অভিযোগ আর অভিযোগ! কি নেই অভিযোগে? ক্যাসিনো থেকে শুরু করে দখল বাণিজ্য, ঘুষ নিয়ে চাকরি না দেয়া, চাঁদাবাজি, দলবাজি, মাদক বিক্রি, টেন্ডারবাজি, মন্ত্রী-এমপিদের আত্মীয়-স্বজন ও শ্যালক তুষ্টি কর্মকান্ড, ঘুষ, দলীয় পদ বিক্রি ও কমিটি বাণিজ্য, বিএনপি-জামায়াত অনুপ্রবেশ, ছোট-বড় প্রকল্পে দুর্নীতি, দলের অভ্যন্তরে বিরোধ, প্রশাসনের কর্মকতাদের একে অন্যের বিরুদ্ধে বিয়োদ্গার, নেতা ও প্রশাসনের বিতর্কিত লোকজনের অনৈতিক ও স্খলনজনিত কর্মকান্ড হাজারো অভিযোগ পড়েছে গণভবনে। এ যেন অভিযোগের পাহাড়।
সারাদেশ থেকে আসা এসব অভিযোগ মূলত- এমপি, মন্ত্রী, মেয়র, কাউন্সিলর, চেয়ারম্যান, সরকারি কর্মকর্তা, প্রকল্প পরিচালক, আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, সেচ্ছাসেবক লীগ, ছাত্রলীগ নেতাদের বিরুদ্ধে। জনপ্রতিনিধি ও আওয়ামী লীগ নেতাদের নানা অপকর্ম ও দলীয় কাজে বিশৃঙ্খলা, স্বেচ্ছাচারিতার নানা অভিযোগ ডাক যোগে গণভবনে পাঠাচ্ছেন তৃণমূল নেতারা। সরকারি কাজে যেসব অনিয়ম ও দুর্নীতি হচ্ছে, কোন কোন কর্মকর্তা এতে জড়িত এরকম হাজার হাজার অভিযোগ নামে-বেনামে গণভবন ও প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ে পাঠানো হচ্ছে। বেশিরভাগ অভিযোগের সঙ্গে প্রমাণ হিসেবে ছবি ও অপকর্মের ডকুমেন্ট সংযুক্ত করে দেয়া হয়েছে। গণভবন ও প্রধানমন্ত্রী কার্যালয় সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
সূত্র জানায়, সারাদেশ থেকে সরকার ও আওয়ামী লীগের বিষয়ে বিভিন্ন অভিযোগ গণভবনে আসছে। বেশ কিছুদিন থেকেই অভিযোগ জমা পড়ছে। অভিযোগের কারণেই শুদ্ধি অভিযান চালানোর উদ্যোগ নেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আর দুর্নীতিবিরোধী শুদ্ধি অভিযান শুরুর পর থেকে অভিযোগ পাঠানোর পরিমাণ হাজার গুণ বেড়েছে। এতো পরিমাণ অভিযোগ এসেছে যা কল্পনাতীত।
গণভবনে কর্মরত একজন কর্মকর্তা জানান, বিভিন্ন অভিযোগে চিঠি নিয়মিত আসে কিন্তু দুর্নীতিবিরোধী অভিযান শুরু পর থেকে হাজার হাজার চিঠি আসছে। বেশিরভাগই এমপি, মন্ত্রী, সরকারি কর্মকর্তারদের নানা দুর্নীতি ও অনিয়ম এবং দলের নেতাদের বিরুদ্ধে নানা অপকর্মের তথ্য চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে। অনেকের অপকর্মের ভিডিও প্রেরণ করা হচ্ছে।
গণভবন সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে যেসব চিঠি এসেছে তা তৃণমূল নেতাদের সরাসরি নামে এসেছে। অতীতে এ অভিযোগগুলো ধানমন্ডিস্থ আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে নেতারা পাঠালেও তাতে কোন ধরণের কাজ না হওয়া বা ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় সকল চিঠি বা অভিযোগ এখন গণভবনে পাঠাচ্ছেন তৃণমূল নেতারা। এসব অভিযোগের মূল বিষয়বস্তু হচ্ছে, এমপি-মন্ত্রীদের স্বেচ্ছাচারিতা, দলের কোন কর্মকাÐ ঠিক মতো না হওয়া, দলের প্রতিটি পদে আত্মীয়করণ, গুটি কয়েক নেতার বাইরে অন্য নেতাদের কোন দলীয় কাজে না রাখা, নেতাদের চাঁদাবাজি, দখলবাজি, মাদকব্যবসার মত অভিযোগ। এছাড়া অতীতে দলের কার কাছ থেকে কত টাকা নিয়ে কোন নেতা পদ বাণিজ্য করেছেন, কার কার হাত ধরে বিএনপি-জামায়াতের কর্মীরা অনুপ্রবেশ করেছেন, কারা এদের আশ্রয় দিচ্ছেন এসব অভিযোগের বিস্তারিত তুলে ধরছেন। এসব চিঠিতে আরেকটি বড় অভিযোগ হল, আওয়ামী লীগ করলেও এমপি বা উপজেলা চেয়ারম্যানের রোষানলে পড়ে নির্যাতিত হবার কাহিনী। বিগত জাতীয় নির্বাচনে এমপি বিপরীতে আওয়ামী লীগের অন্য প্রার্থীর রাজনীতি করায় হয়রানি, মামলা ও নির্যাতনের শিকার হওয়া; বিগত উপজেলা নির্বাচনে নৌকার প্রার্থীর হয়ে কাজ করেছেন কিন্তু জয়লাভ করেছে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী, এতে নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। অনেকের নামে মামলা হচ্ছে, দলের পদে থাকলেও কোন অনুষ্ঠানে যেতে পারছেন না অনেক নেতা।
আর অন্য দিকে সরকারি বিভিন্ন কাজের অনিয়ম দুর্নীতি নিয়ে পাঠানো চিঠিগুলোর বেশিরভাগ বেনামে পাঠানো হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ে এ চিঠিগুলো বেশি পাঠানো হয়েছে। এমপি-মন্ত্রীদের দুর্নীতির তথ্য এখানে পাঠানো হয়েছে। বিভিন্ন দফতরের দুর্নীতির তথ্য-প্রমাণ যুক্ত করে এসব চিঠি পাঠানো হয়েছে। এ অভিযোগগুলোর মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন প্রকল্পের অনিয়ম, টেন্ডার প্রক্রিয়ার নানা অনিয়ম, ক্রয়ের ক্ষেত্রে বিভিন্ন পণ্যের অস্বাভাবিক মূল্য, কোন সরকারি কর্মকর্তার কত সম্পত্তি, দেশের বাইরে তাদের সম্পদের হিসেব, কোন প্রজেক্ট বা কাজ থেকে কতটাকা কমিশন নিয়েছেন সে সম্পর্কে তথ্য ও বিস্তারিত ব্যাখ্যা।
রাজধানীর সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর, ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের নেতা, যুবলীগ, ছাত্রলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগের থানা ও ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতাদের নিয়েও বিস্তর অভিযোগ চিঠির মাধ্যমে পাঠানো হয়েছে। কারা কারা মাদক ব্যবসার আশ্রয়দাতা, কোথায় জমি দখল করেছেন, নেতাদের আত্মীয়রা কে কোন রাস্তার ফুটপাথ, টেম্পু স্ট্যান্ড, বাসস্ট্যান্ড থেকে চাঁদা তোলেন, পরিবহন নিয়ন্ত্রণ কারা করছেন সে বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে।
গণভবন সূত্র জানায়, চিঠির অভিযোগ গুলোর সত্যতা যাচাই-বাছাইয়ের পর বিশ্লেষণ করে তা সংশ্লিষ্ট বিভাগে পাঠানো হচ্ছে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য। প্রধানমন্ত্রী কার্যালয় সূত্র জানায়, বেশিরভাগই চিঠিতে শুধু অভিযোগ করা হয়েছে, কিছু অভিযোগের সঙ্গে প্রমাণাদি পাঠানো হয়েছে। বিভিন্ন প্রকল্পের অনিয়ম, সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতি ও অবৈধ সম্পদের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট প্রমাণ পাঠানো হয়েছে। গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে এসবের তদন্ত করা হচ্ছে। সঠিক হলে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে জানা গেছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী এক নেতা জানান, গণভবনে অভিযোগ আসার পর সেগুলো যাচাইবাছাই করে সারাদেশে দুর্নীতিবাজ ও বিতর্কিতদের দলীয় পদে না রাখার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়, গণভবনের ওই অভিযোগ আসায় ১০ বছরে দলে অনুপ্রবেশকারীদের শনাক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। ইতোমধ্যে সারাদেশের অনুপ্রবেশকারীদের শনাক্ত করে জেলায় জেলায় তাদের তালিকা পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। ওই নেতা আরো জানান, গণভবনে অভিযোগের ভিক্তিতেই করেই সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, কে কখন কিসে ধরা পড়েন বলা যায় না।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন