পবিত্র আশূরা আজ। মুহাররম মাসের দশ তারিখ। পৃথিবীর ইতিহাসে এই দিনটি অনেকগুলো ঘটনার জন্য বিখ্যাত হয়ে আছে। মূসা (আ.) ও তাঁর সঙ্গিসাথীদের ফিরআউনের কবল থেকে বাঁচার দিন হিসেবে শুকরিয়া স্বরূপ মহানবী (সা.) ও সাহাবায়ে কেরাম রোযা পালন করেছেন। বলা হয়, এই দিনে আসমান ও যমিন সৃষ্টি করা হয়েছিল, পৃথিবীর প্রথম মানুষ আদম-কে সৃষ্টি করা হয়েছিল, আল্লাহ নবীগণকে স্ব স্ব শত্রুর হাত থেকে আশ্রয় প্রদান করেছেন। এই দিন নবী মুসা-এর শত্রু ফেরাউনকে নীল নদে ডুবিয়ে দেয়া হয়। নূহ-এর কিস্তি ঝড়ের কবল থেকে রক্ষা পেয়েছিলো এবং তিনি জুদি পর্বতশৃঙ্গে নোঙর ফেলেছিলেন। এই দিনে দাউদ-এর তাওবা কবুল হয়েছিলো, নমরূদের অগ্নিকুন্ড থেকে ইব্রাহীম উদ্ধার পেয়েছিলেন; আইয়ুব দুরারোগ্য ব্যাধি থেকে মুক্ত ও সুস্থতা লাভ করেছিলেন, আল্লাহ তা’আলা ঈসা-কে ঊর্ধ্বাকাশে উঠিয়ে নিয়েছেন। প্রচলিত আছে যে, এই তারিখেই কেয়ামত সংঘটিত হবে; যদিও এসব বিষয়েই মতভিন্নতা রয়েছে।
গতকালের আলোচনায় আমরা জেনেছি যে, শীর্ষ সাহাবাদের অনেকের অমত সত্ত্বেও কুফা রওনা হবার পর তাঁর চাচাতো ভাই মুসলিম ইবনে আকীলের পত্র পেয়ে মহানবী (স.)-এর দৌহিত্র হুসাইন বিন আলী (রা.)ইয়াজিদের এলাকা ছেড়ে চিরতরে অন্যত্র চলে যেতে চাইলেন। কিন্তু ইয়াজিদের সৈন্যরা বিশেষ করে আমর বিন সাদ, সীমার বিন যুল-জাওশান ও হুসাইন বিন তামীমের নেতৃত্বে তাঁর গতিরোধ করল।
তিনি তাদের তিনটি প্রস্তাব দিলেও তারা কোন প্রস্তাব মানতে রাজি হয়নি। ইয়াজিদ বাহিনীর অন্যতম সেনাপতি হুর বিন ইয়াজিদ হুসাইন বিন আলী (রা.)-এর প্রস্তাব মানতে বললেও তাতে রাজি হয়নি উবায়দুল্লাহ বিন যিয়াদের সৈন্যরা। অবশেষে নিজ বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেই শাহাদাতবরণ করেন হুর বিন ইয়াজিদ। সংখ্যায় হুসাইন (রা.)-এর সাথী ও ইয়াজিদ বাহিনীর মধ্যে বিশাল ফারাক ছিল। হুসাইন (রা.)-এর সামনেই তাঁর সব সাথী বীরত্বের সাথে লড়াই করে নিহত হন। অবশেষে তিনি ছাড়া আর কেউ জীবিত রইলেন না। তিনি ছিলেন সিংহের মতো সাহসী বীর। কিন্তু সংখ্যাধিক্যের মোকাবিলায় তাঁর পক্ষে ময়দানে টিকে থাকা সম্ভব হল না। কুফাবাসী প্রতিটি সৈনিকের কামনা ছিল সে ছাড়া অন্য কেউ হুসাইন (রা.)-কে হত্যা করে ফেলুক। যাতে তার হাত রসূল (স.)-এর দৌহিত্রের রক্তে রঞ্জিত না হয়। পরিশেষে নিকৃষ্ট এক ব্যক্তি হুসাইন (রা.) কে হত্যায় উদ্যত হয়। তার নাম ছিল সীমার বিন যুল-জাওশান। সে বর্শা দিয়ে হুসাইন (রা.)-এর শরীরে আঘাত করে ধরাশায়ী করে ফেলে। অতঃপর ইয়াজিদ বাহিনীর সম্মিলিত আক্রমণে ৬১ হিজরীর ১০ মুহাররম পবিত্র আশূরার দিনে ৫৭ বছর বয়সে শাহাদাতের সৌভাগ্য অর্জন করেন হুসাইন ইবনে আলী (রা.)। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিঊন। বলা হয়ে থাকে, এই সীমারই হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহুর মাথা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। কেউ কেউ বলেন, সিনান বিন আনাস আন-নাখঈ নামক এক ব্যক্তি তাঁর মাথা দেহ থেকে আলাদা করে।
কারবালা প্রান্তরে আলী (রা.)-এর সন্তানদের মধ্যে আরো নিহত হন আবু বকর, মুহাম্মদ, উসমান, জাফর এবং আব্বাস। হুসাইন (রা.)-এর সন্তানদের মধ্যে আবু বকর, উমর, উসমান, আলী আকবর ও আব্দুল্লাহ হাসানের সন্তানদের মধ্যে আবু বকর, উমর, আব্দুল্লাহ এবং কাসেম, আকীলের সন্তানদের মধ্যে জাফর, আব্দুর রহমান এবং আব্দুল্লাহ বিন মুসলিম বিন আকীল, আব্দুল্লাহ বিন জাফরের সন্তানদের মধ্যে আউন এবং আব্দুল্লাহ। এর আগে উবায়দুল্লাহ বিন যিয়াদের নির্দেশে হুসাইন (রা.)-এর চাচাতো ভাই মুসলিম বিন আকীলকে হত্যা করা হয়।
আজকের কর্মসূচি
আজ যথাযোগ্য ধর্মীয় মর্যাদা ও নানা কর্মসূচির মধ্যদিয়ে পবিত্র আশুরা পালিত হবে। এ উপলক্ষে প্রেসিডেন্ট মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন। আজ সরকারি ছুটি।
কারবালার ঘটনা স্মরণ করে রাজধানী ঢাকাসহ দেশব্যাপী বিভিন্ন ধর্মীয় সংগঠন নানা কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। আজ হোসনি দালানসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় তাজিয়া মিছিল বের হবে। দিবসটি উপলক্ষে বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক বিশেষ প্রবন্ধ, নিবন্ধ প্রকাশ করবে। বাংলাদেশ বেতার ও বাংলাদেশ টেলিভিশনসহ বিভিন্ন বেসরকারি রেডিও এবং স্যাটেলাইট টেলিভিশন চ্যানেলও এই দিনের তাৎপর্য তুলে ধরে বিশেষ অনুষ্ঠানমালা সম্প্রচার করবে।
এদিকে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার মো. আছাদুজ্জামান মিয়া পবিত্র আশুরা উপলক্ষে তাজিয়া শোক মিছিলে নিñিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানিয়েছেন। রাজধানীর বড় কাটারা ইমামবাড়া, খোজা শিয়া অনুসারী ইমামবাড়া এবং বিবি কা রওজায় পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। প্রতিটি ইমামবাড়া সিসি ক্যামেরার আওতায় আনা হয়েছে। আর্চওয়ে ও মেটাল ডিটেক্টর দিয়ে প্রত্যেক দর্শনার্থীর দেহ তল্লাশি করে অনুষ্ঠানস্থলে প্রবেশ করানো হবে বলেও ডিএমপি কমিশনার উল্লেখ করেন।
এছাড়াও এবছর তাজিয়া মিছিলে ঢোল বাজিয়ে ছুরি, তলোয়ার ও লাঠিখেলা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ডিএমপি কমিশনার ইতোমধ্যেই জানিয়েছেন, নিরাপত্তার স্বার্থে এসব নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তাজিয়া মিছিলে ১২ ফুটের বেশি বড় নিশান, ব্যাগ, পোঁটলা, টিফিন ক্যারিয়ার বহন এবং আগুনের ব্যবহার করা যাবে না। মাঝপথে কেউ মিছিলে অংশ নিতেও পারবেন না বলে তিনি উল্লেখ করেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন