শিক্ষকের বিরুদ্ধে অপমানের অভিযোগ এনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু হল শাখা ছাত্রলীগের এক নেতা আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন। ওই ছাত্রলীগ নেতার নাম এস এম এহসান উল্লাহ ওরফে ধ্রুব। তিনি হল শাখা ছাত্রলীগের প্রশিক্ষণবিষয়ক উপসম্পাদক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী।
বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে আটটার দিকে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক প্রফেসর তানজীমউদ্দিন খানের নাম উল্লেখ করে তাঁর বিরুদ্ধে ‘অপমান’ ও ‘অন্যায়ের’ অভিযোগ তুলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে একটি পোস্ট দেন এহসান। যেখানে তিনি আত্মহত্যার ইঙ্গিত দেন। উক্ত পোস্ট দেওয়ার পর প্রায় ৪ ঘন্টা তিনি নিখোঁজ ছিলেন বলে জানা যায়।
এহসানের খোঁজ না পেয়ে বৃহস্পতিবার রাত পৌনে একটার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির বাসভবনের সামনে অবস্থান নেয় বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এ সময় বিভিন্ন হল থেকে নেতাকর্মীদের ঘুম ভাঙিয়ে সেখানে জড়ো করে ছাত্রলীগ। এসময় তারা ‘শিক্ষকদের নগ্ন কাজ, রুখে দাঁড়াও ছাত্রসমাজ’, ‘শিক্ষার্থীর ওপর নির্যাতন কেন, প্রশাসন জবাব চাই’, ‘শিক্ষকদের কালো হাত, ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও’, ‘আমার ভাই নিখোঁজ কেন, প্রশাসন জবাব চাই’ ইত্যাদি স্লোগান দেন।
পরে দিবাগত রাত দেড়টার দিকে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ হলের পুকুরপাড়ে এহসানের খোঁজ মেলে। তাঁকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নেওয়া হয়। তিনি একসঙ্গে অনেকগুলো ঘুমের ওষুধ খেয়েছিলেন বলে তাঁর রাজনৈতিক সহকর্মীদের ভাষ্য। এহসানের ফেসবুক পোস্টে একই ইঙ্গিত রয়েছে।
এহসানকে খুঁজে পাওয়ার খবর পেয়েও অবস্থান থেকে সরেনি ছাত্রলীগ। এসময় সেখানে যান শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের চেয়ারপারসন ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর।
এসময় ঢাবি শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকত বলেন, স্যার ক্লাসে সবার সামনে তাকে অপমান করেছেন। স্যারের ভাষ্যমতে, একটা ছেলে যদি ছাত্রলীগ করেন তাহলে সে বকাটেদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেল। একজন শিক্ষক কিভাবে ছাত্রকে এভাবে র্যাগিং করতে পারে? এই সংস্কৃতি তো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল না!
শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি মাজহারুল কবীর শয়ন বলেন, অভিযোগ রয়েছে ছাত্রলীগের ছেলেদের ভিন্ন চোখে দেখা হয়, প্রায়ই অপমান অপদস্থ করা হয় এবং শিক্ষার্থীরা আমাদের জানিয়েছেন যে আমরা প্রায়ই শিক্ষকদের কাছে বৈষম্যের শিকার হই। তাই আমরা এই ঘটনার তদন্ত সাপেক্ষে একটি সুস্থ সমাধান চাই।
এসময়ই আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের চেয়ারপার্সন ড. লাইলুফার ইয়াসমিন বলেন, আমি ঘটনাটা জানতে পেরেছি রাত আটটার দিকে। আমি আমার সিনিয়র শিক্ষকদের বিষয়টি অবহিত করেছি। আমরা উভয় পক্ষের সাথে কথা বলে একটি সুষ্ঠু ব্যবস্থা নেব। তবে আমি আমার বিভাগের অভিভাবক হিসেবে বলতে পারি, অন্যান্য বিভাগে কি হয় না হয় জানি না তবে এই ধরনের কোন ঘটনার নজির আমার বিভাগে নেই।
অন্যদিকে রাতভর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা প্রফেসর তানজিম উদ্দীন খানকে নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্য করে যান। তাদের ভাষ্যমতে একমাত্র ছাত্রলীগ করার কারণে তানজিম উদ্দীন খান ধ্রুবকে অপমান অপদস্থ করেছেন। ধ্রুব সেটা সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন।
তবে বিভাগের সহপাঠী ও অন্যান্য ছাত্র সংগঠনের নেতাদের মুখে শোনা যায় ভিন্ন কথা। তাদের মতে, প্রফেসর তানজিম উদ্দীন খানের সাথে ছাত্রলীগের এই বৈরিতা নতুন নয়। ২০১৮ সালে কোটা সংস্কার আন্দোলনে ছাত্রলীগের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে শিক্ষার্থীদের পক্ষে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন প্রফেসর তানজিম উদ্দিন খান। সেই থেকে তিনি ছাত্রলীগের চক্ষুশূল বলে পরিচিত। বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যম ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ করায় উনাকে ফাঁসানোর একটা নীল নকশা করেছেন ছাত্রলীগ। বিভাগের সকল সহপাঠীদের কাছে তানজিম উদ্দিন খান অন্যতম পছন্দের শিক্ষক হিসেবে পরিচিত। ধ্রুবর সাথে ঘটে যাওয়া সেদিনের সেই ঘটনায় স্যারের ভূমিকা একজন অভিভাবক ছাড়া কিছুই ছিল না বলে মন্তব্য করেন বিভাগের অনেক শিক্ষার্থী। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ নিয়ে অন্তত ৫০টি স্ট্যাটাস চোখে পড়ে।
জানা যায়, দীর্ঘদিন ধরে বিভাগের এক মেয়ে শিক্ষার্থীকে হ্যারাসমেন্ট করে আসছেন ধ্রুব। এমনকি নিজে আত্মহত্যা করে ওই মেয়েকে ফাঁসানোর নীল নকশাও করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। আর প্রফেসর তানজিম উদ্দীন খান এমনটা করা থেকে তাকে বাধা দেয়ায় উনাকে ফাঁসানো হচ্ছে বলে অভিযোগ সহপাঠীদের।
প্রফেসর তানজীমউদ্দিন গতকাল শুক্রবার সকালে তাঁর ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে বলেন, চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী এহসান দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠুক, এটাই তাঁর এ মুহূর্তের একমাত্র কামনা। এহসান এখন অনেকটা ভালো আছেন। তিনি পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠুন। তারপর আসল সত্যটা জানা সবার জন্য জরুরি। তবে এহসানের ফেসবুক স্ট্যাটাস ও আত্মহনন চেষ্টা নিয়ে যে রকম নোংরামি শুরু হয়েছে, সেটা নিয়ে তিনি খুবই মর্মাহত ও হতাশ।
ঢাবির প্রক্টর এ কে এম গোলাম রব্বানী বলেন, বিভাগের চেয়ারম্যান বিষয়টি সম্পর্কে অবহিত হয়েছেন। এ নিয়ে কীভাবে অগ্রসর হওয়া যায়, সে ব্যাপারে তিনি বিভাগের একাডেমিক কমিটি ও শিক্ষকদের সঙ্গে আলোচনা করবেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন