শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

গার্মেন্টস শিল্প রক্ষায় সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়কে দৃষ্টি দিতে হবে

| প্রকাশের সময় : ৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৯, ১২:০৩ এএম

দেশের অন্যতম প্রধান রপ্তানিখাত গার্মেন্টস শিল্প এখন বহুবিদ সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ক্রেতা সংকট, অ্যাকর্ড-অ্যালায়েন্স জোটের খবরদারি, বস্ত্র ও সুতার বাজার নিয়ে কারসাজি, সরকারের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় ও পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধার অভাবসহ অন্যান্য সমস্যার কারণে এ খাতটি দিন দিন নাজুক পরিস্থিতির দিকে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে, নানা সংকটে পড়ে অসংখ্য গার্মেন্টস শিল্প বন্ধ হয়ে গেছে। অনেক বড় বড় গার্মেন্টস কারখানা খরচ কুলিয়ে উঠতে না পারায় শ্রমিক ছাঁটাই করছে। এই দুইয়ে মিলিয়ে হাজার হাজার শ্রমিক বেকার এবং বেকার হওয়ার মুখোমুখি হচ্ছে। ইউরোপ-আমেরিকার ক্রেতা জোট অ্যাকর্ড-অ্যালায়েন্স রানা প্লাজা ধসের এক উসিলায় গার্মেন্টস শিল্পে কমপ্লায়েন্স বা নিরাপদ ও কর্মপোযোগী পরিবেশ সৃষ্টির জন্য নানা ধরনের চাপ প্রয়োগ করা শুরু করে এবং এখনো করে যাচ্ছে। তাদের কথামতো অসংখ্য গার্মেন্টস কমপ্লায়েন্সের কাজ সম্পন্ন এবং অব্যাহত রাখলেও তারা নতুন করে একের পর এক শর্ত জুড়ে দিচ্ছে। এ কাজ এবং শর্ত পূরণ করতে গিয়ে গার্মেন্টস কারখানাগুলোর শত শত কোটি টাকা ব্যয় হলেও ক্রেতা জোটের মাধ্যমে রপ্তানি বৃদ্ধি করে এ অর্থ তুলে নেয়ার সুযোগও পাচ্ছে না। ক্রেতা জোটের ক্রমাগত শর্ত দেয়া এবং তা মেনে গার্মেন্টস মালিকরা কাজ করলেও পোশাকের দাম তারা বাড়াচ্ছে না। দেখা যাচ্ছে, দশ বছর আগেও যে দামে পোশাক তারা ক্রয় করত, এখনও একই দামে বা তার চেয়েও কম দামে ক্রয় করছে। মূল্যবৃদ্ধি করছে না। এতে খরচ মিটিয়ে গার্মেন্টস কারখানাগুলো লোকসানের মুখোমুখি হচ্ছে। অন্যদিকে এ শিল্পের সাথে সম্পর্কযুক্ত দেশীয় সুতা ও বস্ত্রশিল্পও ধ্বংসের পথে। এ শিল্পের সাথে জড়িত কিছু শিল্প কারখানা বন্ড সুবিধার আওতায় ভারত থেকে সুতা আমদানি করে কম দামে বিক্রি করে দেশের সুতা ও বস্ত্রশিল্পকে হুমকির মুখে ফেলে দিচ্ছে। যেখানে দেশি এক কেজি সুতার দাম আড়াই ডলার, সেখানে বন্ড সুবিধার আওতায় এলসিতে ৩ ডলার দেখিয়ে দেশে এনে বিক্রি করছে ২ ডলার ৩০ সেন্ট। এতে দেশের সুতা ও বস্ত্রশিল্প ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। এ ধরনের নানা সংকটের কারণে পুরো গার্মেন্টস শিল্প এখন মারাত্মক হুমকির মুখে রয়েছে।
দেশের রপ্তানি আয়ের ৮৩ ভাগ আহরিত হয় গার্মেন্টস শিল্পের মাধ্যমে। রপ্তানির দিক থেকে এ শিল্প শীর্ষে। ’৮০ দশকের শুরুর দিকে শুরু হওয়া এ শিল্প কালক্রমে বিস্তার লাভ করে বিশাল শিল্পে রূপ লাভ করে। বর্তমানে প্রায় ৫ হাজার গার্মেন্টস কারখানা রয়েছে। এর সাথে সুতা ও বস্ত্রসহ বিভিন্ন এক্সেসরিজের কয়েক হাজার কারখানা জড়িত। কর্মসংস্থানের সবচেয়ে বড় একটি মাধ্যম হিসেবে কাজ করছে পুরো গার্মেন্টস খাত। প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিক এ খাতের সাথে যুক্ত। এ খাতে বিশ্বে চীনের পরই বাংলাদেশের অবস্থান। খাতটিকে আরও এগিয়ে নিতে ২০২১ সালের মধ্যে ৫০ বিলিয়ন ডলার রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। গত অর্থবছরে এ খাত থেকে আয় হয়েছে ৩২ বিলিয়ন ডলার। আশঙ্কা দেখা দিয়েছে, বর্তমানে এ খাত যেসব সমস্যার সম্মুখীন, তা অব্যাহত থাকলে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব হবে না। বরং কমতে থাকবে। ইতোমধ্যে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৭ সালের মধ্যে বাংলাদেশ স্বল্পন্নোত দেশ (এলডিসি) থেকে বের হয়ে উন্নয়নশীল দেশের পরিণত হওয়ার যে গ্র্যাজুয়েশন লাভ করবে, তাতে প্রতি বছর ৭ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি আয় হারাবে। ২০৩১ সালের মধ্যে তা প্রায় দ্বিগুণ হয়ে ১৩ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়াবে। এর কারণ এখন ইউরোপ-আমেরিকায় রপ্তানি খাতে যে শুল্কমুক্ত সুবিধা পাচ্ছে, উন্নয়নশীল দেশ হলে তা আর পাবে না। নির্দিষ্ট হারে শুল্ক দিয়ে রপ্তানি করতে হবে। তখন রপ্তানি ব্যয় উল্লেখিত হারে বেড়ে যাবে। এ পরিস্থিতি মোকাবেলায় এখন থেকে রপ্তানি সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সাথে দ্বিপাক্ষিক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতার উদ্যোগ না নিলে রপ্তানি খাত বিপর্যয়ের মুখে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ বিপর্যয় ঠেকাতে মুখ্য ভূমিকা পালন করতে পারে প্রধানতম রপ্তানি খাত গার্মেন্টস শিল্প। দেখা যাচ্ছে, এ খাতটিই এখন বহুমুখী সমস্যার মধ্যে পড়েছে এবং মুখোমুখি হচ্ছে। বলা বাহুল্য, উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা ধরে রাখতে এ শিল্পকে ধরে রাখা এবং এর উন্নয়ন ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। তা নাহলে প্রতিবছরই রপ্তানি খাতে লোকসান হতে থাকবে এবং এক পর্যায়ে গার্মেন্টস শিল্প ধ্বংস হয়ে যাবে। গার্মেন্টস খাতের মাধ্যমে দেশের যে ৮৩ ভাগ রপ্তানি হয়, তা যেমন হারিয়ে যাবে তেমনি রপ্তানি বাণিজ্যে বিপর্যয়কর পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। এক সময় প্রধান রপ্তানি খাত পাটের মতোই খাতটি করুণ দশায় উপনীত হবে। এখন গার্মেন্টস খাতে যেভাবে কারখানা বন্ধ ও শ্রমিক ছাঁটাই হচ্ছে, নানামুখী সমস্যা দেখা দিচ্ছে, এগুলো এ খাত ধ্বংসেরই পদধ্বণি। উপর দিয়ে যতই ঝলমলে দেখাক না কেন, ভেতরে ভেতরে খাতটি ক্ষয়ে যাচ্ছে। এ খাতে যে আয় হয়, তার সিংহভাগই এর বিভিন্ন উপকরণের আমদানির মাধ্যমেই চলে যায়। থাকে শুধু শ্রমিকের মজুরি বা অনেকটা টেইলারের মতো-যার কাজ মজুরির বিনিময়ে অন্যের কাপড় কেটে সেলাই করে পোশাক বানিয়ে দেয়া। উল্লেখ করা প্রয়োজন, গার্মেন্টস খাতের বর্তমান সংকটের মতো পাট খাত ধ্বংস হওয়ার আগেও এমন সমস্যা ও সংকট দেখা দিয়েছিল। তখন এ নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। এই না নেয়াতে খাতটি এখন তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। এখন পাটের উন্নয়ন ও রপ্তানি বৃদ্ধি নিয়ে অনেক সভা-সেমিনার, পরিকল্পনা করেও কোনো কাজ হচ্ছে না। দেশের অর্থনীতির একটি প্রতিষ্ঠিত রপ্তানি খাতের এভাবে পতন দুর্ভাগ্য ছাড়া আর কী হতে পারে! যে গার্মেন্টস শিল্প উদ্যোক্তার উদ্যোগ এবং শ্রমিকের শ্রমে-ঘামে গড়ে উঠে বিশ্বের দ্বিতীয় শীর্ষ রপ্তানি খাতে পরিণত হয়েছে, নানামুখি সমস্যায় এর নিম্নগামী হয়ে পড়া দেশের অর্থনীতির জন্য অশনি সংকেত।
গার্মেন্টস শিল্প রক্ষায় সরকারের খুব একটা নজর রয়েছে বলে প্রতীয়মাণ হচ্ছে না। সরকার তার অন্যান্য নতুন অর্থনৈতিক প্রকল্প নিয়ে বেশি মনোযোগী। একটি প্রতিষ্ঠিত খাত যে সমস্যায় জর্জরিত হয়ে ন্ব্জ্যু হয়ে পড়ছে, এদিকে খেয়াল দিচ্ছে না। এ খাতটির পরিণতি যদি পাটের মতোই হয়, তবে কি তা পুণরায় গড়ে তোলা সম্ভব হবে? এ শিল্পটি তো শুধু দেশের রপ্তানি বাণিজ্যের সাথে জড়িত নয়, পরিবার ও সমাজের সাথেও ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। এর বিপর্যয় ঘটলে, এর ভয়াবহ প্রতিক্রিয়া পুরো সমাজ এমনকি রাষ্ট্রের ওপর পড়বে। এমনিতেই দেশে কর্মসংস্থানের তীব্র সংকট রয়েছে, রয়েছে বিশেষায়িত দক্ষ শ্রমিকের অভাব, এর সাথে যদি গার্মেন্টস খাতের লাখ লাখ বেকার যুক্ত হয়, তখন পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ হবে, তা কল্পনাও করা যায় না। এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে যাতে পড়তে না হয় এবং গার্মেন্টস খাত আরও উন্নত হয়, এ দিকটায় নজর দেয়া এখন সবচেয়ে বেশি জরুরি। এ খাতের সমস্যা সমাধানে বিজিএমই যে কার্যকর ভূমিকা পালন করছে, তা বলা যাচ্ছে না। তাদের কার্যক্রম বক্তব্য-বিবৃতির মধ্যে সীমাবদ্ধ। পুরো খাতটি কি সমস্যা মোকাবেলা করছে এবং কিভাবে তার সমাধান করা যায়, এ নিয়ে সংগঠনটির উদ্যোগ দৃশ্যমান নয়। আমরা মনে করি, গার্মেন্টস শিল্পের চলমান সমস্যা ও সংকট সমাধানে কার্যকর উদ্যোগ নেয়া এবং এর সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধিতে অর্থনীতির স্বার্থে সরকারের সার্বোচ্চ পর্যায়ের দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন। পাশাপাশি দেশের সুতা ও বস্ত্র শিল্প যে সমস্যা মোকাবেলা করছে, তার সমাধান এবং রক্ষায় উদ্যোগ নিতে হবে। প্রয়োজনে বিদেশ থেকে সুতা আমদানি বন্ধ করে দিয়ে দেশীয় এ শিল্পকে রক্ষা করতে হবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন