মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
“ইমাম মুসলিম, আস-সহীহ, অধ্যায়: আল-ওসিয়্যাহ, প্রাগুক্ত, খ.৩, পৃ: ১০৪, হাদীস নং ১৬২৭।” যে সব কথায় ওসিয়্যাত সাব্যস্ত হয় : ‘ওয়াকফ সংক্রান্ত মাসআলা-মাসায়েল’ গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে যে, কেউ যদি অপর কোন ব্যক্তিকে বলে, তুমি আমার মৃত্যুর পর আমার উকিল, তখন সে ব্যক্তি তার ওসী হয়ে যাবে। আর যদি বলে, তুমি আমার জীবদ্দশায় আমার ওসী, তবে সে উকিল পরিগণিত হবে। আর যদি বলে, তুমি একশ টাকা মজুরি হিসাবে পাবে, এই শর্তে যে তুমি আমার ওসী হবে। তবে শর্ত বাতিল হবে এবং ওসিয়্যাত স্বরূপ সে একশ টাকা পেতে পারে এবং নির্ভরযোগ্য মত অনুসারে সে ওসী হবে। “ওয়াফক সংক্রান্ত মাসআলা-মাসায়েল, প্রাগুক্ত, পৃ: ৫৬।” কেউ যদি লোকজনকে ডেকে বলে তোমরা সাক্ষী থাক যে, “আমি অমুকের জন্য এক হাজার টাকা ওসিয়্যাত করছি”, তাহলে তা ওসিয়্যাত হিসেবে পরিগণিত হবে। আর যদি বলে-“আমি ওসিয়্যাত করছি, অমুকের জন্য আমার সম্পদে এক হাজার টাকা রয়েছে”, তাহলে এ টাকা ওসিয়্যাত নয় বরং স্বীকারোক্তি হিসেবে পরিগনিত হবে। “প্রাগুক্ত”। কেউ যদি ওসিয়্যাত স্বরূপ বলে- “আমার বাড়ির এক-তৃতীয়াংশ অমুকের, আমি তা অনুমোদন করছি”, তবে তা ওসিয়্যাত হবে। আর যদি বলে- “অমুক ব্যক্তির জন্য আমার বাড়ির মাঝে এক ষষ্ঠাংশ রয়েছে”, তবে তা স্বীকারোক্তি হবে। অনুরূপ যদি ওসিয়্যাতের কথা উল্লেখ করে বলে- “অমুক ব্যক্তি আমার সম্পদ থেকে এক হাজার টাকা পাবে”, তবে তা ওসিয়্যাত হবে। কিন্তু যদি বলে- “আমার সম্পদে অমুক ব্যক্তির এক হাজার টাকার রয়েছে”, তবে তা স্বীকারোক্তি হবে। “প্রাগুক্ত, পৃ: ৫৭”। আবার কেউ যদি বলে- “আমার এই বাড়িটি অমুকের’, এ ক্ষেত্রে যদি ওসিয়্যাত জ্ঞাপক কথার উল্লেখ না থাকে এবং আমার মৃত্যুর পর এ কথা না বলে, তবে তা দান হিসেবে ধর্তব্য হবে। যদি এ দানকারী ব্যক্তির জীবদ্দশায় ঐ ব্যক্তি তা দখল করে নেয়, তবে তা সহীহ হবে। কিন্তু দানকারী ব্যক্তির ওফাতের পর দানের এ কথা বাতিল হয়ে যাবে। কোন অসুস্থ ব্যক্তি যদি অপরকে বলে ‘তুমি আমার ঋণ-পরিশোধ কর’, তবে সে ব্যক্তি ওসী হবে। যদি কেউ সুস্থ অথবা অসুস্থ অবস্থায় বলে, ‘যদি আমার কোন কিছু হয় তবে অমুক ব্যক্তি এত পাবে’, তাহলে তা ওসিয়্যাত হিসেবে ধর্তব্য হবে।
ওসিয়্যাত প্রত্যাহারকরণ : ওসিয়্যাতকারীর জন্য ওসিয়্যাত প্রত্যাহার করা ইসলামী আইনে বৈধ। কেননা এটা হলো স্বেচ্ছা দান। যা এখনো পূর্ণতা লাভ করেনি। সুতরাং তা থেকে ফিরে আসা জায়িয হবে। হিবার ক্ষেত্রে যেমন হয়ে থাকে। তা ছাড়া আরেকটি কারণ এই যে, ওসিয়্যাতপ্রাপ্ত ব্যক্তির ওসিয়্যাত কবুল করার বিষয়টি ওসিয়্যাতকারীর মৃত্যুর উপর নির্ভর করে। আর ইজাব বা প্রস্তাব কবুল করার আগে তা বাতিল করা যায়। বিক্রয়ের ক্ষেত্রে যেমন হয়ে থাকে। “বুরহান উদ্দীন আলী ইবন আবুবকর আল মারগীনানী, আল হিদায়া, প্রাগুক্ত, পৃ: ৫২২”।
ওসিয়্যাতকারী সুস্পষ্ট কথা অথবা কার্যকলাপের মাধ্যমে ওসিয়্যাত প্রত্যাহার করতে পারে। কথার মাধ্যমে প্রত্যাহার হলো যেমন ওসিয়্যাতকারী বলল, ‘আমি অমুক জিনিস অমুক ব্যক্তির জন্য ওসিয়্যাত করে ছিলাম। এখন অমুক ব্যক্তির পরিবর্তে অমুক ব্যক্তির জন্য ওসিয়্যাত করলাম।” আর কাজের মাধ্যমে প্রত্যাহার হলো যেমন, কোন ব্যক্তি অপর ব্যক্তির অনুকূলে একটি মূল্যবান গাছের ওসিয়্যাত করলো। পরবর্তীতে সে ঐ গাছ কেটে নিজের গৃহ নির্মাণের কাজে ব্যবহার করল, এমতাবস্থায় তার ওসিয়্যাত প্রত্যাহার হয়ে গেল। ওসিয়্যাত প্রত্যাহারের ব্যাপারে তিনটি মূলনীতি রয়েছে। যথা- ১। অপরের মালিকানাধীন কোন বস্তুতে যে ধরনের পরিবর্তন-পরিবর্ধন করলে মালিকের মালিকানা নিঃশেষ হয়ে যায়, ওসিয়্যাতকারী ব্যক্তি সে ধরনের কোন পরিবর্তন করলে সে তার ওসয়্যিাত প্রত্যাহার করেছে বলে গণ্য হবে। ২। অনুরূপ ওসিয়্যাতকৃত বস্তুর মধ্যে কিছুর সংযোজন, যা দ্বারা মূলবস্তুর মাঝে পরিবর্তন সাধন হয় এবং এ অতিরিক্ত বস্তু ব্যতীত মূলবস্তুটি প্রদান করা সম্ভবপর না হয়, এরূপ সংযোজন করা প্রত্যাহার বলে গণ্য হবে। ৩। ওসিয়্যাতকৃত বস্তুর মাঝে এমন কোন পদক্ষেপ, যা দ্বারা মালিকানা নিঃশেষ হয়ে যায়, তাও প্রত্যাহার হিসেবে ধর্তব্য হবে।
ওসিয়্যাতের অনুকূলে সাক্ষ্য : মৃত ব্যক্তির ওয়ারিসগণ ওসিয়্যাত অস্বীকার করলে তা প্রমাণের জন্য দুই জন সাক্ষীর সাক্ষ্য পেশ করতে হবে। মত বিরোধের ক্ষেত্রে ওসিয়্যাত প্রতিষ্ঠিত করার জন্য সাক্ষীর প্রয়োজন, দুইজন লোক যদি সাক্ষ্য দেয় যে, অমুক ব্যক্তি অমুক ব্যক্তির অনুকূলে এই জিনিসের ওসিয়্যাত করেছে, এবং মূসা লাহুও (যার জন্য ওসিয়্যাত করা হয়েছে) এর দাবি করে তবে ওসিয়্যাত প্রামাণিত হবে। আল্লাহ তাআলা বলেন,
“হে মুমনিগণ! তোমাদের কারও যখন মৃত্যু উপস্থিত হয় তখন ওসিয়্যাত করার সময় তোমাদের মধ্য হতে দুইজন ন্যায়পরায়ন লোককে সাক্ষী রাখবে, তোমরা সফরে থাকলে এবং তোমাদের মৃত্যুর বিপদ উপস্থিত হলে তোমাদের ছাড়া অন্য লোকদের (অমুসলিমদের) মধ্য হতে দুইজন সাক্ষী মনোনীত করবে। “আল কুরআন, ৫:১০৬।” ওসিয়্যাতনামার সত্যতা সাব্যস্ত হলেই তা গ্রহণযোগ্য হবে এবং সাক্ষ্য হলো এর প্রমাণ স্বরূপ।
ওসী নিয়োগ ও ওসীর যোগ্যতা : ওসিয়্যাতকারী ব্যক্তি তার কৃত ওসিয়্যাত সম্পাদন করার দায়িত্ব যার উপর ন্যস্ত করে শরীয়তের পরিভাষায় তাকে ওসী বলা হয়। যে কোন বিশ্বস্ত, মুসলিম, বালিগ ও সুস্থবুদ্ধির অধিকারী নারী বা পুরুষকে ওসী নিয়োগ করা যায়। তারা ওসিয়্যাতকারীর আত্মীয় হোক বা না হোক, তবে কোন অমুসলিমকে ওসী নিয়োগ করা বৈধ নয়।
“গাজী শামছুর রহমান ও অন্যান্য সম্পাদিত, বিধিবদ্ধ ইসলামী আইন, প্রাগুক্ত, পৃ:৭৪০।” নিম্নে ওসীর যোগ্যতা ও ওসী নিয়োগ সংশ্লিষ্ট কিছু বিষয় বর্ণনা করা হলো:
প্রথমত : কোন অমুসলিম ব্যক্তি ওসী হতে পারে না। কারণ, এ বিষয়ে আল্লাহ তাআলার নির্দেশ হলো, “আল্লাহ কখনও মুমিনদের উপর কাফিরদের কর্তৃত্ব করার অধিকার দেননি। “আল কুরআন, ৪:১৪১।”
দ্বিতীয়ত : ওসীর দায়িত্ব পালনে অপারগ ব্যক্তিকে যদি ওসী নিযুক্ত করা হয়, তাহলে কাযী তার সাথে অন্য একজনকে নিয়োগ দিবেন। দ্বিতীয়জন প্রথমজনকে ত্রুটিবিচ্যুতি থেকে রক্ষা করবে এবং সহযোগিতা করবে।
তৃতীয়ত : যদি দু’জনকে ওসী নিয়োগ করা হয়, তাহলে একজন অপরজনকে বাদ দিয়ে কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না। এবং কোন পদক্ষেপও গ্রহণ করতে পারবে না।
চতুর্থত : মৃত ব্যক্তির ওসিয়্যাত কার্যকর করার এবং তার নিকট অপরের অথবা অপরের নিকট তার প্রাপ্য ঋণ আদায় করার মত কোন যোগ্য ওয়ারিস বা ওসী নিয়োজিত না থাকলে আদালতের ব্যবস্থাপনার জন্য ওসী নিয়োগ করতে পারে। “গাজী শামছুর রহমান ও অন্যান্য সম্পাদিত, বিধিবদ্ধ ইসলাম আইন, প্রাগুক্ত, পৃ:৭৪০।”
পঞ্চমত : কোন অপ্রাপ্ত বয়স্ক ব্যক্তিকে ওসী নিয়োগ করা যাবে না। কারণ অপ্রাপ্ত বয়স্ক ব্যক্তির সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণের যোগ্যতা নেই। বরং তার হাতে সম্পদ ন্যস্ত করলে, সে তা নষ্ট করে ফেলতে পারে। এ বিষয়ে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন, “যখন তাদের মধ্যে বিচার-বুদ্ধির ক্ষমতা খুঁজে পাবে, তখন তাদের সম্পদ তাদের কাছে প্রত্যর্পণ কর। “আল কুরআন, ৪:৬।”
উপসংহার : ওসিয়্যাত পুণ্যলাভের একটি উপায়। ইসলামে ওসিয়্যাত কেবল বৈধই নয়, বরং এটি একটি প্রশংসনীয় কাজ। ইসলামের প্রাথমিক যুগে ওসিয়্যাত একটি অত্যবশ্যকীয় ইবাদত ছিল। যদিও পরবর্তীতে মীরাসের আয়াত অবতীর্ণের ফলে সে বিধান রহিত হয়ে গেছে। ওসিয়্যাত এমন একটি কাজ যা দ্বারা নিজের প্রিয় সঞ্চয়কে নিজের পছন্দনীয় কাজে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ব্যয় করা যায়। মানুষকে যেহেতু মৃত্যুর স্বাদ অবশ্যই আস্বাদন করতে হবে, সেহেতু তাকে মৃত্যুর সময় এমন কিছু কাজ করে যাওয়া উচিত, যার দ্বারা সমাজের মানুষ উপকৃত হয় এবং পরকালে কঠিন বিপদের মুহূর্তে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের নিকট যা মুক্তির ওসীলা হিসেবে বিবেচিত হয়। সমাজের বিত্তশালীদের পরকালীন মুক্তির ব্যবস্থা এবং সর্বোপরি আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে ওসিয়্যাত একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। তাই নিজের পরকালীন মুক্তি এবং সমাজের সার্বিক উন্নতির জন্য সকলের নিজের সাধ্য এবং ক্ষমতা অনুসারে ওসিয়্যাত করা উচিত।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন