ঘোষণার নিয়ম : উক্ত ঘোষণার ক্ষেত্রে শর্ত হল, এ ঘোষণা যেন সাধারণ সংবাদ বা সংবাদ পাঠের নিয়মে না হয় বরং তা ‘কেন্দ্রিয় চাঁদ দেখা কমিটি’র পক্ষে মনোনীত কোন আলেম নিজে রেডিও, টিভি তথা প্রচার মাধ্যমের সামনে এমন ঘোষণা দেবেন যে, “আমাদের কাছে ‘চাঁদ দেখার সাক্ষ্য’ অথবা ‘সাক্ষ্য মোতাবেক সাক্ষ্য’ অথবা ‘ফায়সালা মোতাবেক সাক্ষ্য’-এর তিনটি পদ্ধতির মধ্যে অমুকটি উপস্থাপিত হয়েছিল। আমরা বিধি মোতাবেক নিশ্চিত হয়ে চাঁদ প্রমাণিত হওয়ার ফায়সালা দিয়েছি এবং সরকারের/ কেন্দ্রিয় সরকারের প্রদত্ত ক্ষমতা বলে আমরা সারা দেশের জন্য এ ঘোষণা প্রদান করছি।”
উক্ত মৌলিক কয়েকটি বিষয় চাঁদ দেখা ও সে ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্ত প্রশ্নে সকলের সামনে থাকা চাই।
বাস্তবায়ন : উক্ত সাক্ষ্য-নীতির নিরীখে তা বাস্তবায়ন ও শৃঙ্খলাবিধানে যদি কোন জটিলতার মুখোমুখি হতে হয়, তা হবে কেবল শেষের প্রক্রিয়াটির ক্ষেত্রে অর্থাৎ ‘ফায়সালা মোতাবেক সাক্ষ্য’ পদ্ধতির ক্ষেত্রে । কারণ, এ ক্ষেত্রে এক জেলার উপকমিটি’র ফায়সালা কেন্দ্রিয় কমিটি পর্যন্ত পৌঁছানোর জন্য দু’জন সাক্ষীর সেখানে উপস্থিত হওয়া জরুরী মর্মে বিধান রযেছে! যা কিনা যদিও এ বিমান পথে যাতায়াতের যুগে অসম্ভব নয় বটে; কিন্তু তারপরও তেমনটি অবশ্যই জটিল ও কঠিন। উক্ত জটিলতার সহজ বিকল্প ও সমাধান কী হতে পারে? এমন প্রশ্নে আজ থেকে প্রায় ৫৫(পঞ্চান্ন) বছর পূর্বে তৎকালীন অবিভক্ত পাকিস্তানের চারজন শীর্ষস্থানীয় প্রসিদ্ধ প-িত গবেষক আলেম Ñযাঁরা একনামে উপমহাদেশের দীনী পরিবেশে পরিচিতÑ তাঁদের সম্মিলিত বৈঠকে চিন্তা-গবেষণা করা হয়েছে। এঁরা হলেন: ১) হযরত মাওলান মুফতী মুহাম্মদ শফী‘ র. ২) হযরত মাওলানা যফর আহমদ উসমানী র. ৩) হযরত মাওলানা ইউসুফ বিন্নোরী র. ৪) হযরত মাওলানা মূফতী মুহম্মিদ রশীদ আহমদ র. । অর্থাৎ আলোচিত ‘সাক্ষ্য মোতাবেক গৃহীত ফায়সালা’র ক্ষেত্রেও তা অন্যত্র বাস্তবায়ন বা অন্য সকলের বেলায় প্রযোজ্য বলতে বা করতে গেলে সাক্ষ্য ও সাক্ষীসহ সেখানে বা কেন্দ্রে পৌঁছাতে হবে Ñতার বাধ্য-বাধকতা কতটুকু? বা তাতে কী সহজ কোন পন্থা বের হতে পারে? তার সার-সংক্ষেপ হল:
সমাধান: “চার মাযহাব ও জুমহুর আলেমগণের কিতাবাদি অধ্যয়ন করে এ আলেমগণ এমন ফলাফলে উপনীত হয়েছেন যে, মৌলিকভাবে নীতিগত বিবেচনায় অধঃস্তন বা জেলা পর্যায়ের উপকমিটির ‘চাঁদ দেখার ফায়সালা’ কেন্দ্রিয় কমিটির জন্য তখনই গ্রহণযোগ্য-বাস্তবায়নযোগ্য হতে পারে যখন তা অপর বিচারকের (কমিটির) কাছে শরীয়তসম্মত সাক্ষ্য ও দু’জন সাক্ষীসহই পৌঁছাবে। কেবল টেলিফোন ইত্যাদির মাধ্যমে তার সংবাদ দিয়ে দেয়াই যথেষ্ট হবে না। উম্মতের জুমহুর ফকীহগণের Ñহানাফী, শাফেঈ, মালেকী ও হাম্বলীদেরÑমূল মাযহাব তথা গবেষণা তেমনটাই। হেদায়া, কিতাবুল উম্ম (ইমাম শাফেঈ র.) ও মুগনী-ইবনে কুদামা (হাম্বলী) ইত্যাদিতে তেমনটাই উল্লেখ করা হয়েছে। সে কারণে উত্তম হবে তো তা-ই যে, সরকার শরীয়তের মূল বিধান (গবেষণা) মোতাবেক তেমন কোন ব্যবস্থাপনা করতে পারেন। (প্রাগুক্ত: পৃ- ৪০২) তবে হ্যাঁ, আলেমগণের ওই বৈঠকে এমন প্রশ্নেও চিন্তা-পর্যালোচনা করা হয়েছে যে, সরকার যদি উক্ত প্রক্রিয়া অবলম্বন বা বাস্তবায়ন জটিল বলে মনে করেন, সেক্ষেত্রে কি তার কোন বিকল্প পন্থা হতে পারে? গভীর চিন্তা-গবেষণার পর তার একটা সমাধান এ মর্মে বের করা হয়েছে:
শেষ সমাধান:“সরকার প্রতিটি বড় বড় শহরে উপকমিটি প্রতিষ্ঠার পদক্ষেপ নেবেন। (বর্তমানে জেলা পর্যায়ে আছে, তা উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত করা যেতে পারে; এমনকি ইউনিয় পর্যায়েও করা যেতে পারে। আর তা ইউনিয়ন পর্যন্ত ইসলামিক ফাউন্ডেশনের গণশিক্ষা ইত্যাদির যে জনবল আছে তা দ্বারা সহজে বাস্তবায়ন সম্ভব) তার প্রতিটি কমিটিতে এমন কয়েকজন (২/৩) নির্ভরযোগ্য আলেমকে সদস্য হিসাবে অবশ্যই অন্তর্ভূক্ত করা চাই যাঁরা শরীয়তের সাক্ষ্য-নীতি বিষয়ে বাস্তব অভিজ্ঞতাসম্পন্ন হবেন। আর প্রতিটি উপকমিটির কাজ শুধূ সাক্ষ্য ব্যবস্থাপনাই নয়; বরং এ সব কমিটিকে ‘ফায়সালা’ দানের এখতিয়ারও প্রদান করা চাই অর্থাৎ পুরো দেশের বেলায়ই। (মুফতী রশীদ আহমদ র.: প্রসিদ্ধ আহসানুল ফাতাওয়া গ্রন্থকার)
এ উপকমিটি যদি বিধি মোতাবেক সাক্ষ্য গ্রহণ করে তার ভিত্তিতে কোন ফায়সালা দিয়ে দেয়, সেক্ষেত্রে তো এই ফায়সালা অবশ্যই শরীয়তের নির্দেশিত সাক্ষ্য-আইন মোতাবেকই হয়ে গেল।এখন শুধু ঘোষণা’র কাজ বাকী থাকলো। আর ঘোষণাকর্মের জন্য তো সাক্ষ্য থাকা জরুরী নয়। বরং উপকমিটির কোন দায়িত্বশীল ব্যক্তি এক্ষেত্রে কেন্দ্রিয় কমিটিকে সতর্কতার সঙ্গে Ñযাতে অপর কারও কোন হস্তক্ষেপের সংশয় থাকবে নাÑ উপকমিটির এই ফায়সালা বিষয়ে অবহিত করে দেবেন। কেন্দ্রিয় কমিটি এক্ষেত্রে এটিকে নিজেদের ফায়সালা বলে নয়; বরং উপকমিটির ফায়সালা হিসাবে (অথবা তার সঙ্গে আস্থা ও একমত পোষণ করে, সকলের সর্বসম্মত ফায়সালা বলেও) কেন্দ্র থেকে ঘোষণা দিতে পারেন। এমতাবস্থায় কেন্দ্রিয় কমিটির এই ফায়সালা টেলিফোনে প্রাপ্ত সংবাদের ভিত্তিতেও হতে পারে।” (প্রাগুক্ত: পৃ- ৪০২-৩)
মোটকথা, এ বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে গেল যে, উক্ত আলোচনার প্রাথমিক পর্যায়ে সাক্ষ্য জটিলতা এবং তা সাক্ষ্য ও সাক্ষীসহ কেন্দ্রে পৌঁছানো সমস্যা; আবার ‘গৃহীত সাক্ষ্য মোতাবেক ফায়সালা’-এর ক্ষেত্রে তা সাক্ষ্যসহ কেন্দ্রে পাঠানোর বাধ্য-বাধকতা সমস্যাগুলো আর চূড়ান্ত পর্যায়ে রইলো না।
সেকাল-একাল: এ ছাড়া, অধমের বিবেচনায় উক্ত গবেষণা যখন হয়, তা ছিল আজ থেকে প্রায় ৫৫ বছর আগে। তখন সুদূর দু’দেশের মধ্যে অথবা একই দেশের এ-প্রান্ত ও ও-প্রান্তে বর-কনেকে এবং দু’পক্ষের অভিভাবকদের চোখের আড়ালে রেখে কেবল ফোনের মাধ্যমে বিবাহ বৈধ হওয়ার বিষয়টি কেউ কল্পনাও হয়তো করেননি। আবার প্রয়োজন যখন দেখা দিল, তখন নেতিবাচক বক্তব্যের কারণ ছিল, সেই অষ্পষ্টতা, অসতর্কতা ও প্রতারণা’র সম্ভাবনা। কিন্তু পর্যায়ক্রমে বৈধতার পক্ষে ইতিবাচক যুক্তি ও কারণস্বরূপ বলা হল, যদি দু’পক্ষের বর-কনে ও অভিভাবকগণ পারস্পরিক জানাশোনার মধ্যে হয়, প্রতারণা বা প্রতারিত না হওয়া প্রশ্নে নিশ্চিত হন। উদাহরণত, যেই ছেলে বা যেই মেয়ের কথা আলোচনা হয়েছে বা বলা হয়েছে ; সেই ছেলের সঙ্গেই বিয়ে হচ্ছে । এক মেয়ের কথা স্থির করে তার স্থলে অন্য মেয়ের সঙ্গে বিয়ে হচ্ছে না। সেক্ষেত্রে একই দেশের দু’প্রান্ত অথবা দু’দেশের দু’প্রান্ত থেকে সাক্ষীদের উপস্থিতিতে ‘ইজাব’ ও ‘কবূল’ শুদ্ধ হয়ে যাবে তথা তেমন বিবাহ জায়েয হয়ে যাবে মর্মে ফাতওয়া দেয়া হয়ে আসছে।
ভিডিও/ভিডিও-কল, ইমু ইত্যাদি: আরও মজার ব্যাপার হল, পরবর্তিতে যখন ভিডিও, ভিডিও কল বা ইমু কল-এর মাধ্যমে উক্তরূপ বিবাহ-শাদী ও লেনদেন ইত্যাদিতে কেবল ফোনই নয়, শুধু গলার শব্দ শুনে পরিচিতি বা নিশ্চিতিই নয়; বরং কথা শোনার পাশাপাশি একে-অন্যকে দূর থেকে স্বচক্ষে দেখেও চিনতে পারছেন এবং নিশ্চিত হতে পারছেন; সেক্ষেত্রে তো আর সংশয়, সতর্কতা ও প্রতারিত হওয়ার যুক্তি ও কারণ থাকছে না। সুতরাং জেলা কমিটি বা উপকমিটির সংবাদ, সাক্ষ্যও উক্তসব আধুনিক ও ডিজিটাল পদ্ধতি অবলম্বনে পোঁছানো বা সংগ্রহ করা যেতে পারে। বর্তমানে আমাদের দেশে কি রাষ্ট্রীয়ভাবে ডিজিটাল পদ্ধতিতে ভিডিও কনফারেন্স এর মাধ্যমে সরকারপ্রধান বা রাষ্ট্রপ্রধান প্রমুখগণ বিভিন্ন সভা-সমিতি করছেন না? রাষ্ট্রীয় নির্দেশনা বা আদেশ-নিষেধ প্রদান করা হচ্ছে না? তাতে কি এমন সন্দেহ করা যায় যে, পি.এম. এর আকৃতিতে অন্য কাউকে দেখানো হচ্ছে? অথবা গাজীপুরের জেলা প্রশাসকের স্থলে নারায়ণগঞ্জের জেলা প্রশাসককে দেখিয়ে কেউ প্রতারণা করছে! সুতরাং চাঁদ দেখার সংবাদ বা সাক্ষ্যের ক্ষেত্রেও, শরীয়তের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা সামনে রেখে আমরা এসব পদ্ধতির সাহায্য নিতে পারি।
বিশেষভাবে বিবেচ্য: একটু ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করা যেতে পারে, ৬৪টি জেলায় ৬৪টি কমিটি? সুতরাং ঢাকা জেলায়ও একটি কমিটি? সেক্ষেত্রে উদাহরণত, ঢাকার প্রাণকেন্দ্র বায়তুল মুকাররমের কমিটি আকাশ মেঘাচ্ছন্নের কারণে চাঁদ দেখতে পেলেন না। তাই বলে কি উত্তরায় মেঘের ফাঁকে কারও চাঁদ দেখা অসম্ভব? মুহাম্মদপুরে বা ঢেমরায় কারও পক্ষে চাঁদ দেখা অসম্ভব? সাভার বা ধামরাইয়ে কোন ইমাম-মুয়াযযেন চাঁদ দেখলে কি তা মিথ্যা হবে? মোটেও অসত্য হবে না। সুতরাং তেমন কাউকে ‘ফিতনা’ বলতে যাওয়া , কটাক্ষ করা বা সন্দেহের চোখে দেখা সঠিক হবে না। বরং সবাইকে একসঙ্গে নিয়ে চলার চেষ্টা করতে হবে এবং প্রয়োজনে আমাদের ৬৪ জেলা কমিটিকে ৪৬০টি কমিটিতে বা আরও অধিক সংখ্যায় উন্নীত করতে হবে। আর ইতোপূর্বে বলা হয়েছে যে, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের পক্ষে তেমনটি বাস্তবায়ন অসম্ভব নয়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন