মসজিদের বারান্দায় দাঁড়িয়ে মাইক্রোফোনের সামনে বক্তৃতা দিচ্ছেন আইএস প্রধান। আবু বকর আল বাগদাদি বলতে সমগ্র বিশ্ব চেনে এই ছবিটাই। সংবাদ মাধ্যমে যত বার আই এস প্রধান বাগদাদির নাম উঠে এসেছে তত বার তার এই ছবিও ছড়িয়ে পড়েছে। সেই সঙ্গে ছড়িয়ে পড়েছে ইসলামিক স্টেট নামক জঙ্গি সংগঠনটির নানা নৃশংসতার কাহিনিও। কিন্তু, কে এই বাগদাদি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যার মাথার দাম ঘোষণা করেছে ৮০ কোটি টাকা।
১৯৭১ সালে ইরাকের ছোট্ট শহর সামারায় একটি সুন্নি পরিবারে জন্ম হয়েছিল বাগদাদির। তখন অবশ্য তার নাম ছিল ইব্রাহিম আল বদরি। ২০১৩ সালে নিজেকে ‘খলিফা’ হিসাবে ঘোষণা করার পরই সংবাদ মাধ্যমে উঠে আসে আইএস প্রধান। এর মধ্যে এই ৪২ বছরে, বাগদাদির কথা অবশ্য তেমন ভাবে শোনা যায়নি। বরং, তা মার্কিন গোয়েন্দাদের হাতেই সীমাবদ্ধ ছিল। পরিবারের ধর্মীয় পরিবেশ জোরাল প্রভাব ফেলেছিল বাগদাদির উপর। ছোটবেলা থেকেই পবিত্র কোরআন ও ধর্মীয় রীতিনীতির উপর প্রতি অসম্ভব টান ছিল তার। তা নিয়েই পড়াশোনা শুরু করেন তিনি। ১৯৯৬ সালে বাগদাদ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামিক স্টাডিজের উপর ব্যাচেলর ডিগ্রি পান তিনি। এর পর কোরানিক স্টাডিজে মাস্টার ডিগ্রি ও পরে ডক্টরেটও পান তিনি। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইল থেকে অবশ্য বাগদাদি সম্পর্কে তেমন তথ্য মেলেনি। জানা যায়, এই সময়েই বাগদাদ শহরের কাছে একটি মসজিদে শিশুদের পবিত্র কোরআন শিক্ষাও দিতে শুরু করেন তিনি। সেইসঙ্গে চলতে থাকে তার ফুটবল চর্চাও। ক্লাব ফুটবলে রীতিমতো স্টার হয়ে উঠে ছিলেন বাগদাদি।
ইরাকে মুসলিম ব্রাদারহুড আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েছিলেন বাগদাদির চাচা। তিনিই জানিয়েছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার সময়েই মুসলিম ব্রাদারহুডে যোগ দেন বাগদাদি। তবে, শুধুমাত্র সেই গণ্ডিতেই আটকে থাকেননি বাগদাদি। ২০০০ সাল নাগাদ সালাফি জিহাদিদের সঙ্গে যোগ দেন বাগদাদি। মার্কিন গোয়েন্দা সূত্র অনুযায়ী, ১৯৯৬ সাল থেকে ২০০০ সালের মধ্যেই আফগানিস্তানে জিহাদি প্রশিক্ষণ নেন তিনি। নব্বই-এর দশকে উপসাগরীয় যুদ্ধের সময় ছাত্র ছিলেন বাগদাদি। ২০০৩ সালে মার্কিন বাহিনী যখন ফের ইরাকে অভিযান শুরু করে তখন বাগদাদি অবশ্য পুরোদস্তুর জঙ্গি। ২০০৪ সালে তাকে প্রথম এবং শেষবারের জন্য গ্রেফতার করেছিল মার্কিন বাহিনী। তাকে পাঠানো হয় বুক্কা ব্যাম্পে, সেখানে প্রায় ১০ মাস কাটান বাগদাদি।
নানা সূত্র থেকে জানা যায়, খুব কম কথা বলতেন বাগদাদি। বন্দি থাকাকালীন বেশিরভাগ সময়েই ধর্মীয় চর্চাই চালিয়ে যেতেন তিনি। সেই সঙ্গে বিভিন্ন বিরোধী জঙ্গি গোষ্ঠীগুলির নেতাদের সঙ্গেও তার যোগাযোগ ঘটে। বুক্কা ক্যাম্প থেকে ছাড়া পাওয়ার পর ইরাকের আল কায়দাগোষ্ঠীর সঙ্গে যোগাযোগ করেন বাগদাদি। যদিও, পরে ওই জঙ্গি সংগঠন ভেঙে দিয়ে তার নাম রাখা হয় ইসলামিক স্টেট। সেই সূত্রপাত। বিরোধী গোষ্ঠীগুলিকে এক জায়গায় আনার ক্ষমতা, ধর্মীয় পড়াশোনা এই সমস্ত কিছুই বাগদাদিকে নেতা হিসাবে উঠে আসতে দারুণ সাহায্য করেছিল। জঙ্গি সংগঠনে যোগ দেয় সাদ্দাম হুসেনের বাথ পার্টির একাধিক সদস্য এবং ইরাকি সরকারের সেনাকর্তাদের অনেকেই। মধ্য-এশিয়া বিশেষজ্ঞ মাইকেল স্টিফেন্সের কথায়, ‘সাদ্দাম হুসেনের প্রাক্তন গোযেন্দা অফিসারদের কেমন ভাবে কাজে লাগাতে হয় তা তিনি (বাগদাদি) ভালই জানতেন।’ নিজের নিরাপত্তা নিয়েও যথেষ্ট খুঁতখুঁতে ছিলেন বাগদাদি।
২০১০ সালের এপ্রিল মাসে বাগদাদিকে নতুন আমির ঘোষণা করা হয়। তখনও অবশ্য আল কায়দার সঙ্গে ইসলামিক স্টেটের সম্পর্ক টিকে ছিল। কিন্তু, ২০১১ সালে পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদে মার্কিন নেভি সিলের অপারেশন নেপচুন স্পিয়ারে নিহত হন আল কায়দা প্রধান ওসামা বিন লাদেন। তার পর আল কায়দার দায়িত্ব নেন আয়মান আল জাওয়াহিরি। কিন্তু, তত দিনে ইরাক ও সিরিয়ার বিস্তীর্ণ এলাকা থেকে পিছু হঠতে শুরু করেছে আল কায়দা। বদলে, সেই জায়গা দখল করে নিতে থাকে ইসলামিক স্টেট। কিন্তু, তখনও আল কায়দা ছেড়ে বেরিয়ে আসেনি তারা। ভাঙনটা শুরু হয় আল নুসরা নামে আরেকটি জঙ্গি সংগঠনকে ঘিরে। নুসরার নেতারা সিরিয়া সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার পক্ষে ছিল। কিন্তু, তার বদলে নিজের ‘সাম্রাজ্য’ গড়ে তোলাই প্রথম পছন্দ ছিল বাগদাদির। সেই সঙ্গে দখল করা এলাকায় কঠোর ধর্মীয় আইন চালু করাও ছিল তার লক্ষ্য। এ নিয়েই আল কায়দায় সঙ্গে তার সংঘাত শুরু হয়। আইএস-কে জঙ্গি সংগঠন থেকে বহিষ্কার করে আল কায়দা। তাতে কার্যত শাপে বর হয় বাগদাদির।
আল কায়দার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার পর পরই, ইরাক ও সিরিয়ার বিভিন্ন এলাকা দুর্বার গতিতে দখল করে নেয় আইএস জঙ্গিরা। ২০১৪ সালের জুন মাসে ইরাকের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর মসুল দখল করে নেয় আইএস। এই সময়েই নিজেকে ‘খলিফা’ হিসাবে ঘোষণা করেন বাগদাদি। শুরু থেকেই একের পর এক নৃশংসতার নজির তৈরি করেছে আইএস। এলাকা দখলের পর, গণহত্যা, নির্মম ভাবে অত্যাচারের কোনও নিদর্শনই বাদ রাখেনি তারা।
আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে বার বার বাগদাদির মৃত্যু সংবাদ ছড়িয়েছে। আবার তার কিছু দিনের মধ্যেই প্রকাশ্যে এসেছে মসুলের আল নুরি মসজিদের বারান্দা থেকে তার বক্তৃতা দেয়ার ভিডিও। শনিবার রাতে প্রথমে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও পরে হোয়াইট হাউসের ডেপুটি প্রেস সেক্রেটারি হোগান গিডলের টুইটে ফের বাগদাদির মৃত্যু নিয়ে নতুন করে জল্পনা শুরু হয়েছে। চলতি বছরের এপ্রিল মাসে শ্রীলঙ্কায় ইস্টারের দিনে চার্চে হামলা চালায় জঙ্গিরা। সেই হামলায় দায় স্বীকার করে আইএস। সেই সূত্রেই প্রকাশ্যে আসে বাগদাদির ভিডিও। আন্তর্জাতিক শক্তির লাগাতার অভিযান ও বিমান হানায় আইএস-এর শক্তি এখন তলানিতে ঠেকেছে। এক সময়ের বহু ঘাঁটিতেই এখন কোণঠাসা হয়ে পড়েছে তারা। কোথাও আবার পিছু হঠতে হয়েছে তাদের। সেই সঙ্গে মার্কিন বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে যাওয়ার আশঙ্কাও তাড়া করে বেড়াচ্ছিল বাগদাদিকে। ফলে, বার বার জায়গাও বদলাতে হচ্ছিল ওই জঙ্গিনেতাকে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন