মুফতী পিয়ার মাহমুদ
রমজানের রোজা ইসলামের পাঁচ স্তম্ভের অন্যতম। রোজা শব্দটি ফারসি। যার আরবি হলো, সওম। সওমের আভিধানিক অর্থ বিরত থাকা। শরিয়তের পরিভাষায় সওম বলা হয়, প্রত্যেক সজ্ঞান, প্রাপ্ত বয়ষ্ক মুসলিম নর-নারীর সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত রোজার নিয়তে স্ত্রী সহবাস, পানাহার ও রোজা ভঙ্গকারী যাবতীয় কাজ-কর্ম থেকে বিরত থাকা। বিনায়া : ৪/৩; বাদায়েউস সানায়ে : ২/৭৫। রমজানের চাঁদ দেখা গেলে প্রতিটি সুস্থ, মুকিম, প্রাপ্ত বয়ষ্ক পুরুষ ও হায়েয-নেফাসমুক্ত প্রাপ্ত বয়ষ্কা নারীর ওপর পূর্ণ রমজান রোজা রাখা ফরজ। এ সম্পর্কে কুরআন মাজিদে ইরশাদ হয়েছে, “হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর রোযা ফরয করা হয়েছে, যেভাবে ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর। যেন তোমরা মুত্তাকী হতে পার।” (বাকারা : ১৮৩) অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে, “তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তিই এ রমযান মাস পাবে, সে যেন অবশ্যই রোযা রাখে।” (বাকারা : ১৮৫) সাহাবী আবু হুরায়রার (রা.) বাচনিক মহানবী (সা.) ইরশাদ করেন, যখন তোমরা রমজানের চাঁদ দেখ তখন থেকে তোমরা রোজা রাখ। আর যখন শাওয়ালের চাঁদ দেখ তখন থেকে রোজা বন্ধ কর। যদি আকাশ মেঘলা থাকে, তাহলে ত্রিশ দিন রোজা রাখ। (বুখারি : হাদিস, ১৯০৯; মুসলিম : হাদিস, ১০৮০) উল্লেখিত আয়াত ও হাদিস দ্বারা এ কথা অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয় যে, রমজান মাসের রোজা ফরজ ও ইসলামের অবশ্য পালনীয় বিধান। শরয়ী ওযর ব্যতীত তা না রাখার কোন অবকাশ নেই।
মানুষের স্বভাবজাত অভ্যাস হলো, কোন কাজের পরই তার প্রতিদান আশা করে। এ জন্য মহা বিশে^র স্রষ্টা অন্তর্যামী আল্লাহতায়ালা মানুষের উপর অবতীর্ণ প্রতিটি বিধানের জন্য ঘোষণা করেছেন আলাদা পুরস্কার। যেন সে দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে সেই বিধান পালনে সচেষ্ট থাকে। তাই রোজাদারের জন্যও দিয়েছেন অফুরন্ত ও অবারিত নেয়ামত ও পুরস্কারের ওয়াদা। সাহাবী আবু হুরায়রার (রা.) বাচনিক মহানবী (সা.) ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে সওয়াবের আশায় রমজানের রোজা রাখবে, তার পূর্ববর্তী সকল গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে। (বুখারি, হাদিস : ১৮৬৩; মুসান্নাফে আবী শায়বা, হাদিস : ৮৯৬৯) অপর বর্ণনায় এসেছে, সাহাবী আব্দুর রহমান ইবনে আউফ বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, “আল্লাহতায়ালা তোমাদের উপর ফরয করেছেন রমযান মাসের রোযা আর আমি সুন্নাত করেছি তারাবীহর নামায। সুতরাং যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে সওয়াবের আশায় রমযানের রোযা রাখবে এবং তারাবীহর নামায আদায় করবে, সে ওই দিনের মত পবিত্র হয়ে যাবে, যেদিন সে মাতৃ উদর থেকে ভূমিষ্ঠ হয়েছিল।” (সুনানে নাসাঈ : ১/২৩৯; মুসান্নাফে আবী শায়বা : ৫/২২৯-২৩০) সুনানে নাসাঈর অন্য এক বর্ণনায় এসেছে, সাহাবী হযরত আবু উমামা (রা.) বর্ণনা করেন, “আমি বললাম, ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমাকে কোন আমলের নির্দেশ দিন। তিনি বললেন, তুমি রোজা রাখ। কেননা রোজার সমতুল্য কোন কিছইু নেই। আমি আবার বললাম ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমাকে কোন আমলের নির্দেশ দিন। তিনিও পুনরায় সেই কথাই বললেন, তুমি রোজা রাখ। কেননা রোজার সমতুল্য কোন কিছুই নেই। মুসনাদে আহমাদের বর্ণনায় এসেছে, আমি বললাম ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমাকে এমন কোন আমলের কথা বলে দিন, যা আমাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবে। তিনি বললেন, তুমি রোজা রাখ। কারণ রোজার সমকক্ষ কোন কিছইু নেই। আমি দ্বিতীয়বার তাঁর নিকট এসে একই কথা বললে, তিনি বললেন, রোজা রাখ।” (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ২২১৪০,২২১৪৯; সুনানে নাসাঈ, হাদিস : ২৫৩০; সহীহ ইবনে খুযাইমা, হাদিস : ১৮৯৩) অপর আরেক বর্ণনায় এসেছে, সাহাবী সাহল ইবনে সাদ (রা.)-এর বর্ণনায় রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, রোজাদারের জন্য জান্নাতে বিশেষ একটি দরজা আছে। যার নাম রাইয়ান। এই দরজা দিয়ে কেবলমাত্র রোজাদারই প্রবেশ করবে। অন্য কেউ প্রবেশ করতে পারবে না। যখন সর্বশেষ রোজাদার ব্যক্তি তা দিয়ে জান্নাতে প্রবেশ করবে, তখন সেই দরজা বন্ধ করে দেয়া হবে। যে সেই দরজা দিয়ে প্রবেশ করবে, সে জান্নাতের পানীয় পান করবে। আর যে সেই পানীয় পান করবে সে আর কখনও তৃষ্ণার্ত হবে না। (সুনানে নাসায়ী : ১/২৪১;১/১৫৯; বুখারি : ১/২৫৪) সাহাবী হযরত জাবের (রা.) বলেন, মহানবী (সা.) বলেছেন, আমাদের মহামহিম রব ইরশাদ করেছেন, রোজা হলো, ঢাল স্বরূপ। মুমিন বান্দা এর দ্বারা পরকালে জাহান্নামের আগুন থেকে আত্মরক্ষা করবে। (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ১৪৬৬৯; শুআবুল ঈমান, বায়হাকী, হাদিস : ৩৫৭০; বুখারি, হাদিস : ১৮৫৬) আবু হুরায়ারার (রা.) বর্ণনায় এসেছে, নবী কারীম (সা.) ইরশাদ করেন, রোজা হলো, জাহান্নাম থেকে পরিত্রাণ লাভের ঢাল এবং সুরক্ষিত, সুদৃঢ় দুর্গ।
(শুআবুল ঈমান, বায়হাকী, হাদিস : ৩৫৭১; মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ৯২২৫) অন্য বর্ণনায় এসেছে, আবু হুরায়রার বর্ণনায় মহানবী (সা.) ইরশাদ করেন, শপথ সেই সত্তার যার হাতে আমি মুহাম্মাদের জীবন, রোজাদারের মুখের দুর্গন্ধ আল্লাহর নিকট মিশকের সুগন্ধির চেয়েও অধিক সুগন্ধীময়। (বুখারি, ১/২৫৪; মুসলিম : ১/৩৬৩ তিরমিযী : ১/১৫৯; নাসায়ী : ১/২৪০) উল্লেখ, বর্ণিত হাদিসে দুর্গন্ধ দ্বারা ওই দুর্গন্ধকেই বুঝানো হয়েছে যা পানাহার বর্জনের কারণে পেটের ভিতর থেকে উৎপাদিত হয়। দাত ও মুখ অপরিষ্কার রাখার কারণে যে দুর্গন্ধের সৃষ্টি হয় তা এখানে উদ্দেশ্য নয়। তাই রোজাদার ব্যক্তি দাত ও মুখ পরিষ্কার এবং মুখের দুর্গন্ধ দূর করার ব্যাপারে অবশ্যই সচেতন থাকবে। কারণ মুখে দুর্গন্ধ থাকলে এর দ্বারা অন্যের কষ্ট হবে। আর ইসলামের দৃষ্টিতে অন্যকে কষ্ট দেয়া হারাম। ইবনে মাজার এক বর্ণনায় আছে, সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে আমর থেকে বর্ণিত, মহানবী (সা.) ইরশাদ করেছেন, ইফতারের সময় রোজাদার যখন দুআ করে তখন তার দুআ ফিরিয়ে দেয়া হয় না। অর্থাৎ অবশ্যই কবুল হয়। (সুনানে ইবনে মাজা : হাদিস, ১৭৩৫) মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বার এক বর্ণনায় এসেছে, রোজাদারের দুআ ফিরিয়ে দেয়া হয় না। অর্থাৎ অবশ্যই কবুল করা হয়। (মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, হাদিস : ৮৯৯৫) প্রতিটি নেক আমলের রয়েছে নির্ধারিত সওয়াব ও প্রতিদান, যার মাধ্যমে আল্লাহতায়ালা পুরস্কৃৃত করবেন আমলকারীকে। কিন্তু রোজার বিষয়টি সম্পূর্ণ আলাদা। রোজার প্রতিদান দিবেন সয়ং আল্লাহতায়ালা। এ ব্যাপারে সাহাবী আবু হুরায়রার বর্ণনায় মহানবী (সা.) ইরশাদ করেন, আদম সন্তানের প্রতিটি নেক আমলের সওয়াব বৃদ্ধি করা হয়। একটি নেক কাজের সওয়াব দশ গুণ থেকে সাতশত গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়। আল্লাহতায়ালা বলেন, কিন্তু রোজার বিষয়টি ভিন্ন। কারণ রোজা একমাত্র আমার জন্য। এর প্রতিদান আমি নিজেই প্রদান করব। রোজাদার বান্দা কেবলমাত্র আমার জন্যই স্বীয় মনোবাসনা পরিত্যাগ করেছে এবং পানাহার বর্জন করেছে। (মুসলিম : ১/৩৬৩; ইবনে মাজা : ১১৮; মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা : ৬/১০৪) (চলবে)
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন