সাকিব আল হাসান জনপ্রিয় একটি মুখ, যাকে ক্রিকেটবিশ্বে এক নামে সবাই চেনে, মর্যাদা দেয়। ক্রিকেটের তিন ধারাতেই তিনি এক নম্বর অবস্থানে থেকেছেন। তিনিই একমাত্র বাংলাদেশি, যিনি দেশের বিপিএল ছাড়াও ভারত, অস্ট্রেলিয়া, ওয়েস্ট ইন্ডিজের পেশাদার লিগে খেলার ডাক পেয়ে থাকেন। সদ্যসমাপ্ত বিশ্বকাপেও সাকিব ছিলেন সেরাদের সেরা হওয়ার দৌড়ে। এই গৌরবময় অবস্থানে হঠাৎ যেন ছন্দপতন হলো।
সবাই জানি, খেলাধুলার অঙ্গনে জুয়াড়িদের তৎপরতা ব্যাপক। ক্রিকেটের সর্বোচ্চ বিশ্বসংস্থা আইসিসির বিরুদ্ধে অত্যন্ত শক্ত অবস্থান নিয়েছে। সাকিবের মতো প্রতিভাবান খেলোয়াড়দের পেছনে যে জুয়াড়িরা লাগবে, তা স্বাভাবিক। অতীতে তাদের প্রস্তাব পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে সাকিব বিষয়টি আইসিসির নজরে এনেছিলেন। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, ২০১৮ সালে জুয়াড়িদের কাছ থেকে ম্যাচ পাতানোর প্রস্তাব পেয়ে সাকিব তা সঙ্গে সঙ্গে নাকচ করে দিলেও বিষয়টি আইসিসি বা বিসিবিকে অবহিত করেননি। এটি আইসিসির কোড অব কন্ডাক্টের শর্তের বরখেলাপ। এর জন্য সংশ্লিষ্ট খেলোয়াড়দের শাস্তি হওয়ার কথা। শেষ পর্যন্ত সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে আইসিসির শৃঙ্খলাসংক্রান্ত শাখা আকসু সাকিবকে দুই বছরের জন্য সব ধরনের খেলায় অংশ নেওয়া থেকে বিরত থাকার শাস্তি দিয়েছে। তবে এর মধ্যে এক বছর হলো স্থগিত শাস্তি। অর্থাৎ তিনি যদি আর কোনো রকম শর্তভঙ্গের কাজ না করেন, তবে এ শাস্তি প্রযোজ্য হবে না। সেদিক থেকে ধরা যায় যে, সাকিব আগামী ২০২০ সালের ২৯ অক্টোবর থেকে আবার খেলায় ফিরতে পারবেন।
সাকিব তার ভুল বা দোষ স্বীকার করেছেন। হয়তো সাকিব এবং বিসিবি শাস্তি মওকুফ বা তা আরও কমানোর আবেদন জানাবেন। কেননা সাকিব বলছেন, যেহেতু তিনি প্রস্তাব পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তা নাকচ করে দিয়েছিলেন তাই বিষয়টির সেখানেই সমাপ্তি ঘটেছে বলে ধরে নিয়েছিলেন। ফলে তিনি এ বিষয় আর কাউকে জানাননি। তার অসতর্কতা বা আইন ও শর্তের নির্দেশনা বুঝতে ভুল হওয়ায় এই ঘটনা।
অবশ্য, দোষ স্বীকার করায় এক বছরের শাস্তি স্থগিত থাকবে। তবে, দোষ ও শাস্তি দুটোই মেনে নেওয়ায় শাস্তির বিরুদ্ধে আপিল করার সুযোগ থাকছে না সাকিবের। অর্থাৎ ২০২০ সালের ২৯ অক্টোবর পর্যন্ত কোনো ধরনের ক্রিকেটে মাঠে নামতে পারবেন না বাংলাদেশের তারকা এই ক্রিকেটার। এর ফলে আইপিএল ও টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের পরবর্তী আসরেও খেলতে পারবেন না সাকিব। দুঃখজনক বিষয় হলো, সাকিবের এই নিষেধাজ্ঞা এমন এক সময়ে এলো যখন প্রথমবারের মতো পূর্ণাঙ্গ সফরে ভারতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। সাকিবকে ছাড়া ভারতের মাটিতে এ সফর নিয়ে জাতীয় দলের খেলোয়াড়রা যেমন ব্যথিত তেমনি দেশের ক্রিকেটামোদীরাও উদ্বিগ্ন। অবশ্য কেবল ভারত সফরই নয় বাংলাদেশের ক্রিকেটে সাকিবহীন একটা বছর কেমন যাবে তা নিয়েই উদ্বেগ রয়েছে মানুষের।
সাকিব আল হাসান ম্যাচ ফিক্সিং করেননি, কিন্তু ম্যাচ ফিক্সিংয়ের প্রস্তাব পেয়েও তা গোপন করেছেন। আইসিসির বিধিমালা অনুসারে এটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এমন অপরাধের শাস্তি সাকিবই প্রথম পাচ্ছেন বিষয়টি এমনও নয়। নানা সময়ে নানা দেশের বেশ কয়েকজন খ্যাতনামা ক্রিকেটার বিভিন্ন মেয়াদে নিষেধাজ্ঞার শিকার হন, কেউ অপরাধ প্রমাণিত না হওয়ায় পরে অব্যাহতি পান আবার অপরাধের প্রমাণ পাওয়ায় কেউ সারা জীবনের জন্যও নিষিদ্ধ হন। সাকিবের ওপর এই নিষেধাজ্ঞা নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখে গেছে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটাঙ্গনে। ভারতের সাবেক অধিনায়ক রাহুল দ্রাবিড় একে অনেকটা লঘুপাপে গুরুদ- বলেই মন্তব্য করেছেন। অন্যদিকে ইংল্যান্ডের সাবেক অধিনায়ক মাইকেল ভন মনে করেন সাকিবের শাস্তি আরও বেশি হওয়া উচিত ছিল। বলাই বাহুল্য, বাংলাদেশের মানুষও সাকিবের শাস্তির বিষয়ে কোনো স্পষ্ট অবস্থান নিতে পারছে না, তা যেমন আবেগের কারণে, তেমনি নানা যুক্তিতর্কের বিবেচনাতেও।
সাকিবের সঙ্গে বুকি হিসেবে পরিচিত ম্যাচ ফিক্সার বা জুয়াড়িদের সঙ্গে তিন দফা আলাপ হয়। সবই ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে এপ্রিলের মধ্যে। সাকিব জানতেন, এটা জানাজানি হলে শাস্তি অনিবার্য। তবু এসবের কিছুই তিনি আইসিসির অ্যান্টি করাপশন ইউনিট বা আকসুকে জানাননি। পরে আকসু চলতি বছরের জানুয়ারি ও আগস্টে দুই দফা শুনানির মুখোমুখি করে সাকিবকে। তাদের পূর্ণ সহযোগিতা করে সাকিব সব দোষ স্বীকার করে নেন এবং শাস্তি মেনে নিয়ে চিঠি লেখেন আইসিসিকে। প্রশ্ন হলো, ১৩ বছর ধরে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে থাকা সাকিবের মতো বিশ্বখ্যাত অলরাউন্ডার বিধিভঙ্গের বিষয়ে জেনেশুনেও বিষয়টি গোপন রাখার চেষ্টা করলেন কেন? দেশপ্রেম বা আবেগের জায়গা থেকে বিবেচনা করলে একে ‘ভুল’ হিসেবে অভিহিত করে আত্মপ্রসাদ লাভ করা যেতে পারে। কিন্তু যুক্তির বিচারে একে ‘অপরাধ’ বলেই মেনে নিতে হবে।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অনিয়ম কিংবা ম্যাচ ফিক্সিংয়ের মতো কোনো অপরাধ ঘটছে কি না তা নিয়ে প্রশ্ন থাকতেই পারে। কিন্তু সাক্ষ্যপ্রমাণ মেলার পর অপরাধকে অপরাধ হিসেবে স্বীকার করে নিতে হবে। সাকিব আল হাসান জীবনের সেরা সময়ে এসে তার অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত করতে যাচ্ছেন। এই ঘটনা থেকে বাংলাদেশকে অবশ্যই শিক্ষা নিতে হবে। দেশের ক্রিকেটারদের সাম্প্রতিক আন্দোলনের দাবি-দাওয়া থেকে শুরু করে ক্রিকেট অবকাঠামোর উন্নয়নের বিষয়ে মনোযোগ দেওয়ার পাশাপাশি খেলোয়াড়দের নৈতিক মানোন্নয়নের দিকেও নজর দিতে হবে। জাতীয় কিংবা আন্তর্জাতিক সব পর্যায়ে ক্রিকেটের স্বার্থেই ক্রিকেট সব ধরনের দুর্নীতি থেকে মুক্ত থাকবে সেটাই কাম্য।
বিগত কিছু দিন ধরেই বাংলাদেশ ক্রিকেট নিয়ে চলছিল নানা অস্থিরতা। ২১ অক্টোবর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে ১৩ দফা দাবিতে অনির্দিষ্টকালের জন্য ধর্মঘটের ডাক দেন ক্রিকেটাররা। ২৩ অক্টোবর বিসিবির সঙ্গে বৈঠক শেষে ধর্মঘট তুলে নেন তারা। তাদের বেশির ভাগ দাবি মেনে নেয়ার ঘোষণা দেন বিসিবি সভাপতি। সফরের জন্য জাতীয় দলের অনুশীলন ক্যাম্প শুরু হলেও যোগ দেননি সাকিব আল হাসান। পরদিন একটি টেলিকম কোম্পানির সঙ্গে সাকিবের ব্যক্তিগত চুক্তি নিয়ে আপত্তি করে বিসিবি। এক সাক্ষাতকারে বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান বলেন, ক্রিকেট নিয়ে একটা ষড়যন্ত্র আছে। ২৯ তারিখ যখন টি-টোয়েন্টির দল ঘোষণা হবে ঠিক সেই সময়ে আইসিসি থেকে সাকিবের বিরুদ্ধে অভিযোগটি সবাইকে ভাবিয়ে তোলে। তারপরেও আশার কথা, বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেটারদের শিবির শুরু হয়েছে সাকিবকে বাদ দিয়ে। আমাদের আশা, সবকিছু সামলে নিয়ে ভারতে একটি লড়াকু পেশাদার ও দায়িত্বশীল সিরিজ উপহার দেবে বাংলাদেশের টাইগাররা। সাকিব দেশবাসীকে প্রচুর আনন্দের উপলক্ষ এনে দিয়েছেন। তার কাছে প্রত্যাশা ছিল আকাশচুম্বী। খেলার মাঠে দায়িত্ববান সাকিবের কাছে খেলার বাইরেও প্রত্যাশিত ছিল দায়িত্ববোধ। যা হোক, লঘু ভুলে গুরুদ- পাওয়া সাকিব নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে ফিরে আসুক আপন ভুবনে, হেসে উঠুক ক্রিকেটও। তার জন্য রইল শুভ কামনা।
লেখক: অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট, সভাপতি, সাউথ এশিয়ান ল’ ইয়ার্স ফোরাম
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন