আজ পবিত্র আশুরা। হিজরি বর্ষপঞ্জির প্রথম মাসের দশম দিবস। ইতিহাসের বহু ঘটনার স্মৃতিবাহী হলেও এই দিনটি বিশ্বনবী হযরত মুহম্মদ (সাঃ) এর দৌহিত্র হযরত ইমাম হোসাইন (রাঃ)-এর শাহাদত দিবস হিসেবে ব্যাপকভাবে পালিত হয়ে থাকে। কারবালার প্রান্তরে বিতর্কিত শাসক ইয়াযিদের সেনাবাহিনীর হাতে তিনি পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে শাহাদত বরণ করেন। গোটা মুসলিম বিশ্বে এই শাহাদত দিবস যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হয়ে থাকে। মানব ইতিহাসের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা এদিনে সংঘটিত হয়েছে এবং ভবিষ্যতেও হবে বলে বর্ণনা পাওয়া যায়। বলা হয়ে থাকে, এদিনেই জগৎ সৃষ্টির সূচনা হয়। এদিনেই প্রথম মানব ও নবী হযরত আদম (আঃ)কে সৃষ্টি করা হয়। এদিনেই তাকে দুনিয়ায় পাঠানো হয়। হযরত নূহ (আঃ) এদিনেই মহাপ্লাবন থেকে স্থলভাগে অবতরণ করেন। এদিনেই হযরত আইয়ূব (আঃ) রোগমুক্ত হন। হযরত ইউনূস (আঃ) মাছের পেট থেকে মুক্তিলাভ করেন। হযরত ইব্রাহিম (আঃ) নমরুদের অগ্নিকা- থেকে নিরাপদে বের হয়ে আসেন। হযরত সুলাইমান (আঃ) বাদশাহী লাভ করেন। এই দিনেই হযরত মূসা (আঃ) ফেরাউনের আক্রমণ থেকে মুক্তিপান এবং আল্লাহর অনুগ্রহে হযরত মূসা (আঃ) নীল নদ পার হলেও ফেরাউন নীলনদে ডুবে মারা যায়। হযরত মূসা (আঃ) এই দিনই আল্লাহর সাথে কথোপকথন করেন এবং মুক্তির উপতক্যায় পৌঁছান। এই দিন হযরত ঈসা (আঃ)কে আসমানে তুলে নেয়া হয়। এদিনেই হযরত আদম (আঃ) ও হযরত দাউদ (আঃ)-এর তওবা কবুল হয়। হযরত ইউসুফ (আঃ) পিতা ইয়াকুব-এর সঙ্গে মিলিত হন। এ দিনটির ঐতিহাসিক গুরুত্বের কারণেই আশুরা একটি পবিত্র দিবস।
নবী-রাসূলদের জীবনে সংঘটিত মোজেজা ও ইতিহাসের বাঁক পরিবর্তনকারী অসংখ্য ঘটনার কারণে মানুষ সৃষ্টির শুরু থেকে এ দিবসটি বিশেষ মর্যাদায় অভিষিক্ত হয়ে আছে। আল্লাহর রাসূলের দৌহিত্র হযরত ইমাম হোসাইনের শাহাদত দিবস হিসেবে এ দিনটি বিশেষ গুরুত্বের সাথে বিবেচিত। মহানবী (সাঃ)এর ওফাতের ৫০ বছর পর তার প্রিয় দৌহিত্র হযরত ইমাম হোসাইন (রাঃ) অন্যায় ও অসত্যের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে হিজরি ৬১ সনে ইরাকের কারবালা প্রান্তরে শাহাদত বরণ করেছিলেন। তার এই শাহাদতের ঘটনা ইসলামের ইতিহাসে নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে। অন্যায়, অসত্য ও দুঃশাসনের বিরুদ্ধে পরিবার পরিজন ও ভক্ত-অনুসারীদের নিয়ে তিনি পরাক্রান্ত শাসক শক্তির বিরুদ্ধে এক অসম লড়াইয়ে অবতীর্ণ হন এবং সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেন। তার এই বেনজির আত্মত্যাগ সত্যনিষ্ঠা ও ন্যায়বাদিতা যুগ যুগ ধরে মুসলিম উম্মাহর কাছে এক অনিঃশেষ অনুপ্রেরণা হয়ে আছে এবং আগামীতেও থাকবে। উপমহাদেশের খ্যাতিমান আলেম ও কবি মাওলানা মুহাম্মদ আলী জওহরের ‘কাতলে হোসাইন আসল মে মুর্গে ইয়াজিদ হ্যায়, ইসলাম জিন্দা হোতা হ্যায় হার কারবালা কে বাদ’ কথাটি যুগেযুগে প্রমাণিত হয়েছে। দেখা গেছে, বারবার মুসলমানদের চরম দুর্দিনে কারবালা সংঘটিত হয়েছে এবং এর পরপরই মুসলমানরা জেগে উঠেছে। ইসলামের জাগর ও অগ্রযাত্রা নতুনভাবে দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। বিশ্বময় বাতিলের বিপক্ষে হকের সংগ্রাম কারবালার ঘটনা থেকে প্রেরণা ও রসদ লাভ করে উজ্জীবিত হয়। এখন যখন ইসলামী চেতনাবিরোধী শক্তি, মুনাফেকচক্র ও ইসলাম বিদ্বেষী পক্ষ সমূহ যার যার অবস্থান থেকে ইসলাম ও মুসলমানদের বিপক্ষে অবিরাম চক্রান্ত, ষড়যন্ত্র ও দমনমূলক কাজ করে যাচ্ছে তখন মনে হতে পারে মুসলিম উম্মাহর জন্য প্রতিটি দিনই যেন আশুরা। বাস্তবতাও এমনই। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এমন কোন মুহূর্ত নেই, যখন বিশ্বের কোথাও না কোথাও মুসলমানের রক্ত ঝরছে না। মুসলমানরা নিপীড়িত হচ্ছে না। আজকের ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়ায় কি ঘটছে? আফ্রিকা এবং এশিয়ার বিভিন্ন দেশে আমেরিকায় কিংবা অন্যত্র যা ঘটছে তা কারো অজানা নয়। একটা যুগসন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে মুসলিম উম্মাহ। তবে হতাশ হবার কিছু নেই। মুসলমানরা যদি আল্লাহ্র কোরআন এবং রাসূলের সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরতে পারে তাহলে অবশ্যই পরিবর্তন আসবে, আসবে কাক্সিক্ষত সুদিন। কারবালার শিক্ষা সে কথাই বলে।
কারবালার শিক্ষা বার বার মুসলমানদের সঠিক পথের দিশা দিয়েছে। দিয়েছে কর্তব্য কর্মের নির্দেশনাও। এটা শেষ হয়ে যায়নি, হবারও নয়। ন্যায়-অন্যায়, সত্য-মিথ্যা,ধর্ম-অধর্মÑ এসবই সুস্পষ্ট। ন্যায়ের সাথে অন্যায়কে সত্যের সাথে মিথ্যাকে ধর্মের সাথে অধর্মকে গুলিয়ে ফেলার কোন সুযোগ নেই। এই দিবস পালন করতে গিয়ে বা শোক প্রকাশ করতে গিয়ে ধর্মের প্রকৃত চেতনার সাথে সাংঘর্ষিক এমন কোন কর্মপন্থা গ্রহণ অনুচিত। হযরত ইমাম হোসাইন (রাঃ) দুর্বৃৃত্তের শাসন মানেননি। জালেমকে ছাড়দেননি। অন্যায়কে বরদাশত করেননি। মিথ্যাকে স্বীকার করেননি। অধর্মকে সহ্য করেননি। এইদিনে ফেরাউনের পতনের মধ্যদিয়ে আল্লাহ সত্যের বিজয়ের ঘোষণাই দিয়েছেন। বিশ্বের প্রতিটি মুসলমানকে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের শিক্ষায় উজ্জীবিত হতে হবে। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায় ‘শির দেগা, নেহি দেগা আমামাÑ এটাই কারবালার প্রকৃত শিক্ষা। হযরত ইমাম হোসাইনের শাহাদতের কিছুদিনের মধ্যেই ইয়াজিদের মৃত্যু হয়েছিল। এর পরবর্তী ঘটনাও ইতিহাসে লিপিবদ্ধ আছে। বিশ্বব্যাপী ইসলামী শক্তি নতুন করে জেগে উঠেছে। সুতরাং মুসলমানদের বিচলিত হবার কিছু নেই। বিশ্বব্যাপী আজকের দৃশ্যমান অন্ধকার অচিরেই কেটে যাবে যদি আমরা হযরত ইমাম হোসাইন (রাঃ)-এর পথ অনুসরণ করতে পারি, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নির্দেশিত পথে ঐক্য ও সংহতির বন্ধনে নিজেদের আবদ্ধ করতে পারি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন