লক্ষ মানুষ। এ সংখ্যা বর্তমান ২০১৮ সাল পর্যন্ত বেড়ে চলছে। আর “বাংলাদেশ পুলিশ সদর দপ্তর” থেকে এক প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশে ২০১১ সালে ৯,৬৪২ জন, ২০১২ সালে ১০,১০৮জন, ২০১৩ সালে ১৬,২৮৮ জন, ২০১৪ সালে ১৬,৭১৭ জন এবং ২০১৫ সালে ১৭,৬২৩ জন আত্মহত্যা করেছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডঐঙ) থেকে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী ২০১১ সালে আত্মহত্যায় বাংলাদেশর অবস্থান ছিল ৩৪ তম। বর্তমানে ১০ম স্থান অতিক্রম করছে। জাতীয় পর্যায়ে আত্মহত্যা প্রতিরোধের প্রচেষ্টা করলেও বিন্দু পরিমান সফল হয়নি। বাংলাদেশ কেন অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, নিউজিল্যান্ড, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের কয়েকটি দেশ সহ বিশ্বের ২৮ টি দেশ আত্মহত্যা প্রতিরোধের জন্য বিভিন্ন কৌশল তৈরী করছে কিন্তু তারা সফল হয়নি। সকলেই নিরোপায় নিস্তব্ধ হয়ে ব্যর্থতাকে বরণ করে নিয়েছে।


আত্মহত্যারোধ একমাত্র ধর্মীয় নীতি-আদর্শ বাস্তবায়ণের মাধ্যমেই সম্ভব। কারণ ধর্মীয় নীতি-আদর্শ মানুষকে আত্মবোধ, আত্মমর্যাদা ও নৈতিকতা শিক্ষা দেয়। অনৈতিক আত্মঘাতি কাজ থেকে বিরত রাখে। ইসলামে আত্মহত্যাকে কবিরা গুনাহ বা জঘন্য অপরাধ হিসাবে বিবেচিত করেছে। সকল ফকিহ্বিদ এবং চার মাযহাবের ইমামগণ আত্মহত্যাকে হারাম ফতোয়া দিয়েছেন। বিশ্বমানবতার সর্বশ্রেষ্ঠ সংবিধান কুরআন মাজীদে মহান আল্লাহ তা›য়ালা বলেন, ্রতোমরা নিজেদের হত্যা করো না ।নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের প্রতি দয়ালু। এবং যে কেউ জুলুম করে অন্যায়ভাবে তা (আত্মহত্যা) করবে, অবশ্যই আমি তাকে অগ্নিদগ্ধ করবো।আল্লাহর পক্ষে তা সহজ সাধ্য।(সূরা নিসা ২৯-৩০) হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে, হযরত ছাবিত বিন যিহাক রাদিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহু হতে বর্ণিত “যে ব্যক্তি দুনিয়াতে কোনো বস্তু দিয়ে নিজেকে হত্যা করবে, কেয়ামতের দিন তাকে সে বস্তু দিয়েই শাস্তি প্রদান করা হবে”।(বুখারী-৫,৭০০) হাদীস শরীফে আরো উল্লেখ হয়েছে, হযরত জাবের বিন সামুরা রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত তিনি বলেন, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সমীপে এক ব্যক্তিকে আনা হলো যিনি নিজেকে তরবারির ফলা দিয়ে হত্যা করেছে ।ফলে তিনি তার জানাজা পড়ালেন না ।(মুসলিম শরীফ) এছাড়াও হাদীস শরীফে আত্মহত্যা কারীর শাস্তি স¤পর্কে ব্যাপক আলোচনা করা হয়েছে ।
বিশ্বমানবতার মুক্তির দিশারী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাদীস শরীফে আত্মহত্যা থেকে পরিত্রাণের উপায় পদ্ধতি এবং এর পরিণাম ও ভয়াবহতার বর্ণনা করেছেন।প্রকৃতপক্ষে যে ব্যক্তি মহান আল্লাহ তা›য়ালা কে ভয় করে এবং হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে অনুসরণ করে, তার পক্ষে এরূপ আত্মঘাতি অন্যায় কাজ করা সম্ভব নয়।হযরত আতিয়্যাহ ইবনে উরওয়াহ সা’দী রাদিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহু হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, রাগ শয়তানের পক্ষ থেকে আসে এবং শয়তানকে আগুন দ্বারা সৃষ্টি করা হয়েছে।আগুন পানি দ্বারা নেভানো যায় ।যখন তোমাদের মধ্যে কারো রাগ আসে তবে সে যেন অজু করে। (আবু দাউদ শরীফ) অপর বর্ণনায় আছে, হযরত আবু যার রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওসাল্লাম বলেছেন, যখন তোমাদের কারো রাগ বা ক্রোধ হয়, সে যেন বসে পড়ে ।তাতেও রাগ না কমলে সে যেন চিৎ হয়ে শোয়ে পড়ে। (সুনান আহমদ)


মানুষের মৌলিক বৈশিষ্ট্য হলো অনুসরণ করা। ব্যক্তি জীবনে মানুষ যে আদর্শ বা ধর্মকে মনে প্রাণে গ্রহণ করে, তার পক্ষে এর নীতি-নিয়মের বিপরীত কাজ করা খুবই কঠিন।তবে যদি তাই হয়, তাহলে আমাদের দেশে শতকরা ৯৫ ভাগ ধর্মপ্রাণ মানুষ বসবাস করা সত্তেও কেন এত অনৈতিক কর্মকান্ড প্রতিনিয়ত ঘটছে? এর কারণ কী? এর অন্যতম কারণ হলো শতকরা ৯৫ ভাগ মানুষ ধর্মের পরিচয় দেয়, কিন্তু শতকরা ৯৫ ভাগ মানুষ ধর্মের অনুসরণ করে না। সা¤প্রতিক গবেষণায় দেখা যায়, শতকরা ২৫ ভাগ মানুষ ধর্মীয় নীতি আদর্শের অনুসরণ করছে। এ ২৫ ভাগ মানুষ থেকে কখনো রাষ্ট্রীয়, সামাজিক, পারিবারিক অঙ্গনে অনৈতিক কাজ প্রকাশিত হয় না। এ সব মানুষই প্রকৃত শিক্ষিত ও ধর্মের অনুসারী।
জাতীয় পর্যায়ে আত্মহত্যা রোধ করতে হলে অবশ্যই জাতীয় পর্যায়ে প্রত্যেকটি বিভাগ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কর্মক্ষেত্রে ও দেশব্যাপী ইসলামী আদর্শ বাস্তবায়ন করতে হবে। বিশেষ করে সকল স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটিতে ধর্মীয় শিক্ষা আবশ্যকীয় করতে হবে। এতে অতি সল্প সময়ে মানব জীবনে মূল্যবোধ, নীতি-নৈতিকতা, আত্মপরিচয়বোধ অর্জন হবে। ফলে প্রতিষ্ঠিত হবে আত্মহত্যা মুক্ত নিরাপদ সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবন।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
shahadat hossain ২৪ আগস্ট, ২০১৯, ২:০৮ পিএম says : 0
good
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন