শুক্রবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১, ১২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ধর্ম দর্শন

২৬ শাওয়াল হযরত শাহজালাল (র.)-এর লাকড়ি ভাঙ্গা উৎসব

ইসমাইল মাহমুদ | প্রকাশের সময় : ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৯, ১২:০২ এএম

শ্রমের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা ও আভিজাত্যের গৌরব ধ্বংসের শিক্ষা নিয়ে প্রায় সাতশত বছর ধরে সিলেটে পালিত হয়ে আসছে হযরত শাহজালাল (র.)-এর লাকড়ি ভাঙা উৎসব। প্রতি বছর হিজরী বর্ষের শাওয়াল মাসের ২৬ তারিখে এ উৎসব পালন করা হয়। উৎসব উপলক্ষ্যে হযরত শাজালাল (র.) দরগা শরীফ প্রাঙ্গন থেকে হাজার হাজার ভক্তের বর্ণাঢ্য মিছিল লাক্কাতোড়া চা বাগানে ছুটে যায়। এ মিছিলে জাতি-ধর্ম-বর্ণ কোন ভেদাভেদ নেই। সকল ধর্মের-বর্ণের-জাতির মানুষ এক কাতারে এসে মিলিত হয়। লাক্কাতোড়া চা বাগান থেকে লাকড়ি সংগ্রহ করে সংগ্রহকৃত লাকড়ি কাঁধে নিয়ে পুনরায় মিছিল সহকারে দরগা প্রাঙ্গনে এসে শেষ হয়। লাকড়ি ভাঙা উৎসবের ঠিক একুশ দিন পর এসব লাকড়ি দিয়ে হযরত শাহজালাল (র.)-এর বার্ষিক উরশ শরীফের শিন্নী রান্না করা হয়। এটি প্রায় সাতশত বছরের অনন্য এক ঐতিহ্য।

প্রতি বছর ২৬ শাওয়াল লাকড়ি ভাঙার এই মিছিল ছুটে চলে হযরত শাহজালাল (র.) দরগা শরীফ থেকে। প্রতি বছরই দেখা যায় মিছিলটির সম্মুখঅংশ যখন দরগা শরীফ থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দুরে অবস্থিত লাক্কাতুরা চা বাগানে পৌছে তখন পেছনের অংশ দরগাহ শরীফ প্রাঙ্গন পর্যন্তই রয়ে যায়। মাঝে মিছিলে মানুষ আর মানুষ। এদিন মানুষের ¯্রােতে হযরত শাহজালাল (র.) দরগা প্রাঙ্গন থেকে লাক্কাতোরা সড়ক কার্যত অচল হয়ে পড়ে। প্রতি বছর এ দিনে দরগাহ কর্তৃপক্ষ থেকে কোনো ধরণের প্রচার-প্রচারণা না করলেও কমপক্ষে ত্রিশ থেকে চল্লিশ হাজার মানুষের জমায়েত হন ঐতিহ্যবাহী এ লাকড়ি ভাঙা উৎসবে। প্রতি বছর এই জনপদের সব চাইতে প্রাচীন ‘লৌকিক ও অসাম্প্রদায়িক’ এ লাকড়ি ভাঙ্গা উৎসব এভাবেই পালিত হয়ে আসছে।

প্রাচীন এই উৎসবের ইতিহাস স্পর্কে জানা যায়, ৭৩০ হিজরী সনের ২৬ শাওয়াল সুলতানুল বাঙাল হযরত শাহজালাল (র.) সিলেট বিজয় করেন। এদিন সিলেটের অত্যাচারী রাজা গৌড়গোবিন্দকে পরাজিত করে প্রাচীন শ্রীহট্র নগরী সুফি সাধক হযরত শাজালাল (র.)-এর হাতে বিজিত হয়। তাই এদিন ‘শ্রীহট্ট বিজয় দিবস বা সিলেট বিজয় দিবস’ নামেও পালিত হয়ে আসছে। আবার এ দিনেই ৭২৫ হিজরীতে হযরত শাহজালাল (র.)-এর মামা ও মুর্শিদ হযরত সৈয়দ আহমদ কবির (রহ.)-এর ওফাত দিবসও।

পিতৃ-মাতৃহীন হযরত শাহজালাল (র.) শৈশবকাল মামা হযরত সৈয়দ আহমদ কবির (রহ.)-এর কাছে লালিত-পালিত হন। হযরত সৈয়দ আহমদ কবির (রহ.) ভাগ্নে হযরত শাহজালাল (র.)-কে লালন-পালনের পাশাপাশি আধ্যাত্মিক শিক্ষায়ও শিক্ষিত করেন। কামালিয়াতের উচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে যাওয়ায় তিনি ভাগ্নেকে ইসলামের দাওয়াতে নিয়োজিত করেন। হযরত সৈয়দ আহমদ কবির (রহ.) মক্কা শরিফের এক মুঠো মাটি দিয়ে ভাগ্নে হযরত শাহজালাল (র.)-কে বলেন, এই মাটির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ স্থানেই তাঁর দাওয়াতি মিশন সমাপ্ত করতে। হযরত সৈয়দ আহমদ কবির (রহ.) ছিলেন জগত বিখ্যাত সুফিসাধক হযরত জালালুদ্দিন সুররুখ বুখারী (রহ.)-এর পুত্র ও হযরত মাখদুম জালালুদ্দিন জাহানিয়ান জাহানগাস্ত বুখারী (রহ.)-এর পিতা। সিলেটের বিজয় দিবসের দিনেই ৭২৫ হিজরীর ২৬ শাওয়াল হযরত সৈয়দ আহমদ কবির (রহ.) পাঞ্জাব প্রদেশের ভাওয়াল জেলার উচ নগরীতে ইন্তেকাল করেন। তাই এইদিনটি হযরত শাহজালাল (র.)-এর মুর্শিদের পবিত্র উরস শরীফ হিসাবেও উদযাপন করা হয়।

সিলেটের ঐতিহ্যবাহী লাকড়ি ভাঙ্গা উৎসব স¤পর্কে যে কিংবদন্তী প্রচলিত আছে তা হযরত শাহজালাল (র.)-এর সাথে ঐতিহাসিকভাবে স¤পর্কিত। রাজা গৌরগোবিন্দকে পরাজিত করার পর হযরত শাহজালাল (র.) তাঁর সঙ্গী-সাথিদের এই অঞ্চলের নানা প্রান্তে ইসলাম প্রচারে প্রেরণ করলেন। তাঁর সঙ্গীদের কাছে তিনি ছিলেন নেতা বা মুর্শিদ। তাই প্রতি বছর সিলেট বিজয়ের এই দিনে সঙ্গীও আউলিয়াগণ বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ছুটে আসতেন মুর্শিদের কাছে। মুর্শিদের সান্নিধ্যে এসে সিলেট বিজয়ের এই গৌরবের জন্য আল­াহর দরবারে কৃতজ্ঞতা জানাতেন। সিলেট বিজয়ের পর প্রায় প্রতি বছর এ বিজয় দিবস মহাসমারোহে উদযাপিত হতো। নানা অঞ্চল থেকে আউলিয়ারা আসতেন হযরত শাহজালালের (র.)-এর দরবারে। এভাবে এক বছর শ্রীহট্ট বিজয় দিবস উদযাপনের কিছুদিন পূর্বে কাছে এক নও-মুসলিম কাঠুরে হযরত শাহজালাল (র.)-এর কাছে এক ফরিয়াদ নিয়ে এলো। কাঠুরের ফরিয়াদ হল-তাঁর বিবাহযোগ্য পাঁচ মেয়ে আছে। কিন্তু সে অত্যন্ত দরিদ্র ও নিচু জাতের বলে তাঁর পাঁচ মেয়েদের জন্য কোনও বিবাহের আলাপ বা প্রস্তাব আসেনা। তিনি অনেক চেষ্টা করেও তাদের বিবাহ দিতে পারছেন না। দরিদ্র ওই কাঠুরে হযরত শাহজালাল (র.)-এর কাছে এ বিষয়ে প্রতিকার চান। হযরত শাহজালাল (র.) কাঠুরের মানবিক এ ফরিয়াদে অত্যন্ত বেদনাহত হন। তিনি কাঠুরেকে কিছুদিন পরে অর্থাৎ ‘সিলেট বিজয়ের দিন’ এ বিষয়ে প্রতিকার করবেন বলে আশ্বস্থ করেন।

৭২৫ হিজরীর ২৬ শাওয়াল সিলেট বিজয়ের দিন বরাবরের মতো সবাই সমবেত হলে সঙ্গীগণসহ হযরত শাহজালাল (র.) জোহরের নামাজ আদায় করলেন। নামাজ শেষে তিনি কুড়াল হাতে করে পাহাড়-টিলা বেষ্টিত (বর্তমান যা লাক্কাতোড়া চা বাগানে অবস্থিত) উত্তর প্রান্তের গভীর জঙ্গলের দিকে যেতে থাকলেন। সঙ্গীরাও হযরত শাহজালাল (র.)-কে অনুসরণ করতে থাকেন। এক জায়গায় এসে তিনি নিজ হাতে লাকড়ি সংগ্রহ করতে লাগলেন। মুর্শিদের অনুসরণ করতে থাকলেন তাঁর শিষ্যরাও। প্রত্যেকেই সংগ্রহ করলেন লাকড়ি। লাকড়ি সংগ্রহের পর হযরত শাহজালাল (র.) মোরাকাবায় (ধ্যান) বসলেন। মোরাকাবা শেষে হযরত শাহজালালের (র.) উপস্থিত সবাইকে অশ্রæসিক্ত নয়নে জানান কিছুু সময় পূর্বে ‘উচ শরিফ’-এ তাঁর মামা ও মুর্শিদ সৈয়দ আহমদ কবির (রহ.)-এর ওফাত হওয়ার কথা। তিনি তাঁর সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে স্বীয় মুর্শিদের জন্য ফাতেহা পাঠ করেন। এরপর লাকড়ি কাঁধে করে নিয়ে সঙ্গীদেরসহ ফিরে আসেন নিজ আস্তানায়। লাকড়ি এক জায়গায় স্তুপ করে রেখে দেয়া হয়। এরপর সমবেতদের নিয়ে আসরের নামাজ আদায় করেন।

নামাজ শেষে তিনি তাঁর সঙ্গী-সাথীদের কাছে জানতে চাইলেন, ‘আজ আমরা কি কাজ করেছি?’ উপস্থিত সঙ্গী-সাথীরা বলেন, ‘হযরত আমরা আজ লাকড়ি ভেঙ্গেছি।’ তিনি তখন বলেন, ‘যারা লাকড়ি ভাঙ্গে তারা যদি কাঠুরে হয় তবে আজ থেকে আমরাও কাঠুরে কারণ আজ আমরাও লাকড়ি ভেঙ্গেছি।’ এরপর তিনি সমবেতদের কাছে ইসলামের সাম্যের বাণী ও শ্রমের মর্যাদার কথা তুলে ধরেণ ও গরিব কাঠুরের ফরিয়াদের কথা জানান। তখন সমবেতদের মধ্য থেকে অনেকেই কাঠুরের কন্যাদের বিয়ে করতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। কাঠুরে এবার আগ্রহী পাত্রদের মধ্য থেকে উপযুক্ত পাত্র বাছাই করেন। এই বিজয় উৎসব পালনের ২১ দিন পর হজরত শাহজালাল (র.)-এর ওফাত হয়। মুর্শিদের দেহান্তরের সংবাদে দূরদূরান্ত থেকে মুরিদ ও ভক্তরা সমবেত হতে থাকলেন। এই সমবেত মানুষের খাবার রান্নায় এই লাকড়ি ব্যবহার করা হয়। এই স্মৃতির ধারাবাহিকতায় শ্রমের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা ও আভিজাত্যের গৌরব ধ্বংস করার জন্য এই ‘লাকড়ি ভাঙা বা লাকড়িতোড়ার প্রথা’ পালন এখনো অব্যাহত আছে।

প্রায় সাতশত বছর থেকে নানা জাতি-ধর্ম-বর্ণের মানুষ এই অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে আসছেন। ধর্মীয় ভেদাভেদ এ উৎসবে কোন প্রভাব ফেলে না। প্রতি বছর জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষ এ লাকড়ি ভাঙা উৎসবে সামিল হন। কোন প্রকারের প্রচার-প্রচারণাবিহীন এ উৎসবে সিলেট নগরীর রাজপথকে বর্ণিল হয়ে ওঠে। এই লাকড়ি তোড়ার (ভাঙ্গার) মেলা বা লাক্কাতোড়ার উরসে জাতি-ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সকল হযরত শাহজালাল (র.)-এর ভক্তরা স্বতস্ফুর্তভাবে অংশগ্রহণ করে থাকেন। এই লৌকিক ও অসা¤প্রদায়িক উৎসব সিলেটের ঐতিহ্যময় সা¤প্রদায়িক স¤প্রীতির অনন্য নজির। তপ্ত দুপুরে প্রখর রোদের মাঝে ছুটে চলা এ মিছিল লাক্কাতোড়া বাগানের নির্দিষ্ট পাহাড়ে পৌঁছা পর্যন্ত তৃষ্ণার্থ হযরতের ভক্তদের জন্য কুয়া থেকে তুলে আনা ঠান্ডা পানি নিয়ে অপেক্ষায় থাকেন বাগানের সাঁওতাল-ওড়িয়া সম্প্রদায়ের শত-শত মানুষ।

প্রতি বছর চিরাচরিত প্রথায় পালিত এ উৎসবের কোনো উদ্বোধক, প্রধান বা বিশেষ অতিথি নেই। নেই মিছিলের সামনে দাঁড়ানো নিয়ে কোনো প্রতিযোগিতা। সিলেট নগরীর আম্বরখানা-মজুমদারি-খাসদবির-চৌকিদেখি পাড়ি দিয়ে লাক্কাতোড়া চা বাগানের নির্দিষ্ট পাহাড়ে মিছিলটি পৌঁছার পর প্রথমে অনুষ্ঠিত হয় ফাতেহা-খানি। এরপর সবাই যার যার মতো করে সংগ্রহ করতে থাকেন লাকড়ি। সেই লাকড়ি কাঁধে নিয়ে আসর নামাজের পূর্বেই সকলে ফিরে আসেন হযরত শাহজালাল (র.) দরগা প্রাঙ্গনে। জনপ্রতিনিধি, প্রশাসনের ঊর্ধতন কর্মকর্তা, ধনী, দরিদ্র সকলের কাঁধেই লাকড়ির বোঝা। এখানে নেই কোন আভিজাত্যের গৌরব। লাকড়ি কাঁধে নিয়ে হাজার-হাজার মানুষ যখন রাজপথ ধরে শহরে ফিরতে থাকে তখন দূর থেকে দেখে মনে হয়, অরণ্য বুঝি নগরের দিকে হেঁটে আসছে। দরগায় পৌঁছে এ লাকড়ি প্রথমে দরগা পুকুরে ধুয়ে নির্দিষ্ট জায়গায় সব জমা করে রাখা হয়। লাকড়ি ভাঙ্গার এই উৎসবের ২১ দিন পর অনুষ্ঠিত হয় হজরত শাহজালাল (র.)-এর পবিত্র উরস শরীফ। লাকড়ি ভাঙা উৎসবের দিন থেকেই শুরু হয়ে যায় উরস শরিফের প্রস্তুতি। প্রতিবছর উরসের শিন্নি রান্নায় ব্যবহার করা হয় উৎসবের এই লাকড়ি।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন